তাহারা চরিত্রকে ছাড়াইতে পারে নাই, মানুষ কি আলেখ নেশা! ঐ গীতে এই সকল কিছু–যেই কেন উহা ঐ গীত হউক, যে চাঁদ অস্থির হইবেক; ঐ গীতের দিকেই সে বেচারী সুঘরাই আছে, তাহার পোষ মানা ভয় আছে, তাহার ঘর যে এবং, এখন এই ভাবনা প্রভাবিত হইয়া সে সুঘরাই অধিক হতাশায়ে সজল নেত্রে উত্তরের আকাশের ঠিক লইল, যে কেমনে সে যে বাড়ী ফিরিবে; এখানকার এই শহরের সমস্ত বস্তুই, ও যাহা যাহা কল্পনাসাপেক্ষ, শ্বাসরুদ্ধকারী বিরাট অহরহ, ভিখারী কুষ্ঠরোগীর ক্ষতে ক্ষিপ্ত কুকুরের মাড়ি দেখা যায়, প্রতি কিছুই করাল উত্তঙ্গ প্রাচীর; রিখিয়া চার ঘুমের পথ, হাটবারে ছাড়া চিঠি বিলি-না-হওয়ার দূরত্ব বৰ্ত্তাইয়াছে; সুঘরাই মাটির উপর চলিতে চাহিতেছিল, যে মাটিতে জেংগীল পাখী বসে, ডাকে; পায়ের তলায়ে সে চাহিয়াছিল মাটি, শহরে যাহা মাথার উপর; এ। শহরে মাথা ঠুকিয়া কান্দিবার সুযোগ নাই; হাস্য অনুমোদিত অথচ।
হঠাৎ এই বৈলক্ষণ্যের সময়েতে তাহার কানে গেল, কোন শুদ্ধাচারী বলিতেছে, যত শালার ঘোট জাতের মরণ, ছুঁইও না ছুঁইও না! তৎক্ষণাৎই সরিয়া দাঁড়াইবার মতন জন্মগত সৎ স্বাভাবিকতা তাহাতে কাজ করে নাই; যে যাহা, যদি সে বৃক্ষশীর্ষে থাকাকালীন অমন তাড়না শুনে, তবে ঝটিতিই সে মান্য করিতে উদ্যত হইতই; কিন্তু এখানে তাজ্জব এই, অচিরাৎ বেশ তিলেক পরেই, উক্ত তাড়না নিমিত্ত, দেখা গেল যে সে কান নাক মলিতেছে আর ছুটে। সে জানিতে চাহে না ঐ তাড়না কাহার উদ্দেশে, অবশেষে এবং যে সে বেসামাল, এবং সে পতিত। তদবস্থ সে পশ্চাতের পানে ত্রাসযুক্তলোচনে ও তৎক্ষণাৎ খুসীতে বারবারই নজর লইয়া থাকে।
আসলে, অপ্রাকৃতিক ভয় যে কি কারণে, খুসী যে কি জন্য, তদ্বিষয়ে ভ্রু কুঞ্চন এমনও যে ঘটে নাই, যেহেতু অদ্ভুত ঘোরে, রন্ধ্রগত সে ছিল, তাই যে সে খালি প্রতি পদক্ষেপেই বলিতেছিল—শাঁলো হারামজাদা চামার মোহিলি মানুষের জুতা হইতেও জাতিতে নীচু, তোমার জন্যই অদ্য আমার এই দুর্দৈব! ক্রমে এইরূপে সে নিজেরেও হতভাগ্য নরকের কীট কহে, নিজেকে অভিসম্পাতে নিপীড়নে। অবিরাম হেয় করিয়াছে। সে এইভাবে কোথাও দাঁড়াইতে চাহিতেছিল কেন না অনবরত সুঘরাই এর মনে হয় সে যেন বা মিলাইয়া যাইতেছে।
নিশ্চয়ই মোহিলির খবর বিভীষিকা হইয়া তাহারে আঁচড়াইতেছিল। যাহা যে শেষরাতে যখন বৃক্ষাদিও ঘুমায় তখন শিব নন্দীভৃঙ্গীসহ শিবগঙ্গায় স্নানে আসেন, যদিস্যাৎ কেহ তাহা দেখে সে। কামারের চুল্লীর স্ফুলিঙ্গের মত নস্যাৎ হয়। ইহা মোহিলি দারুণ অঙ্গভঙ্গীকরত ব্যাখ্যা করে, ফলে সুঘরাই দেখে সমস্ত প্রকৃতি পর্যন্ত ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, শুধু সে জাগিয়া আছে।
