রিকশাওয়ালা ড্রাইভারের সঙ্গে ঝগড়া করতে উদ্যত হলে, তাকে থামিয়ে তার ভাড়া দিয়ে বললাম, ঝগড়া করে কাজ নেই। তারপর গাড়ির কাছে যেতে সেলিনা দরজা খুলে সালাম দিয়ে বলল, উঠে আসুন।
আমি সালামের জওয়াব দিয়ে গাড়িতে উঠে বললাম, তীতুমীর কলেজে যাব। ড্রাইভার তা শুনতে পেয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল। কলেজে পৌঁছে আমি একাই ভিতরে গেলাম। কাজ সেরে ফিরে এসে গাড়িতে বসার পর সেলিনা বলল, দাদু কন্টিনেন্টাল (বর্তমানে শেরাটন) হোটেলে চলুন।
দাদু গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পর বললাম, এখন কোথাও যেতে পারব না। আমাকে দোকানে যেতে হবে। গাড়ি যখন ক্যন্টনমেন্টের গেট পার হয়ে পুরান এয়ারপোর্টের কাছে এল তখন সেলিনা দাদুকে বলল, বাঁদিকের ঐ হোটেলটার সামনে রাখুন।
গাড়ি থামার পর নামার সময় জিজ্ঞেস করলাম, কোথা থেকে আসা হচ্ছে?
টুঙ্গী থেকে। খালার সঙ্গে তার দেওরের বাড়ি গিয়েছিলাম। উনি কুর্মিটোলা, এয়ারপোর্টে কন্ট্রাকটারী করেন। সেখানে একটা বাড়ি করে স্বপরিবারে থাকেন। আমরা কেবিনে গিয়ে বসলাম। সেলিনা বলল, খালাআম্মা নাস্তা করে আসতে বলেছিল। অত সকালে আমি কিছু খেতে পারি না, তাই চা বিস্কুট খেয়ে এসেছি। এখন নাস্তা করব বলে বেয়ারাকে দুপ্লেট মুরগীর মাংস ও পরোটার অর্ডার দিল।
বললাম, আমি কিছু খাব না, নাস্তা খেয়েছি।
আপনি না খেলে আমিও কিছু খাব না। আমার জন্য না হয় অল্প কিছু খান। বেয়ারাকে মুরগীর মাংস ও পরোটার বদলে দুটো করে বড় মিষ্টি ও স্লাইস রুটি দিতে বলল।
নাস্তা শেষে চা খেতে খেতে বলল, জানেন, আপনার চিঠি পড়ে কোনো কাজ হয়নি। বরং আপনাকে আরও বেশি ভালবেসে ফেলেছি। মনে হয়েছে আমাকে কাঁদাবার জন্য আর পরীক্ষা করার জন্য এই চিঠি দিয়েছেন। চিঠিটা পড়ার সময়। আল্লামা ইকবালের একটা বয়েত আমার মনে পড়ে
জফা জো ইস্কমে হোতা হ্যায়
ওহ জফাহি নেহী,
সিতম না হো তো মহব্বত মে
কুছ মজা হি নেহী।
আমি ইডেন কলেজে পড়ি। অতএব আপনি সারাদিন আমার কাছেই থাকেন। যখন মন চায়, ক্লাসের অফ পিরীয়ডে মার্কেটে গিয়ে দূর থেকে আপনাকে দেখে আসি। আপনি যে এই রকম, চিঠি দেবেন। তা অনেক আগেই জানতাম। আমার প্রেম আপনার মনের সকল খবর বলে দেয়।
সেলিনার কথা শুনে খুব আশ্বৰ্য্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এখন আমি কি ভাবছি বল তো?
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, ঐ চিঠি লেখার সময় যা ভেবেছিলেন, এখনও তাই ভাবছেন।
আরও বেশি আশ্বৰ্য্য বোধ করে আবার জিজ্ঞেস করলাম, সেটা কী?
কেন, আপনি কী ঐ চিঠি লেখার সময় ভাবেন নি? এই চিঠিতে যদি কাজ না : হয়, তবে আরও একটা চিঠিতে জঘন্যতর কিছু লিখে আমার মনে ঘৃণা তৈরি করার চেষ্টা করবেন। এখনও আপনি সেই কথা ভাবছেন। কী? আমি সত্য বললাম কিনা বলুন?
