পাণ্ডাঠাকুর ব্রাহ্মণ স্বভাবসিদ্ধ অনুদ্বিগ্ন শান্ত, যেমত যে, আৰ্ত্ত সহিত আলাপনের স্বরক্রমে কহিলেন–তাহা হইল, তবে, কিন্তু।
ইহাতেই যে মনিব মহাশয় কিয়ৎ আত্মস্থ থাকেন, কেন না দিবালোককে মিথ্যা প্রতিপন্ন করিতে তিনি চাহেন নাই; তিনি ধর্ম্মশীল, একদা আপন জায়ার প্রতি, যিনি অযুত শ্ৰীসম্পন্না ভক্তিমতী অধুনা মালাজপকারিণী যিনি পূজারিণী, তৎপ্রতি অবলোকনিয়াই উত্তম শুভবুদ্ধিচালিত উত্তর দিলেন–হে ঠাকুর মহাশয়, মকৃত ধৃষ্টতা মার্জনা করিবেন, ইহা সত্য বটে, যে এই হতভাগ্যের ছায়া পর্যন্ত স্পর্শনে অশাস্ত্রীয়, যে উহার জল চলে না, তথাপি, যদিও মাদৃশ জনের আমূল পরিচয় আপনাদের নখদর্পণে, আমি বলি, আমি গৌড়ীয় সর্বোৎকৃষ্ট শ্রেণীর ব্রাহ্মণ, বাঙলার সর্বশ্রেষ্ঠ সম্ভ্রান্ত প্রাচীন বংশ আমাদের, সেবাব্রত থাকা সত্ত্বে বহুজনকে অন্নদান করিয়া থাকি, (আমি প্রভূত বিত্তশালী ঠাকুরের কৃপায় হইয়াও) ত্রিসন্ধ্যা গায়ত্রী জপ করি, মানুন, আমি ত বটেই, ও মদীয় ভাৰ্য্যা ইনি উচ্চ অভিজাত বংশসস্তৃতা, ইনি সত্ত্বগুণবিশিষ্টা বহু বহু জন্মের তপস্যা দেবারাধনাজনিত সুকৃতি নিবন্ধন ইহজন্মে মা জননীর রাঙাচরণ আশ্রয় লাভ করেন, ইনি মা জননীর শ্রীশ্রীমায়ের (শ্রীশ্রীসারদা দেবী) মন্ত্রশিষ্যা, ইনিও ঐ অধম দীনতম বেচারীকে অভাবনীয় স্নেহ করেন খুব স্বাভাবিকভাবেই তাহা ছাড়া ভগবান রামকৃষ্ণ আমাদিগের সন্দেহ অজ্ঞানতা বিদূরিত করিয়াছেন যে, যথা–সব্রাহ্মণ, যার কোন কামনা নেই, সে হাড়ীর বাড়ীর সিধে নিতে পারে। আবার বলিয়াছেন যে, কৃষ্ণকিশোর অত বড় আচারী ব্রাহ্মণ কোন হীন জাতিকে তিনবার। শিব শিব বলাইয়া হৃষ্টচিত্তে উহার হাতে জলপান করেন। তাই আমাদিগের সবই জল-চল, অবশ্য। বিদেশ বলিয়া নহে, যাহা হউক সুঘরাই আমাদের সহিত চলুক, বালক কখনও শহরে আসে নাই, গাড়ীও নাই, শেষে কোথায় কি ঘটিবে, অনেক জন্মের পুণ্য অর্জনে অদ্য সে এখানে দেবস্থানে, আর যে মদীয় পত্নীর কল্যাণে ধৰ্ম্ম ধারণা উহাতে আছে জানি, উহাকে এখন বিফলমনোরথ হইতে দিবেন না; ঠাকুর মহাশয় দেখুন দেখুন উহারে দেখিতে নবীন কদলী কাণ্ডের ন্যায়, তেমনই মনোলাভা তেমনই নিষ্পাপ, সে কাহাকেও তিলমাত্র স্পর্শ করিবে না, এখন আজ্ঞা করুন।
এবং যে তদ্বিধ প্রসঙ্গ পাণ্ডাঠাকুর মহাশয় শুনিতে তদীয় ললাটস্থ হোমজাত রম্য শৈবতিলক দেদীপ্যমান হইল, হর হর মহাদেব বলিয়া আদেশ দিলেন–ভগবান শঙ্কর গৌরবমণ্ডিত হউন, বাবা বৈদ্যনাথের নামে ইহা হউক, বেশ, বাবার দুয়ার অবধি যাইতে পারে! ইহাতে মনিব মহাশয় উৎফুল্ল হওয়ত বাবা বৈদ্যনাথের জয়ধ্বনি করিলেন।
