ক্রমে সে খাঁটিয়া আসীন প্রাচীনদিগের সমক্ষে আসিল, যাহাদের চক্ষু যেমন, কেমন কঠোর, তাহারা এখনও তন্ময় হইতে পারে, ভাবে আবিষ্ট হওয়ত এই অদৃষ্টপূৰ্ব্ব খাঁচা দেখিতে নিয়ত মস্তক ঘুরাইতে থাকিয়াও, খাঁচার অন্তর্বর্তী পাখীর লক্ষণ সকল ইহারা উচিতরূপে ঠাওরে অসমর্থ, সুতরাং কেহ খাঁচাটিতে অঙ্গুলি দ্বারা টোকা দিতে যত্নবান, যাহাতে পাখী সজাগ হয়, যে এবং কেহ ফোড়ন কাটিল, পাখীটি নির্ঘাত মাদি…যদি তাহা নহে তবে এতেক ভীতু কেন? কেহ বলিল,–কেমন যেন করিতেছে?
বালক সুঘরাই ইহাতে অত্যধিক অপমানিত,–ঐ পরিহাস অসহ্য, যে এবং তৎকালেই সে দেখিল, পাখী তাহার সকল সংস্থান বিধ্বস্ত করত চঞ্চল, যে পক্ষীর এহেন স্বেচ্ছাচারিতার কোন ক্ষমা সুঘরাইএর কোমলতার বাহিরে,–সে মানিতে প্রস্তুত না, যে তাহার রোগগ্রস্ত কাহিল তিতির আতঙ্কিত হইয়াই। স্থলিত পদেই কিয়ৎ স্পন্দিত মাত্র, আর যে সুঘরাই স্থানকাল ভুলিয়া পাখীটিরে আক্রমণে উদ্যত, তৎক্ষণাৎ প্রাচীনমণ্ডলী হইতে তীব্র প্রতিবাদসূচক, সাবধান করা সূচক, গঞ্জনাসূচক নিন্দাবাচক রকমারি শব্দ ছুটিয়া আসিল।
অতএব সুঘরাই নিবৃত্ত বটেই, তবু যে সে মর্মাহত থাকিয়া ক্রোধে ফুলিতে আছিল, প্রধানত এই কারণে যে, সে কখনও ভাবে নাই, অর্থাৎ এ যাবৎ তাহার অজ্ঞতাই ছিল যাহা, যে,–তদীয় তিতিরকে কেহ তাচ্ছিল্য করিবে; এখনই এই সূত্র হঠাৎ আভাসিত যে, গত হাটের দিন, কোন পথচারীরা–তাহারা কাঁধের বাঁক লইয়া থামে–একে অন্যকে, তাহারই তিতির বিষয়ে, অনেক সাধুবাদের পর মধুর স্বরে কহিল, ইহা দারুণ মরদ, হাঁ হাঁ অদ্যও ইহারই স্মৃতি জাগরণ নিমিত্ত মেঘ হয় বৃষ্টি আইসে; ইহা দারুণ মরদ, যদি এখন বনাঞ্চলে যায় ইহারই চলনভঙ্গিতে বনস্থলীর মাদি কুকুট সকল অত্যাশ্চর্য্য সংকেত ভাষায় কণ্ঠ উন্নত করিয়া আমন্ত্রণ জানাইত পশ্চাদ্দেশ স্ফীত করত উঁচাইয়া মাটিতে বসিবে, ইহা দারুণ মরদ, ইহার প্রখর সকাম চাহনিতে মনুষ্যসমাজের যুবতীজনের জঙ্ঘা ভারাক্রান্ত হয়!
এখন এই বিজাতীয় সভাতে বিমূঢ় বালক খানিক স্তব্ধভাবে অপ্রতিভ হইয়া যাপনের পরেই, যে আপনকার এক স্কন্ধ হইতে অন্যতে গামছা স্থাপনের পরেই, সদম্ভে ঘোষণা করিল, ইহা দারুণ মরদানা, ইহার কাঁটি সাক্ষাৎ যম, ইহা রমণী-তিতিরগণের আশ্রয়স্থল, ইহা নর-তিতির সকলের কালসদৃশ, ইহার সংহারমূৰ্ত্তি ভয়ঙ্কর…পক্ষাঘাত রোগ পর্যন্ত পলায়ন করে।–যে এবং ইহা ব্যাখ্যানে সে এতই আবেগে এতই উত্তেজনাতে ছিল যে আরও যোগ দিল,…ইহা বহুরূপ শিক্ষাপ্রাপ্ত হইয়াছে, ভুখারির বানর হইতেও যথেষ্ট ইহা দক্ষ…গ্রামের অনেক বালক ইহার কসরৎ দেখিয়াছে, ইহার ক্রীড়ানৈপুণ্যে মদীয়। প্রভুরা চমৎকৃত হইয়া থাকেন…ইহা এক হাত হইতে অন্যটিতেও মস্তকেও ইঙ্গিতমাত্র যায়, বিশুষ্ক পেয়ারা কাঠে ইহার কাঁটি বসে…লড়াইএ ইহা মজবুত! ইহা দারুণ মরদ!–এই আস্ফালনের পরক্ষণেই সুঘরাইএর গাত্রে ঘাম দেখা দিল। পরেই সে স্থবির!