আশ্চর্য ক্রমশঃ বেড়েই চলল। বললাম, তুমি নিশ্চয় সাইকোলজী ও এ্যাসট্রোলজীর অনেক বই পড়েছ?
আমি ঐ সব কিছুই পড়িনি। আমার প্রেম আমাকে সবকিছু জানিয়ে দেয়। বলুন না, আমার কথা ঠিক কিনা?
স্বীকার করে বললাম, চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি ড্রাইভারের পাশে বসলাম। মাথার মধ্যে তখন সেলিনার চিন্তা শক্তির কথা ঘুরপাক খাচ্ছে।মনে হল। তার কাছে সব দিক থেকে হেরে যাচ্ছি। কিন্তু কেন? তবে কি সেলিনার গভীর প্রেম এর জন্য দায়ী? না আমিও তাকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলছি? আমি যখন, ঐসব ভাবছি তখন সেলিনা ড্রাইভার দাদুকে বলল, ওঁকে নিউ মার্কেটে নামিয়ে দিয়ে বাসায় চলুন।
তারপর প্রায় তিন মাস হয়ে গেল এর মধ্যে তেমন কিছু ঘটেনি। মাঝে মাঝে সেলিনা দোকানে এসে বই কিনে নিয়ে গেছে।
একদিন এসে বলল, আমাকে কয়েকটা ধর্মীয় বই দিন।
আমি মাওলানা আসরাফ আলি থানভীর (রা:) এর কুরআনের তফসীর ও গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী দিলাম। সেলিনা দুটোই কিনল। সে যখন দোকানে। আসত তখন আমি তাকে আপনি বলে সম্বোধন করতাম, আর তার মুখের দিকে মোটেই তাকাতাম না।কারণ হঠাৎ করে যদি কিছু বলে বসে। তবে তাকে দেখার খুব ইচ্ছা হত। ইচ্ছাটাকে কঠোরভাবে দমন করে রাখতাম।
একদিন কাউন্টারের উপর বই দেখতে দেখতে ঝুকে মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বলল,প্রতিজ্ঞা করেছেন বুঝি আমার মুখ দেখবেনা না? আমার কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে আবার বলল, আমাকে আপনি বাইরের চোখে না দেখলে কি হবে, অন্তরের চোখে সব সময় দেখেন। তাই বাইরের দৃষ্টিকে সংযত রাখতে পেরেছেন। একটা কথাও বলবেন না? শেষের কথাটা কান্নার মত, শোনাল।
আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাতের বইটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, নেবেন?
ছলছল চোখে সেলিনা বলল, হ্যাঁ।
আমি বইটা মেমো করে তার পিছনে লিখলাম, তোমার হাতের বইটি তো। তোমার সঙ্গে কথা বলছে না, কিন্তু তুমি ইচ্ছা করলে ওটা থেতে অনেক কিছু। জানতে পার। তারপর মেমোটা তার হাতে দিলাম।
কিছু না বলে মেমো ও বইটা নিয়ে সেলিনা চলে গেল।
এই ঘটনার কিছুদিন পর ড্রাইভার একদিন আমাকে একটা বড় খাম দিয়ে গেল। দুপুরে খাওয়ার পর খুলে দেখি বেশ বড় চিঠি পড়তে শুরু করলাম—
প্রিয়তম,
প্রথমে এই দীনহীনার শতকোটি সালাম নেবেন। আশা করি, পরম করুণাময় আল্লাহপাকের রহমতে আপনি ও আপামনি ছেলেমেয়েসহ ভালো আছেন। এই চিঠি পড়ে আপনি আমাকে হয়তো স্বার্থপুর ভেবে গৃণা করবেন। তবু আপনাকে আমার ইতিহাস বলা দরকার, তাই লিখছি। এর আগে অনেকবার বলতে ইচ্ছা হয়েছে, কিন্তু এতকথা শোনার সময় আপনার ছিল না, তাই বলিনি।