উপস্থিত-মোহিলিসুত্রে তাহার সমক্ষে অনেক কিছু আভাসিত হইল, যাহা যথা–মোহিলি গাড়ীর মুখ ফিরাইতে তখন হন্তদন্ত, আর যে সুঘরাই দণ্ডায়মান মনিবের জুতা জোড়া বুকে ধারণ করিয়া আছে–কেন না দেবদর্শন যাত্রায়, তীর্থে, উহা নিষিদ্ধ–এখন অপ্রত্যাশিত রোমাঞ্চিত বিধায় অসাবধানে একটি জুতা মাটিতে, অবশ্য সে তখনই তাহা কুড়াইয়াছে, কিন্তু এই কৰ্ত্তব্যবোধের মধ্যেও সে বিচাল্যমান ঈষৎ হইয়াছে; যে মোহিলির প্রত্যাখ্যানের নির্দিষ্ট মুহূৰ্ত্ত হইতে আপনারে মারাত্মক নিঃসঙ্গ বলি তাহার বোধ হয়; যদ্যপি সে হয় ডোেম, তৎসত্ত্বেও মোহিলি অনন্য থৈ আছিল।
এমত ঠিক যে সে নিঃসঙ্কোচে অনায়াসে মোহিলির হাত ধরিতে পারিত কোন কিছু ঔৎসুক্যে, কোন কৌতুকাবহতে, বিশেষত কিছুর নাম মাত্র আতঙ্কে, যাহা সে আর পারিবে না; সুঘরাই ইহা লইয়া পৰ্য্যালোচনা হয়ত নির্ঘাত করিয়া থাকে, যে এই শহরে কাহারই বা সে হাত ধরিবেক, মনিব মহাশয়ের শত আতঙ্কেও না, যদিও মনিব মহাশয় ও তদীয় পত্নী অপ্রার্থিত হৃদয়বান সমস্তরূপে, সৰ্ব্বদা যত্নও করেন, তাহারে গেঞ্জী কাপড় সবই দিয়াছেন, তাহার নিমিত্ত সুঁইওয়ালাদের নগদ চার আনা পয়সা পান। খাইতে দিয়াছেন।
আশ্চৰ্য কতটুকু সময়ের মধ্যে যে সে নিখোঁজ হয়, এ কারণ যে সে জাতি ঘৃণ্য; যে অপিচ মনিব মহাশয় তাহারে যারপরনাই আড়াল করিতে প্রয়াসী হইয়াছিলেন, কিন্তু পাণ্ডা ঠাকুর মহাশয় জিজ্ঞাসিলেন–সে নেয়া কি জাত ছিকোরে তোরা।
ইত্যাকার সুমিষ্ট ভাষণ, অতীব শীল যাহা, তাহাতে সুঘরাই তুষ্ট; পাণ্ডাঠাকুর মহাশয়ের যথারীতি সম্বোধনে ইহা পরিষ্কার যে, তাহাকে বুনো, তাহাকে ডোম জাতীয় মনে হয় না, যেহেতু তাহার মাথায় অনেক তৈল, যে জন্মাবধি সে চিনি খায়, সে ডালিম কি জানে, বেশ সোহাগের চেহারা বটে তাহার।
তবে, এই ধরনের প্রথমকার আবেগ কাটিতেই সুঘরাই বানচাল, যেহেতু যে এবং বহুবারই সে অগ্নি পোহাইয়াছে, সুমহৎ শিখা তাই এখন তাহার সমক্ষে, তাই তদীয় স্বল্পায়তনের দেহ শতছিদ্র, স্বেদোদগমে গেঞ্জী পরিপ্লত,–এই স্বীকারে সে বাধ্য–যে সে হয় ডোম এই অপরাধ স্বীকারেই; কিন্তু, সম্ভবত ঐ সঙ্গে যেমন ইহাও যে, যাহার জন্য সে বেচারী দায়িক না, এবং যে সে বা তাহারা ও মহুয়া গাছ একই; কিন্তু তদ্ব্যতিরেকেও, তথাপি উহার সুঠাম অনার্য মুখশ্রী আরক্তিম কষায়িত ইত্যাকার মনোভাব তাহার পক্ষে অবিশ্বাসের।
এমনও যে কোন এক সত্য–অসাধনেই তাহার মস্তকে ঘোর করে, যে নানারূপ অদ্ভুতদর্শন যন্ত্রের, টিনকাটা চ্যরনার, বিটার ইত্যাদির পাশেই অনেক নানান আকারের চমকপ্রদ লেবেল আঁটা টিন, কোনটিতে কোনটিতে মাছের ছবি, হৃষ্টপুষ্ট শাদা শুয়ারের, কোথাও গরুর! কতবার না এইসব টিন সে মহা উৎসাহে সাজাইয়াছে, মনিবপত্নীর আজ্ঞায় কাটিয়াছে। এই ব্যাপারে এইজন্যই যে হয়ত বৈষম্য তাহাকে এতদূর ভয়ঙ্কর করে।