তারপর এশার নামায পড়ে বাসায় ফিরি।
.
দোকানে কয়েকদিন ধরে অবসর সময়ে সেলিনাকে একটা চিঠি লিখলাম— সেলিনা,
এই চিঠি পড়ে তুমি যদি আমাকে ঘৃণা করে ও কাপুরুষ ভেবে তোমার মন থেকে দূরে সরিয়ে দাও, তাহলে আমি অত্যন্ত খুশী হয়ে আল্লাহপাকের দরবারে শুকরিয়া আদায় করব। অনেক চিন্তা করে দেখেছি, তোমাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। আমার স্ত্রীর ভালবাসাকে অপমান করে তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। তোমাকে বিয়ে করলে আমি, আমার স্ত্রী ও তুমি, তিনজনেই সারাজীবন অশান্তির আগুনে জ্বলব। মেয়ে হয়ে তুমি নিশ্চয় জান, মেয়েরা সবকিছু। দিতে পারে; কিন্তু স্বামীর ভাগ কিছুতেই দিতে চায় না। তাছাড়া এই বিয়ে হলে তোমার সব গার্জেন তোমার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। বিয়ের প্র হয়তো তোমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে। তুমিই বল, তোমাকে তখন আমি রাখব কোথায়? নিজের বাসাতে নিয়ে আসা সম্ভব নয়; আর বাসা ভাড়া করে অন্য জায়গায় রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হলেও আমি তা পারব না। এই কয়েকদিনের মধ্যে বুঝেছি তুমি বড় একরোখা। যা মনে আসে তাই কর। একরোখা স্বভাবটা ভাল, তবে সবক্ষেত্রে নয়। তোমার বয়স কম, দুনিয়াদারীর অভিজ্ঞতাও কম। সংসার এমন জটিল জায়গা যে, সেখানে সব ক্ষেত্রে একরোখা ভাবে চললে বহু ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। যা সারাজীবনেও পুরণ করা যায় না। আমি স্বীকার করছি, তুমি নিষ্কলুসভাবে আমাকে ভালবাস। তাই বলে আমাকে বিয়ে করতে হবে এমন কথা ভাবছ কেন? অন্য যে কোনো সম্পর্কে আমরা আবদ্ধ হতে পারি। তুমি ধনী ঘরের মেয়ে। তোমার চাল-চলন, খাওয়া-দাওয়া, পোষাক-পরিচ্ছদ সবকিছু আমাদের সঙ্গে আকাশ পাতাল তফাৎ। তুমি লেখাপড়া করেছ, তোমার একরোখা ভাবটা দূরে সরিয়ে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে চিন্তা করে দেখ, আমি তোমার ভাল চাই, না মন্দ চাই? যদি জানতে চাও আমি তোমাকে ভালবাসি কি-না? তার উত্তরে বলব, তোমার মত মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি। উপন্যাসের নায়িকাদেরকেও তুমি হার মানিয়েছ।
বিয়ের আগে কোনো মেয়েকে ভালবাসার সৌভাগ্য আমার হয়নি। বিয়ের পর, নিজের স্ত্রীকে মনে প্রাণে ভালবেসেছি। কিন্তু এই কয়েকদিনের মধ্যে তুমিও আমার অন্তরে কিছুটা জায়গা দখল করে নিয়েছ। এটা হয়তো নিয়তির একটা নির্মম পরিহাস। তোমাকে কিছুটা ভালবেসে ফেলেছি বলে আন্তরিকভাবে তোমার ভালো চাই। আমার সঙ্গে তোমাকে জড়ালে আমার ভালবাসাকে বিষপান করান হবে। তাই তোমাকে সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে। ভালবাসার খাতিরে তোমার কিসে ভালো হবে আমি যেমন চিন্তা করছি, তুমিও তো আমাকে ভালবেসেছ, তোমারও কী চিন্তা করা উচিত না, কিসে আমার ভালো হবে? এই সমস্ত কারণে তোমাকে তোমার একগুয়েমী জিদ ছাড়তে হবে। জানি, তুমি এই চিঠি পড়ে কাঁদবে, তবু লিখলাম। ফারণ না লিখে আমার আর কোনো উপায় নেই। সবশেষে আর একটা কথা বলি, আমাকে যদি তুমি সত্যিই ভালবেসে থাক, তবে যা মনে আসে তা করো, কিন্তু আত্মঘাতিনী হয়ো না। এটা তোমার প্রেমের কসম। কেন না যারা আত্মহত্যা করে, তারা চির জাহান্নামী। আমি চাই না, আমার কারণে তুমি আত্মঘাতী হও।
আশা করি, চিঠিটা ধৈৰ্য্য ধরে পড়ে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে আমাকে ভুলে যেতে চেষ্টা করবে এবং আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেবে।
ইতি—
চিঠিটা শেষ করে দোকানে আমার নিজস্ব ড্রয়ারে চাবি দিয়ে রাখলাম। প্রায় দশ বার দিন পর একদিন আমি জোহরের নামায পড়ার জন্য মার্কেটের ভিতরের মসজিদে যাওয়ার পথে সেলিনাদের ড্রাইভারের সাথে দেখা। সে আমাকে একটা ছোট কাগজ দিয়ে বলল, খুকীভাই গেটের বাঁ দিকে গাড়িতে বসে আছে। কথা শেষ করে ড্রাইভার চলে গেল। আমি কাগজটা পকেটে রেখে অযু করে নামায পড়লাম। তারপর মসজিদ থেকে বের হয়ে কাগজটা পড়লাম
সালামান্তে আপনার কাছে আরজ, এক্ষুনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন।
ইতি–
আপনার সেলিনা
দোকানে এসে ড্রয়ার থেকে চিঠিটা নিয়ে গাড়ির কাছে গিয়ে সালাম বিনিময়। করলাম তারপর চিঠিটা সেলিনার হাতে দিয়ে বললাম, সোজা বাড়ি চলে যাও।
আমাকে দেখে তার চোখে মুখে আনন্দের ঢেউ উঠেছিল; কিন্তু আমার কথা শুনে তা ম্লান হয়ে গেল। তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমি দোকানে। ফিরে আসি।
এরপর প্রায় এক মাস সেলিনা আমার সঙ্গে দেখা করেনি। তাতে করে মনটা বেশ হালকা হয়ে এল। ভাবলাম, চিঠিটা পড়ে হয়তো আমাকে কাপুরুষ ভেবে ভুলে যেতে চেষ্টা করছে।
সাহেবদের গাড়ি খারাপ থাকায় স্কুটারে করে তীতুমীর কলেজে একদিন বেলা দশটার সময় বই সাপ্লাইয়ের বিল আদায় করার জন্য যাচ্ছিলাম। মহাখালির রেল ক্রসিং পার হওয়ার আগে ট্রেন আসছিল বলে গেট বন্ধ ছিল। থামার সময় স্কুটারের স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। গেট খুলে যাওয়ার পর আর স্টার্ট নিল না। তখন ড্রাইভার একটা রিকশা ঠিক করে দিল। রিকশা যখন মহাখালির দিকে বাঁক নেবে, ঠিক সেই সময় একটা প্রাইভেট কারকে আমার রিকশার দিকে দ্রুত আসতে দেখে খুব ভয় পেলাম। মনে হয়েছিল ভীষণ এ্যাকসিডেন্ট হবে। কিন্তু যখন গাড়িটা নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়িয়ে গেল তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। তবু ড্রাইভারের উপর খুব রাগ হওয়ায় তাকিয়ে দেখি, সেলিনাদের গাড়ি। পিছনের সীট থেকে সে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।