আমাদের আসল বাড়ি সিলেট শহরে। আব্বা পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। দাদুর আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল ছিল। ছোট বেলা থেকে আব্বা খুব মেধাবী ছিলেন। স্কুল কলেজে সব সময় প্রথম সারিতে স্থান পেয়েছেন। উনি যখন ডিগ্রীতে পড়েন। তখন তার ফুপাতো বোনের সঙ্গে মন দেওয়া নেওয়া হয়। দুজনে একই কলেজে পড়তেন। আব্বা যখন ফাইনাল ইয়ারে আম্মা তখন ইন্টারমিডিয়েটে। আমাদের বাড়ির কাছে আব্বার ফুপার বাড়ি। মেয়েকে ভর্তি করে এসে উনি আব্বাকে বললেন, তুমি সময় করে আমার মেয়ে আয়েশাকে পড়াশুনার ব্যাপারে একট সাহায্য করো। তারপর থেকে দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে। এই ব্যাপারটা উভয় ফ্যামিলির সবাই জানত। আব্বা যখন ব্যারিষ্টারী, পড়ার জন্য বিলেতে যেতে চাইলেন তখন দাদু বললেন, এত টাকা আমার নেই। তারচেয়ে তুমি বরং এল, এল, বি পাশ করে ঢাকায় প্রাকটীস কর। কথাটা আব্বার ফুপার কানে যায়। তাদের অবস্থা খুব ভালো। কিসের যেন ব্যবসা ছিল। একদিন তিনি এসে দাদুকে বললেন, মিঞা ভাই, আমার মেয়ে আয়েশার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে মাঈনুলকে আর্মি রিলেত পাঠাব। আশা করি, আপনি দ্বিমত করবেন না। দাদু এই প্রস্তাবে সম্মতি দেন। আর আব্বার কথাই তো আলাদা। বিয়ের তিন মাস পর আব্বা বিলেত চলে যান। আম্মাও পরের বছর ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে আব্বার কাছে চলে যায়। ব্যারিষ্টারী পাশ করে আব্বা সেখানে প্র্যাকটীস শুরু করেন। আর আম্মাও গ্রাজুয়েসন নিয়ে একটা নার্সারী স্কুলে মাষ্টারী করত। আমাদের দুই বোনের জন্ম লন্ডনে। আমি সেখানে প্রায় দশ বছর বয়স পর্যন্ত পড়াশোনা করি। দাদু মারা যাওয়ার খবর পেয়ে আব্বা আমাদের সবাইকে নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। তারপর ঢাকায় হাইকোর্টে ওকালতি করতে থাকেন। বছর দুইয়েকের মধ্যে মালিবাগে জায়গা কিনে এই বাড়িটা করেন। বিলেত থেকে আসার সময় এই গাড়িটাও আনেন। আব্বা আমাকে বেশি আদর করতেন। যখন যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। আমাদের কোনো ভাই নেই। আব্বা আমাদের দুই বোনের নামে এক লাখ টাকা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট রাখেন। উনি মারা যাবেন বলে হয়তো উইলও করে গেছেন। ব্যাংকের টাকা বিয়ের পর আমরা দুবোন স্বত্ত্বাধিকারী হব। তার আগে নয়। বাড়িটা আম্মার নামে হেবানামা করে গেছেন। আম্মা যত দিন বেঁচে থাকবে ততদিন আমরা এই বাড়িতে কোনো দাবী করতে পারব না। আম্মার মৃত্যুর পর আমরা দুবোন পাব। আম্মা ইচ্ছা করলে বাড়ি বিক্রী অথবা দানপত্র কোনোটাই করতে পারবে না। বাড়ির আয় থেকে প্রতি মাসে আমারা দুবোন প্রত্যেকে হাত খরচ বাবদ দুইশত টাকা পাই।
বিলেত থেকে এসে আমরা কিছুদিন দেশের বাড়িতে ছিলাম। আব্বা একা ঢাকায় থাকতেন। সেই সময় আম্মা দাদির সঙ্গে যুক্তি করে আব্বাকে না জানিয়ে তার বড় ভাইয়ের ছেলে সহিদের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে দেয়। তখন আমার বয়স। এগার বছর হবে। বিয়ে কি জিনিস আমি তখন জানতাম না। তবে কেমন যেন একটু কৌতূহল হয়েছিল। কানাঘুসো শুনেছিলাম, আব্বা বাড়িতে এলে খুব গোলমাল হবে। সে সব অনেকদিন আগের কথা; তবু কিছু কিছু মনে আছে! আব্বা ঢাকায় বাসা ভাড়া ঠিক করে আমাদেরকে নিয়ে যেতে আসলেন। রাত্রে খাওয়ার পর আব্বা দাদির ঘরে গেলেন। আমিও আব্বার সঙ্গে ছিলাম। দাদি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, খুকীর বিয়ে আমি তোমার বড় সমন্ধির ছেলে সহিদের সঙ্গে দিয়েছি।
