সেলিনা একটা মোটা ফর্সা মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে তাকে দেখিয়ে বলল, আমার প্রিয় বান্ধবী জোবেদা।
জোবেদা হেসে আমাকে সালাম দিল।
আমি সালামের উত্তর দিয়ে বললাম, কেমন আছেন? আপনার কথা ওর কাছে। অনেক শুনেছি।
ভালো আছি বলে জোবেদা চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
তারা দুজনেই সেদিন হলুদ রং এর সাটিন কাপড়ের সালওয়ার কামিজ পরেছিল। আজ সেলিনাকে এই পোশাকে অপূর্ব সুন্দরী বলে আমার মনে হল। চোখে চোখ পড়তে সেলিনা দৃষ্টিটা নামিয়ে নিয়ে বলল, কাল অত তাড়াতাড়ি ফোন ছেড়ে দিলেন কেন?
বললাম, এর উত্তর তো তোমার জানা থাকা উচিত।
জোবেদা বলে উঠল, জানেন, আপনি ফোন ছেড়ে দেওয়ার পর ওতো লাইন কেটে গেছে মনে করে আবার আপনার ফোনের আশায় আধ ঘন্টা বসেছিল।
কথাটা শুনে সেলিনার ফর্সা মুখটা রাঙা হয়ে উঠল। বললাম, সে জন্য দুঃখিত। তারপর লজ্জার হাত থেকে বাঁচাবার জন্য জোবেদাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলাম, ইতিহাসে জোবেদা নামে একজন নারীর কথা বর্ণনা আছে, বলুন তো সেই নারী কে ছিলেন?
জোবেদা বলল, জানি না, আপনি বলে দিন।
বাগদাদের খলিফা হারুন আর রশিদের প্রাধান ও প্রিয় বেগম ছিলেন। তিনি নিজের খরচে প্রজাদের পানির কষ্ট দূর করার জন্য একটি খাল খনন করে দিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তারপর বললাম, আপনারা বসুন, আমার সহকর্মীরা আসা পর্যন্ত আপনাদের অপেক্ষা করতে হবে।
তারা না বসে ঘুরে ঘুরে দোকানের বই দেখতে লাগল। একটু পরে জোবেদা জিজ্ঞেস করল, এত বই এর নাম আপনার মুখস্থ আছে?
মৃদু হেসে বললাম, না!
তাহলে কাষ্টোমার চাইলেই ঝটপট বের করে দেন কী করে?
আয়নার সামনে দাঁড়ালে যেমন নিজের ছবি ভেসে উঠে, কাস্টোমার যখন কোনো বই চায় তখন ঠিক তেমনি মনের আয়নায় বইটির সবকিছু মনে পড়ে যায়। তাই তাড়াতাড়ি বের করতে পারি। মুখস্থ ধরলে হয়তো দুতিনশ নাম বলতে পারব। আর লিখতে বললে আরও দুএকশ বেশি লিখতে পারব। বাকি সব মনের আয়নায় পর্দার আড়ালে ষ্টক আছে। কেউ কোনো বই চাইলেই পর্দা সরে গিয়ে ঐ বইটির কথা ভেসে উঠে।
সেলিনা একটা বই এনে আমাকে মেমো করে দিতে বলল। বইটির মেমো করছি এমন সময় আমার দুজন সহকর্মীকে আসতে দেখে বললাম, আপনারা নভেলে গিয়ে বসুন, আমি আসছি।
বই এর দাম দিয়ে তারা চলে গেল।
মিনিট পাঁচেক পর আমি নভেল ড্রিংকে গিয়ে দেখি, দুজনে মুখোমুখি বসে গল্প করছে। আমি তাদের পাশে একটা চেয়ারে বসে বেয়ারাকে প্রথমে দুটো করে বড় মিষ্টি ও পরে চানাচুর ও চা দিতে বললাম।
জোবেদা বলল, আপনি বুঝি মিষ্টি খেতে খুব ভালবাসেন?
