এবার এটমাইজারের শব্দ সহিত মাধব নাম উচ্চারণ করিতেছিলেন, কিছু বাদে মনিব মহাশয়ের ধীর আক্ষেপ শ্রুত হইল,…আমি ঐ ঘর হইতে সবই শুনিতেছিলাম, বুঝিয়া পাই না মধু ও রিলিকে এ খবর দিবার কি…অবশ্য সামান্য পাখীর পিছনে এ কথা থাকিবে তা তুমি বা কি করিয়া জানিবে…..মাধব তারা ব্রহ্মময়ী!
তন্দ্রাচ্ছন্ন মনিবপত্নী কহিলেন–আমি ভেবেছিলুম ছোঁড়া জঙ্গলের গল্পই বলে থামবে’খন! অতঃপর বলিয়াছিলেন, আ মোহিনী মায়া!
ক্রমে যে, পাখীর ব্যাপার সুঘরাইএর শুধুমাত্র অন্যমনা হওয়ার কারণ হইয়াছিল, সে এক কালো-র দিকে চাহিত, এক অচৈতন্যতার দিকে চাহিত; বৈদ্যনাথধামে আসিবার সুযোগে মন্দির দেখা ও বিবিধ অনুষ্ঠান প্রতি আগ্রহ ছাড়াও ইহা–এই মনোভার হাতে প্রচ্ছন্ন ছিল।
তাহা এই যে বহু পুরাতন সাধনলব্ধ আধ্যাত্মিকতাকে জড় তত্ত্বের উপর–যদিও যাহা এখনও বিস্ময়ের এবং আপাতত তাহা ভীতির–তাহার উপরই আবোরাপ করিতে পারিবে; যেমন শিল্প ধৰ্ম সরলতা প্রকৃতিতে আরোপিত হয়।
ভক্তিপ্লুত ভগবদারাধনায়ে তীর্থযাত্রার মধ্যে অনতিদূরস্থ ঐ বৈরাগ্যজননী অমৃতবর্ষী শহরবিষয়ক যে ধারণা তাহাতে, সুঘরাইতে, উথলিত ছিল, উহাই অধুনা অসহ্য ফোটকে পরিণত হইল; এখন যে মনিবরা নাই, আসমুদ্রহিমাচলখ্যাত মন্দিরের শীর্ষ দেখার মানসিকতা অবলম্বনহীন অব্যক্ত গোঙানি হইয়াছে; যে এবং সম্মুখের গোটা শহরই রিখিয়ার যে-সিজিনের বাড়ীর তুল্য ফাঁকা, যেখানে তাহার কণ্ঠস্বরের হরেক প্রতিধ্বনি হয়, এখানেও তেমনই হইতেও পারে।
অন্যদিকে মোহিলি ধাবনৌৎসুক্যে দড়বড়ি গরুগুলি ঘুরাইতেছিল এখন, তৎকালে সুঘরাই উহারে, মহাজন এরূপ, তাহার নাড়ী অর্থ, নির্ঞ্ঝাট আশ্রয় যথা, আত্মিক পারিবারিক কেহ ঈদৃশী সমঝে আছে; অথচ যুগপৎ সে নিজে এমত কোন প্রদেশে, যেখানে মৃত্তিকার জঠর নাই, বুদ্বুদের অন্তঃস্থল দিয়া কোন আহ্বান ভেদ করিতে অকেজো, সে বড়ই একা, ল্যাংট, তাহার ভয়ও তাহাকে ত্যাগ করিয়াছে।
এবং মনিব বলিতেছিলেন–আজব বুনো, জংলী!
মোহিলি যাইতেছে; সুতরাং উপায়রহিত সুঘরাই এই বিচ্ছেদকালীন মুহূর্তে, চামার মোহিলির অবয়ব যেন খানিক রহস্য কুহক চরিত্র তীক্ষ্ণ গভীর দৃষ্টি-দ্বারা সাহস টানিয়া লইতে বদ্ধপরিকর হইল, কিন্তু হা হন্ত মোহিলির যাবতীয় গোপনতা যে ধর্ষিত হইয়াছিল। অথচ মোহিলিকে এখন কি খাসা দেখিতে, ভয় তাহাকে সুন্দর করিয়াছে–আর সে তাহা প্রত্যক্ষে অবাক!
