যদি বিচার তাহার দ্বারা সম্ভব হইত, সে মীমাংসা করিতে পারিত না এ ক্রোধ কেন, যেহেতু এতাবৎ তাহাদের জাত পোস্টবক্স ছুঁইত না, তবে দুই এক হাট পূৰ্ব্বে এই সংস্কারের বিরুদ্ধে তেঁড়া দেওয়া হইয়াছে!–এখন সেই পুরাতন প্রথা কেন নির্মূল করা হইল, ইহাই তাহার রোষ–যেন একটি অধিকার বিনষ্ট হইয়াছে, যেন একটি বিদ্বেষ তাহার খোয়া গিয়াছে–এই স্বাধীনতায়ে পুঞ্জীভূত অভিমান তাহাতে চক্র দিয়া উঠিল–অথচ সাধারণত সুঘরাইএর অর্থাৎ তাহাদের জীবনে কোথাও ব্যর্থতা নাই!
.
এখন সে হিরণার টিলায় উপস্থিত, খাঁচাটি রাখিতে গিয়া আশ্চর্য্য যে সে যেমত ছুঁড়িয়া ফেলিতে উদ্যত, যে সে অবাক, এমন ক্ষেত্রে সহসা আপনার হাতের উল্কীর প্রতি নজর গিয়াছিল, যে সে যেমন। বা কিস্তৃত ঘোরে, আপনার অঙ্গুলির তথা হাতের স্বাদ গ্রহণ করিতে চাহিল–যে কিন্তু তখনই তাহা এড়াইতে, এই বিশাল সুপ্রসারিত এলোমেলো স্থানসমূহের দিকে সে অবলোকন করিল। এখন দেখিল তাহার ঘর্মসিক্ত গেঞ্জী যেন রোদ, সে যেন ঠাণ্ডা হাওয়া খুঁজিতে আছে। যে সুঘরাই একটি অতীব জটিল শ্বাস ত্যাগ করিল!
এ শ্বাস তাহার বৰ্তনে খাওয়া হইতে গঠিত।
সে আপনকার ট্যাঁক হইতে ফণীমনসার পাতাগুলি বাহির করিতেছে সময়েই শুনিল, কে যেমন বা ‘আ তিতি’ উচ্চারণ করিতেছে–যাহা তাহাদের দুজনকার, তাহার আর তিতিরের একমাত্র ভাষা, আরও যে যুগপৎ সে প্রত্যক্ষ করিল যে তাহার আপনকার অঙ্গুলি দিয়া সে জমিতে ঘর্ষণ করিতে আছে। ইহাতে সে বিস্মিত হইয়াছিল। এবার সে পক্ষীর দিকে তাকাইল, দেখিল তাহা কোনমতে দণ্ডায়মান থাকিতে চেষ্টা করিয়াই বসিয়া পড়িল, দেখিল টুঙীগুলি দুলিতেছে কাগজের ফুল সকল শব্দিত! তৎক্ষণাৎ সুঘরাইএর চক্ষু আরক্তিম হইল।
ইহাতে সে খাঁচার দরজা সন্তর্পণে খুলিয়া পাখীটিরে অনুপ্রবিষ্ট করাইবার প্রয়াস পাইল, এবং যে সে কপট আদরে তিতি শব্দ করিতেই নিজেই উৎকর্ণ হয়, এ যেন মনিব পত্নীর অভিজাত স্বর, এ কারণে তাহার আপনার গ্রীবা কিছু উন্নত যে সে নিজেই তিতির; কিন্তু সম্মুখে রাজসিক সজ্জার অন্তঃস্থিত পাখীটিতে সে তখনই সচেতন, বুঝিল তাহার প্রিয় পক্ষীটি খানিক গ্রীবা তুলিয়া নামাইয়া লইল।
সুঘরাই আপনাকে সংযত করিয়া কয়েকটি ডাডু পোকা ফণীমনসার পাতায় রাখিয়া উহার সামনে ধরিয়াছে, এবং পুনরায় তাহাকে আহ্বান করিয়াছে, পাখীটি কোনমতে একটি পোকা খাইয়াই যেন ঢলিয়া। পড়িতে চাহিল। সুঘরাই উহার রকমে ক্রমশ ক্রুদ্ধ, অমানুষিকতাতে তাহার হাতে ভারী হইয়া উঠিল, তথাপি সে আপনাকে রুখিয়াছে!
এই টিলার উপরে তিতিরটি যেন তাহার অপরিচিত, যেন তাহার কেহ নহে, কেমন ন্যাংটা, সে সত্বর পক্ষীটিকে তুলিয়া খাঁচার মধ্যে স্থাপিত করিয়া আপনার অভিপ্রেত সংস্থানে ভিড়াইয়া তাহারে চিনিতে ভালবাসিতে ব্যগ্র, আশ্চর্য্য যে এখন বেচারী তিতিরটি খাড়া দাঁড়াইল, আশপাশে সবুজ নীল টুঙী চারিদিকে ফুলশোভা, মধ্যে মধ্যে আকাশ উল্লেখিল!