খাওয়ার ব্যাপারে আমার কোনো বাদ বিচার নেই। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের জন্য যা কিছু হালাল করেছেন, সবই আমি খেতে ভালবাসি। তার মধ্যে মিষ্টি ও ফলের উপর লোভ একটু বেশি। খাওয়া শেষ হতে বললাম, আরও তে বলি?
তারা দুজনেই বলে উঠল, আর খেতে পরব না।
তারপর চা খেতে খেতে চিঠিটা বের করে সেলিনার হাতে দিলাম। চিঠি নেওয়ার সময় তার হাত কাপছিল। কম্পিত হস্তে চিঠিটা ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে দিল।
জোবেদাকে বললাম, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
নিশ্চিন্তে করুণ।
আচ্ছা, আপনি তো ওর প্রিয় বান্ধবী? আপনার কি উচিত না ওকে বিপদ থেকে উদ্ধার করা? ও তো গুহার মধ্যে বাঘ আছে জেনেও তাতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।
জোবেদা বলল, সেলিনা যখন আমাকে প্রথম আপনার পরিচয় জানিয়ে সব কথা বলে তখন আমি ওকে অনেক বারণ করেছি। এমন কি ঝগড়া করে কয়েকদিন মেলামেশা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছি। শেষে আবার অনেক অনুনয় বিনয় করে বন্ধুত্ব ফিরে পেয়েছি। ভাবলাম, ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করে বন্ধুত্ব নষ্ট করব কেন? অনেক দিন থেকে আপনার সঙ্গে পরিচয় করার ইচ্ছা ছিল, সেলিনাই করায় নি। গতকাল যখন ফোন ধরলাম তখন ওকে চাপ দিতে রাজি হয়ে আজ নিয়ে এসেছে। সত্যি কথা বললে আপনার সামনে আপনার প্রশংসা হয়ে যাবে, তবু বলছি, সেলিনা অপাত্রে প্রেম নিবেদন করেনি।
আপনি ওকে খুব ভালবাসেন, তাই এ কথা বলছেন। কারণ আমার মধ্যে এমন কোনো গুণ নেই, যা দেখে আমাকে সুপাত্র বলা যেতে পারে।
গুণীরা কোনো দিন নিজের গুণ নিজেরা জাহির করে না, বরং তা আপনা থেকে সুগন্ধি ফুলের খুশবুর মত চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
কথা বেশি বেড়ে যাচ্ছে দেখে বললাম, দেরি হয়ে গেল, আর সময় দিতে পারছি না। তারপর বিল পেমেন্ট করে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দোকানে ফিরে আসার সময় ভাবলাম, সেলিনা চিঠিটা পড়ে কি করবে কি জানি?
এরপর প্রায় বিশ পঁচিশ দিন সেলিনার কোনো খবর পেলাম না। প্রতিদিন দোকানে এলে মনে হত, আজ নিশ্চয় কোনো খবর পাব। চিঠিটা দিয়ে আমিও খুব অশান্তিতে ছিলাম। একদিন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে আর্জেন্ট বই সাপ্লাই দেওয়ার জন্য সকাল আটটায় দোকান খুলে কাউন্টারের উপর টাইপ মেশিন রেখে বিল তৈরি করছিলাম। ঠিক সাড়ে আটটার সময় সেলিনাদের ড্রাইভার এসে আমাকে ছোট্ট একটা ভাজকরা কাগজ দিয়ে বলল, খুকী ভাই দিয়েছে। দাদু চলে যাওয়ার পর কাগজটা খুলে পড়লাম
ওগো আমার হৃদয়ের স্পন্দন,
প্রথমে দুখিনীর সালাম নেবেন। পরে আপনার কদম মোবারকে আজি জানাচ্ছি, আগামীকাল বেলা এগারটায় আপনাকে পার্কের সেই জায়গায় পেতে চাই। এটাই হয়তো আমার জীবনের শেষ অনুরোধ। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি–
আপনার পথের কাঁটা
অভাগিণী সেলিনা।