মনিব মহাশয় কহিলেন-তীর্থে আসিয়াছি তাই কিছু বলিতে চাহি না, নিশ্চয়ই বৈদ্যনাথের ইহা অভিপ্রেত! ও আপন পত্নীকে বলিলেন, তখনই বলিয়াছিলাম সহিসের জ্বর ছাড়ুক তখন না হয় বৈদ্যনাথে আসিব।
ইদানীং সুঘরাই, কাষ্ঠচ্যুত কূৰ্ম্মবৎ অবস্থায়ে যে সে, ইহা অনুমান তাহার হয়; তবু সে ভাবে ইতঃমধ্যে অবশ্য, যে মোহিলি, আপনার চমকপ্রদ ভীতি যাহার কণামাত্র খোয়া যায়, তাহা লইয়া ক্রমাগত আপনার রহস্যের অভিমুখে সেই গানখানি গাহিতে থাকিয়া হাল্লাঝুরি পার, মাঝে মধ্যে গরু জোড়া হাঁকানোর শব্দও হয়:
পিয়া যব যাওরে রিখিয়াকে হাটিয়া
কুছ কিন্ইহ নুন তামাকুল
কুছ কিন্ইহ ধন্ইয়া—বল্
হা পিয়া হা পিয়া হামরা খাতির মুখ মুছানির গামছা কিনি লিয়া
পিয়া পিয়া যব যাওবে…।
আঃ কি খাসা গীত, কাঁড়ার (মহিষের) গললগ্ন ঘণ্টির ধ্বনি, এ-গেননুয়ারে ডাক, শেষরাতের মোরগের ভাঙা স্বর, ছায়ার পরিবর্তন, শীতের কুয়ার জলের উষ্ণতা, সর্পের গতি সবই ঐ পদবন্ধের ভাবেতে আছে; এমনও কি ঐ গীত-জাত উদ্দীপনার মধ্যে-নোসটালজিতে; সান্ধ্যভ্রমণের চেঞ্জাররা, কমেডির ভুল উদঘাটনে–জানার হেতুতে যাহারা নিশ্চিন্ত বিশ্বাসে এবং যাহাদের কর্তব্য আপনি স্থিরীকৃত, সুখে ভ্রমণ করে; স্থানীয় খুন খারাবী হওয়াতে তাহারা বীর।
ইহারাই, চেঞ্জার তাহারা, যাহারা আধো চন্দ্রালোকে নিঃসঙ্কোচে এক ইউক্যালিপটস গাছের নিম্নে সমবেত হইয়া দাঁড়াইয়া পাতার আওয়াজ শুনিয়াছে, সকলেই চুপ ছিল, একাগ্র থাকে; কেহ নিষ্ঠ হইতে কারণে চশমা মুছিয়াছিল; অল্পবয়সী ও শিশুতে চপলতা নাই; পাতার আওয়াজ হয়!—ধিক্ তাহাদেরকে যাহারা ইউক্যালিপটসের উপকারিতা বিনাইয়া থাকে! তাহারা অধৰ্ম্ম করে–এইরূপে চেঞ্জারদের অনেক সময় গিয়াছে।
একদা কেহ ঘড়ির রেডিয়ামের স্পষ্টতা লক্ষ্য করত কহিলেন,কবি বলিয়াছিলেন, প্রকৃতিতে ফিরিয়া যাও। ইহা হাস্য উদ্রেক করে নাই কারণ ইহা ব্যক্ত করিতে কুহক স্বরভঙ্গ ঘটিয়াছিল–যাহা মিনতি ও কাতরতা মিশ্রিত, ইহাতে সকলেই বহু ঊর্ধ্বে ইউক্যালিপটসের হাল্কা পাতাগুলির দিকে– এইগুলি গাছটির স্বদেশ, ঐদিকে চাহিয়া অনুভব করিলেন যে তাঁহারা সকলেই ক্লান্ত; ইহা কলিকাতার ক্লান্তি; অথচ ইহা ঠিক যে তাঁহারা এখন বৈদিক আত্মসমালোচনার বাহিরে, অতএব এই তত্ত্ব নিশ্চয়ই বিচারিত হয় না, যে অনাসক্তের বীজ লইয়া তাহারা কেবল দৌড়াইয়াছে। (দৌড়াইয়াছে শব্দটি কত কত মাটির, অথচ এ ক্ষেত্রে? আঃ মানুষের নশ্বরতা!)
ইহারাই কি-সেই যাহারা শূন্য-কে ছিল বলিয়াছে!…
পুনরায় শ্রুত হইল প্রকৃতিতে ফিরিয়া যাও! ইহাতে, এই বাক্যগঠনে চোরা রাজসিকতা আছে, দর্প রহিয়াছে, যে প্রকৃতির বাড়ী যেন আদিবক্তার নখদর্পণে! এবং এখন তাহারাও ঐ সকলেরা, আত্মম্ভরিতায় পৌঁছাইয়াছে, তাহাদের প্রশ্বাসে পত্ররাজি শুষ্ক হয়।