ইহা দর্শনে সুঘরাই যেন লাফাইয়া উঠিল, কিছুদূর হইতে এই বৈচিত্র্য উপভোগ উদ্দেশ্যে সে ঝটিতি দূরে টিলার উাইতে খানিক নামিয়া চক্ষু ফিরাইতেই স্পষ্টই দেখিল তাহার তিতিরটি বিকটভাবে চঞ্চু পৃথক করত কেমন এক ভাব করিতেছে–ধীরে উহার দেহভার এক পায়ের উপর ন্যস্ত হইল এখন তাহার দক্ষিণের ডানা ক্রমে ক্রমে প্রসারিত হইতেই সুঘরাইএর সাজান নষ্টপ্রায়।
কুরমতি সুঘরাই সবেগে ছুটিয়া আসিল। পাখী যেন তৃষ্ণায় অথবা অন্য কিছুর জন্য তেমনই চঞ্চু ব্যাদানে আছে, ইহা তাহার চোখে পড়িলেও সে গ্রাহ্য করে নাই–সে মহা উম্মায় পাখীটি বাহির করিতেই যে রহস্য গোড়া বাঁধিয়াছিল তাহাই তাহার হাতে সাপের মত উঠিতে ক্রিয়াশীল! সে অবশ্যই বিভীষিত; পূৰ্ব্ব হইতে বিদ্বেষে তাহার চক্ষুতে অগ্নি ক্ষরিতেছিল–এখন সে তপ্রবর্ত্তীত আপনার প্রিয় পাখীটিকে যারপরনাই জোরে আছাড় মারিল।
পাখীটি গড়াইয়া উৎরাই বহিয়া খানিক তফাতে, ক্ষণেক নিশ্চলতার পরই মনসা পাতাতে ড়াড়ু পোকা লইয়া সে ধাবমান–তিতিরের নিকট পৌঁছে, তাহা ঐ পক্ষী, এক কুৎসিত, তাহা এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য হইয়া আছে!
সে উহা পক্ষীটিকে তুলিতেই উহার লম্বমান সুশ্রী গ্রীবা শিথিল নেতাইয়া ঝুলিতেছে, সুঘরাই দমিল, পক্ষী গাত্র হইতে আগত ম্লান বিদেশী পারফিউমের গন্ধে তাহারে কোন মানসিকতা দিল না, বরং তাহার চক্ষুর্ধয় কেমন যেমন বিকারগ্রস্ত, হঠাৎ তাহার হাতে পক্ষীর ক্ষতের রস যাহা আঠাল তাহা লাগিতেই সে এক পা সরিয়াছে মাত্র–যেখানে সরিয়াছে তাহা তাহার পলায়নের জগত; নিশ্চয়ই এবং যুগপৎ সে সেই আঠা প্রথমে সচকিতে ও পরক্ষণেই গভীরভাবে শুকিয়াছে!
ঐ গন্ধ বড় পরিচিত তাহাদের, এবং হঠাৎ ইহাতে তিনবার বলিয়াছে যে আমরা ডোম–যে সে জানে নাই যে, ইহা সে বলে এবং যে তদীয় হস্ত অস্থির ও সে ভূতচালিতের প্রায় পাখীর বক্ষদেশ হইতে অজস্র পালক পৌরাণিক দুৰ্ম্মতিতে উৎপাটিত করিতে কালে অচিরাৎ তাহার দেহের অভ্যন্তরে এক প্রলয়ঙ্কর হুঙ্কার ঘনিয়া উঠিল, অন্যপক্ষে পালক উৎপাটনে বেচারী পক্ষীটির অনেকটা ক্ষতই ওতপ্রোত হইল–এবং সুঘরাইএর ইহা ‘আমরা’ বলাতে বিঘ্ন সৃষ্টি করিল।
সত্রাসে সুঘরাই ঐ পক্ষী দূরে নিক্ষেপ করত–ঝটিতি যে সে উন্মত্তের ন্যায় চীৎকার করিতে থাকিল, যাহা আতঙ্ক, যাহা বেদনা, যাহা আনন্দ, যাহা আহ্বান, যাহা মিলনকামী প্রত্যাশার ডাক, এমনও যে ইহা তাহা নহে। মনোরম খাঁচাটি সে অতীব ক্ষিপ্রতায় হাতে লইতেই চীৎকার যেন আরও দুৰ্ম্মদ আরও খ্যাপাটে, যাহা তীর্থযাত্রায় তধ্বনির বিকৃতি! উড়ন্ত পালকে সে আরও কুটিল হইল।