কথাটা শুনে আব্বা চমকে উঠলেন। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমাকে না জানিয়ে এই কাজ করা ঠিক হযনি। তারপর দাদির ঘর থেকে আব্বা যখন নিজের ঘরে এলেন তখন আম্মা আব্বার পায়ে ধরে বলল, এই কাজ তোমাকে না জানিয়ে করে মস্ত বড় অন্যায় করেছি। তুমি আমাকে। ক্ষমা করে দাও।
আব্বা ভিজে গলায় বললেন, আমাদের কোনো পুত্র সন্তান নেই। খুকীকে বেশি লেখাপড়া করার জন্য বিলেত পাঠাব বলে ভেবে রেখেছিলাম। সে আশা তুমি ভেঙ্গে চুরমার করে দিলে। তোমাকে আর কি বলব, সবই তকদিরের লিখন।
আম্মা বলল, সহিদ খুব মেধাবী। এ বছর ম্যাট্রিক দেবে। তারপর তাকে আমাদের কাছে রেখে মানুষ করব। ওদের দুজনের যাতে পড়াশোনার ক্ষতি না হয়, সেই রকম ব্যবস্থা করে আমাদের মত ওদেরকেও বিলেত পাঠাব।
আব্বা বললেন, ম্যান প্রপোজেস গড ডিসপোজেস। যেমন আমি ভেবে ছিলাম এক আর হয়ে গেল এক। জানি না, তোমার ইচ্ছা কতদূর সফল হবে। তারপর আর তেমন কিছু ঘটল না।
কয়েকদিন পর আমাদের সকলকে নিয়ে আব্বা ঢাকায় চলে আসেন। দাদিকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে চাইলে উনি বললেন, আমি আমার স্বামীর ভিটে ছেড়ে কোথাও যাব না।
পরের বছর আমি অষ্টম শ্রেণীতে উঠলাম। এদিকে সহিদ ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতেই ছিল। আম্মা চিঠি দিয়ে ঢাকায় ডেকে পাঠায়। আল্লাহপাকের ইচ্ছা অন্য রকম। তাই সহিদ যেদিন ঢাকায় আসবে বলে ঠিক করেছিল, তার আগের দিন। রাত্রে হঠাৎ কলেরা হয়ে মারা যায়। ট্রাংকলে খবর পেয়ে আব্বা আমাদের সবাইকে নিয়ে সিলেটে যান। আম্মার সেকি কান্না। সকলের কান্না দেখে আমিও কেঁদেছিলাম। আব্বা আমাদের রেখে পরের দিন প্লেনে ঢাকায় চলে আসেন। কারণ তখন তার একটা মাডার কেসের হিয়ারিং চলছিল। সহিদের কুলখানি হয়ে যাওয়ার পর যে দিন আমরা ঢাকায় চলে আসব, সেদিন আম্মাকে দাদির সঙ্গে কথা বলছে। দেখে আমি দরজার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালাম। শুনতে পেলাম আম্মা দাদিকে বলছে, আমি সহিদের ভাই জহিরের সঙ্গে আবার খুকীর বিয়ে দেব। দাদি বললেন, সে দেখা যাবে। এব্যাপারে কোনো কথা এখন উচ্চারণ কর না। ঢাকায় আসার সময় আম্মা দাদিকে বলল, জহিরকে মাঝে মাঝে আমাদের কাছে পাঠাবেন। দাদি কোনো কথা বলেন নি। এরপর আমি আর দেশের বাড়িতে যাইনি,। আব্বা বোধ হয় কিছু বুঝতে পেরেছিলেন, তাই আম্মা যখন দাদির কাছে দেশের বাড়ি যেত তখন আমাকে যেতে দিতেন না। আব্বা আমাকে বেশি ভাল বাসতেন। চিঠি খুব বড় হয়ে যাচ্ছে; কিন্তু সব কথা না জানিয়েও শান্তি পাচ্ছি না। সে জন্য মাফ চাইছি।