এতাদৃশ অনুমোদনে এবং জয়ধ্বনিতে সুঘরাই, আহ্লাদে তাহার মনে পড়িল, যে সে পদ্ম দেখিয়াছে, অথচ বন্য, সে গাত্রের গেঞ্জী খুলিয়া তখনই পরিতে চাহিল, পঞ্চতীর্থবারিতে সে শুদ্ধ, তাহার তৈলসিক্ত মস্তকে পূত নিৰ্মাল্য আছে; ক্রমে তাহারা সকলেই এক অভূতপূৰ্ব্ব মৰ্ম্মস্থলের নিকট, আর্ট যেখানে প্রকৃতিকে প্রভাবিত করিয়াছে। যে সে এখন প্রাকৃতজনের চরম মনীষাদায়িকা শিবমন্দিরের দুয়ার সমীপস্থ আছে, যে সে ঐ পুনর্জন্মক্ষয়কারী শিবপুরীর প্রাচীরে, এই প্রথম বিবেক তাহাতে, আর যে সে বিবেকনিয়ন্ত্রিত, অনেক অনেকবার মাথা ঠুকিতেছিল; নানা মানুষের শ্লোকরাজি নানান প্রার্থনা, যথা ভগবান ইহার সুমতি দাও, ভগবান শঙ্কর অন্তিমে তোমার দর্শন পাই, তোমার শরণার্থী হে বৈদ্যনাথ।
তদীয় কানে আসে অথচ সে অন্ধকার দিয়া ডাকিতে চাহিল এবং যখন আপনকার বক্ষঃদেশে এ মন্দির ছবি মুদ্রিত হউক এরূপ কামনায়ে যে সে আপন গেঞ্জী খুলিতে যাইবে, হরি হরি যে তৎক্ষণাৎই তাহার কাল হইল, দুর্ভাগ্য উপস্থিত!
ঐ সময়েতে, অশ্রুতপূৰ্ব্ব গোল ধিকিয়া দাবদাহ, ক্রমে, বিকট জিগীর গর্জিল; যে সে, সুঘরাই, গেঞ্জী তুলিয়া অস্পন্দ, তাহার মনে উপজায় যে কাছেই নিশ্চয় কোথাও লক্কড় আক্রমণ করিয়াছে; নিমেষেই এহেন অপ্রশস্ত সঙ্কীর্ণ গলিতে এক দারুণ সঙ্কটজনক অবস্থা ঘটিয়া উঠিল, অগণন নিরীহ তসর গরদ মটকা কেটে রেশম পট্টবস্ত্রশোভিতা রমণীগণ চকিত হইলেন, বাঁশুলী নয়ন কালীঘাট হইল, ইহারা সকলে সঙক্ষুব্ধ, নথ দুলিল, কর্ণভূষণ ব্যতিব্যস্ত, কঙ্কন বাজিল, গললগ্নীকৃতবাস শিথিলীকৃত, চোখে চোখে বিভ্রান্ত বিদ্যুৎ, পূজাউপচারসকল হস্তচ্যুৎ হওনে অবোদেশে মাটিতে, পাত্ৰভ্রষ্ট কর্পূর ভূমিতে জ্বলিতেছে, ধূপ যেখানে সেখানে, ফল গড়াইতেছে, দুগ্ধ পড়িয়াছে, ফুল ও মালা সমুদায় নয়ছয়, কচি বিশ্বদল ছত্রাকার, কতক কুৎসিতদর্শন পা ঐ সকল সৌন্দৰ্য্য মর্দন করিতে থাকিয়া আইসে; ইহারা হরিজন! ইহাদের প্রত্যক্ষে শুদ্ধাচারী পুরুষগণ যাঁহারা কেহ মহামহিঃস্তব, অন্য কেহ নিৰ্বাণঘটক, কেহ কৌপীনপঞ্চক, কেহ শিবস্তোত্র আবৃত্তি রুদ্ধ করিয়াছেন, কেন না অহিতকারীরা ভীমনাদে চীৎকার পাড়িতে লাগিল।
সুঘরাই যেমত হতচেতন, সে বিস্ফারিত নয়নে হেরিল, কীদৃশী ভয়ঙ্কর মদমত্ততা! এক সঙ্গে এতেক নোংরা আকৃতি সুঘরাই কদাচ দেখে নাই, প্রতিজনের মুখমণ্ডল বিশেষত কণ্ঠলগ্না মাল্যে অধিক জঘন্যদর্শন হইয়াছে, ইহারা যাহারা শাস্তির ভয় পায় অথচ কভু জিহ্বা দংশন করে না, ইহারা তাহারা ভক্তি যাহাদের বক্ষ হইতে তের নদী পার; ইহাদের বেচারীদের পরনে ঠেটি, কণ্ঠে জবা কুসুমাদি মাল্য, ইহারা বহু যুগ অভুক্ত, ইহাদের কাহারও কাগজ নাই, উহাদিগের গাত্রগন্ধ উৎকট যেন মহুয়ার খৈল পোড়া গন্ধ, উহারা অস্নাত, উহারা যাহারা সন্ধ্যায় স্থির হয় না, তাহারা মন্দিরে প্রবেশ করিতে উদ্যত, বহু শতকের ভীতিতে এখন তাহারা বিষধরজ্ঞানরহিত।