তখনই সভার চারিদিক হইতে, যাহাদের তিতির আছে–তাহাদের নিকট হইতে চ্যালেঞ্জ আসিল, তাহারা পরস্পর আপন আপন গ্রামের নাম কহিল, যথা সালোয়া, ধরমসী, রতনপুর, বড়কোয়া, শিমবারি ইত্যাদি…এবং তাহারা উঠিয়া দাঁড়াইয়া আপনকার উরুদেশ উন্মোচন করিল–চর্মরোগ বিক্ষুব্ধ ক্লিষ্ট যাহা, সদর্পে তথায় চাপড় মারিল একের পর এক! আর যে ঐ একের পর এক-কে অবিলম্বেই নির্ভীক সুঘরাই আপন ছোট ঊরু মেলিয়া রাবণিক ঔদ্ধত্যে চাপড়ে জবাব করিল! কিন্তু অন্যেরা যাহাদের তিতির নাই তাহারা কসরৎ দেখিতে আগ্রহী; নির্বোধ উপায়রহিত সুঘরাই তিতিরটিকে বাহির করিয়া আপন হস্তে বসাইতেই সে মাটিতে পড়িয়া দু’একবার পক্ষ আন্দোলনের পর বসিয়া চুপ!
যুগপৎ তুমুল হাস্যধ্বনি ও আলোড়ন উৎক্ষিপ্ত হইল; ইহা কি লড়িবে, ইহাকে ঘৃতমিশ্রিত মাংসের ছাঁট খাওয়াও, ইহা মাদি নিশ্চিত–ইত্যাকার রব উঠিল। অন্যপক্ষে সুঘরাই যদিও তিতিরটিকে পদাঘাত করিতে পাশবিক, কিন্তু যে তাহাতে সাড় ছিল না। একদা নির্যাতিত আহতদৃষ্টিতে তিতিরের প্রতি অবলোকন করত কহিল, বেশ বেশ, কল্যই কাহার গ্রামে যাইব বল–যাহা নিকটে তাহা বল!–তাহার কানে দু’একটি নাম বিদ্রুপাত্মক হাস্যভেদ ভাসিয়া আসিল, অতঃপর সে কোনক্রমে মস্তক সটান রাখিয়া ঐ স্থান ত্যাগ করিয়াছে!
সুঘরাইএর গাত্র অসম্ভব উষ্ণ, সে মতিচ্ছন্ন প্রায় যে সমগ্র খাঁচার সাজ হওয়াতে এবং চলার জন্য নিজ বস্ত্রের শব্দ, বড় হাস্যকর, সভার উপহাস তাহারে দগ্ধ করিতে আছে, ও আপশোষ পরস্পরাতে তাহার ওষ্ঠদ্বয় কম্পিত। সে এক আধবার শুধুমাত্র গামছাখানিক এক কাঁধ হইতে অন্যত্রে লইয়াছে, কিন্তু বুঝায় যে সে তখনও এলাইয়া পড়ে নাই, যে সে হাটের পথে, টিলার দিকে, ডাঙু পোকা সংগ্রহে, যেহেতু যায়।
এমত সময় একদল চেঞ্জার তাহার পথ রোধ করিয়াছিল; খাঁচা দর্শনে তাহারা মহা উচ্ছ্বাসে, এ্যাণ্ড গ্র্যাণ্ড বলিয়া সুঘরাইএর প্রশংসাতে (এখানকার ধারা বশম্বদ কাহাকেও কালচারড রূপে সনাক্ত করে না) প্রকাশিল, সত্যিই ছেলেটি আনকালচারড নহে!…মোটেই আনকালচারড নহে!…মোটেই আনকালচারড নহে!…একেবারে আমাদের মতন মডার্ন, না?
ইহাতে সুঘরাই যথাযথ ভদ্র-অভিব্যক্তিতে কিছু বিনয়ী হইতে কঠিন হইয়া রহে, যে সে অন্যত্রে দৃষ্টি সঞ্চার করিল, দেখিল, লাল পোস্টবক্সটি যাহা গাছের কাণ্ডে সংলগ্ন, তদ্দণ্ডে সে যেন জ্বলিয়া উঠিয়াছে! চেঞ্জাররা তাহারে অতিক্রম করিয়া এখন চলিয়া গিয়াছিল। সুঘরাই আপনকার বস্ত্রের শব্দ শুনিতে থাকে, যে সে এতই উৎক্ষিপ্ত যে মনে হইল পোস্টবক্স বিনষ্ট করে!