অষ্টম শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা যেদিন শেষ হল, সেদিন আমরা ভাড়া বাসা ছেড়ে আমাদের এই নতুন বাড়িতে আসি। কয়েকদিন পর জহির ভাই আমাদের বাড়ি বেড়াতে আসে। রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর সবাই ঘুমাতে গেল। আমি প্রতি দিনের মতো আব্বার চেম্বারে তার পাশের চেয়ারে বসলাম। একটা কেসের ব্যাপারে উনি খুব ব্যস্ত ছিলেন, তাই আমার সঙ্গে কোনো কথা বলেন নি। আমি চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়ি। আব্বার ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যেতে নিজের রুমে গিয়ে ঘুমাই। তখন গ্রীষ্মকাল। অনেক রাত্রে কার গরম নিশ্বাস মুখের উপর পড়তে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখলাম, কে যেন আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছে। প্রথমে আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। মাথার কাছে বেড সুইচ টিপে আলো জ্বালতে দেখি, জহির ভাই। ততক্ষণে সে খাটের উপর আমার পাশে বসেছে। আমিও উঠে বসে বললাম, জহির ভাই, তুমি এত রাতে এখানে কেন?
সে আমার কথার উত্তর না দিয়ে বলল, আলো নিভিয়ে দাও।
আমি বললাম না, তুমি আগে চলে যাও।
জহির ভাই বলল, আমি কেন এসেছি, তুমি কি বোঝনি?
আমি কিছু বুঝতে না পেরে বললাম, তুমি কি বলতে চাইছ? (কারণ সেক্স সমন্ধে আমার তখনও কোনো জ্ঞান হয়নি।)
সে তখন নিজে আলো নিভিয়ে দিয়ে বলল, তোমার সঙ্গে তো কিছু দিন পরে আমার বিয়ে হবে। তাই একটু আনন্দ করতে এসেছি। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরতে এল। আমি তখন খাট থেকে নেমে ছুটে বেরিয়ে গিয়ে আম্মার দরজায় ধাক্কা দিতে থাকি। প্রথমে আব্বা দরজা খুলে আমাকে দেখে বললেন, কি হয়েছে মা? তুই অমন করসি কেন? ততক্ষণে আম্মাও বেরিয়ে এসেছে। আমি বললাম, আপনার কাছ থেকে এসে ঘুমের ঘোরে দরজা না লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। তারপর যা ঘটেছিল সব কথা বললাম।
আম্মা আমার ঘর থেকে জহির ভাইকে ডেকে এনে তার ঘরে পৌঁছে দিয়ে এসে আমাকে বলল, তুমি দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়।
পরের দিন ভোরে এক টুকরো কাগজে, আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি এই কথা লিখে রেখে জহির ভাই চলে যায়। এরপর প্রায় দু বছর পর্যন্ত তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। আব্বা মারা যাওয়ার পর তার কুলখানির সময় আমরা সকলে দেশের বাড়িতে যাই। সেই সময় দাদি জহির ভাই এর সঙ্গে বিয়ের কথা বলে আমার মতামত জানতে চান। বিয়ের কথা শুনে ধক করে মনের পর্দায় আপনার ছবি ভেসে উঠে। বললাম, আমি কলেজে পড়ব, এখন বিয়ে করব না। তার সঙ্গে বিয়ে দিলে বিষ খেয়ে মরব। সেই বছর আমি ম্যাট্রিক পাশ করি।
ওখানে গিয়ে জুহির ভাইয়ের নারী ঘটিত কুকীর্তির কথা অনেক শুনলাম। বড় মামার শুধু দুই ছেলে। সহিদ মারা যাওয়ার পর জহির ভাই আদর পেয়ে চরিত্রহীন হয়ে পড়ে। সেইজন্য বড় মামা তাড়াতাড়ি আমার সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়ার জন্য আম্মাকে বলেন। দাদির কাছ থেকে আমার অমতের কথা শুনে আম্মা রেগে গিয়ে আমাকে প্রথমে খুব বকাবকি করে। পরে বুঝিয়ে বলে, জহির বাপ-মার এক ছেলে। ওদের অনেক সম্পত্তি, সবই তোর হবে। তাছাড়া অন্য ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে হলে সে কি আর আমাদেরকে জহিরের মত দেখাশুনা করবে? আমি বললাম, এখন আমি বিয়ে করব না। দরকার হলে চিরকুমারী থেকে চাকরি করে তোমাদের দেখাশুনা করব। তখন পর্যন্ত ব্যাংকের টাকা ও উইলের কথা জানতাম না। মাত্র মাস খানেক আগে মেজ মামার কাছ থেকে জেনেছি। আর যদি তোমরা আমাকে জোর করে বিয়ে দাও তবে তার পরিণতির জন্য তোমরাই দায়ী হবে। দাদি আম্মাকে বললেন, ওকে এখন বিয়ে করার জন্য বেশি চাপ দিও না। তদিরে থাকলে একাজ হবে। তারপর আমরা ঢাকার বাড়িতে চলে আসি। সেই থেকে আম্মা জহির ভাইকে বিয়ে করার জন্য মাঝে মাঝে আমাকে বোঝাত। কিন্ত ইদানিং আপনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হতে দেখে তাকে বিয়ে করার জন্য খুব বেশি চাপ দিচ্ছে। আমিও স্পষ্ট বলে দিয়েছি, বেশি চাপা চাপি করলে আত্মহত্যা করব।
আমাদের চারতলা বাড়ির উপরের তলা ছাড়া সব ভাড়া দেওয়া আছে। আব্বা নিজে গাড়ি চালাতেন। তিনিই আমাকে ড্রাইভিং শিখিয়েছেন। তিনি মারা যাওয়ার পর বড় মামা তার এক গরিব আত্মীয়কে অর্থাৎ এই দাদুকে ঠিক করে দেন। উনি খুব ভালো লোক। আমাদের সংসারের যাবতীয় কাজ দেখাশোনা করেন। আপনার সঙ্গে মেলামেশা করি বলে আপনার উপর খুব রাগ। তবে তা কোনোদিন প্রকাশ করেন না। শুধু একদিন বলেছিলেন, খুকি ভাই, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, এত রাজপুত্র থাকতে তুমি একজন দোকানের কর্মচারীর পিছনে ছুটছ কেন?
আমি বলেছিলাম, আপনি যাদের রাজপুত্র বলে জানেন, তাদের চেয়ে দোকানের ঐ সামান্য কর্মচারী চরিত্রের দিক দিয়ে অসামান্য। রাজপুত্ররা প্রায় সবাই চরিত্রহীন। তারা নারীকে প্রেম দিতে জানে না। জানে শুধু অত্যাচার করে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে। নারীকে তারা ভোগের সামগ্রী মনে করে।
তারপর থেকে আপনার বিষয়ে আর কোনো দিন কোনো কথা বলেন নি। লেখায় অনেক ভুল-ত্রুটি হয়েছে। সে জন্য ক্ষমা চাইছি। আল্লাহপাকের দরবারে আপনাদের সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করে শেষ করছি।
ইতি
হতভাগী সেলিনা
৩. চিঠিটা পড়ার পর পুড়িয়ে ফেললাম
চিঠিটা পড়ার পর পুড়িয়ে ফেললাম। চিন্তা করলাম, তাকে যদি বিয়ে না করি, তাহলে যে রকম জেদী মেয়ে, হয়তো সত্যি সতিই কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে। আর সে জন্য আমিই দায়ী হব। তাই ঠিক করলাম তাকে বিয়ে করার ব্যাপারে কতকগুলো কঠিন শর্ত আরোপ করে আর একটা পত্র দিয়ে শেষ পরীক্ষা করব। যদি সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তবে তাকে বিয়ে করতে রাজি হব। তাতে আমার তকদিরে যা হয় তোক। যদিও মনে হয়েছিল, যত কঠিন পরীক্ষা করি না কেন, পাশ সে করবেই; তবু খেয়ালের বশবর্তী হয়ে লিখলাম