ঐ লোক আপন রক্ষিতা ও পোষ্য শুয়োরটিকে বারম্বার আজ্ঞা করিল,…দেখ দেখ। এইরূপে এতই সন্তোষ প্রকাশ করে যে তাহা অবর্ণনীয়, যে সে আপন ঊরুদেশে, আপন বাহুতে, কখনও বা বৃক্ষের কাণ্ডে চাপড় মারিল, তাহার শুয়োরটি ঘোঁৎ ঘোঁৎ করিয়া পলাইয়াছিল, ক্রমে সে এতেক গর্বিত যেমন যে, তাহার বসিয়া খাইবার পুঁজি আছে। সুঘরাই ইহাতে স্ফীত অসম্ভব, এতদিন পর ভগনীপতিকে আর মন্দ প্রকৃতির বলিয়া বোধ হয় নাই।
ভগনীপতি আরও প্রকাশিল যে, লোকমুখে শুনিয়াছি তোমার পাখী ও খাঁচার প্রশংসার…কতবার উহা দেখিতে সাধ হইয়াছে…তুমি ভয়ে আন নাই…আমি কথা দিতেছি কখনও ইহা আমি কাটিয়া খাইবার কথা মুখে আনিব না…আহা খাঁচাটি যেন বিবিধ অলঙ্কার-ভূষিতা রমণীসদৃশ,…না না উহাকে তাড়া দিও না…ঐ বিশ্রীদর্শন কুকুর দেখিয়া, এখানে নূতন লোক দেখিয়া ভড়কাইয়াছে…বাহির করিও না উড়িয়া যাইবে…উহাকে লড়াই শিখাইতেছ ত? হ্যাঁ উহা মস্ত জঙ্গী হইবে…লড়াই লড়াই…এবং সকলেই তোমার পাখী দর্শনে চক্ষু সার্থক করুক, সকলেই গ্রামগ্রামান্তরে এই সংবাদ লইয়া যাক যে রিখিয়ার অন্তঃপাতি লুড়িয়া গ্রামের…হাড়িয়াল ডোমের শালার এক রূপবান পাখী আছে…একি তুমি ভ্রকুঞ্চিত করিয়া আছ কেন…আহা উহারে শাসাইও না…ছি ছি! আঃ খাঁচাটি যে…।
ইতিমধ্যে পাখীর ব্যবহারে সুঘরাই আরও অপদস্থ, এবং যে তাহাতে এবম্প্রকার বৈচিত্র্য আসিতেছিল যে তন্মহূর্তেই পাখীটিরে আক্রমণ করে, যে সে তীব্র কুপিত, মনে মনে সে বড় আপন এই প্রিয়স্পদের উদ্দেশে মুখ খারাপ করে এবং অনেক গঞ্জনা অনেক আপশোষ তাহাতে বিস্ফারিত, যে যেমন…শালা তোমারে এত শিখাইয়া পড়িয়া আনিলাম…ডাক্তারবাবুর ঔষধই তোমার কাল হইল…বেশ ত ছিলে…সারা দ্বিপ্রহর ধরিয়া আমার সাজানকে বানচাল করিলে…আমার মাথায় তেল দেওয়া বৃথা। গেঞ্জী পরা বৃথা হইল…আমি বাড়ি গিয়াই (মনিব বাড়ী) খাঁচা হইতে তোমাকে বহিষ্কৃত করিব…হুলাড়ে রাত্রযোগে তোমার টুটি ধরিবে…!
.
এখনও মায়ামমতাহীন রোষে সে যখন গৰ্জাইতে আছে, তৎকালে ঝটিতি যে মনিব মহাশয়ের স্বর তাহার কণ্ঠে ধ্বনিত হইল, যে এবং মনিব পত্নীকে সাক্ষাৎ দেখিল, ফলে সমস্ত মানসিকতা পরিবর্তিত, এখন সে কাপুরুষ! আপন সপক্ষে এইটুকু যুক্তি পাখীটিরে দিয়াছে, যে…আমি কি সাধ করিয়া রাগিতেছি…তোমার জন্যই ত সাজানরে, মূঢ়! তুমি যদি, তাহাতে বিশৃঙ্খলতা আনয়ন কর, তাহা হইলে কোন মানুষ না বিরক্ত হয়, আমি তো ডোম…তুমি জংলী, সাজান আমার প্রাণ…আমার সঙ্গ করিয়াও তুমি এখনও ভূত…আমারে দেখিয়া শিখিতে পার না…জান না, সাজানর মধ্যে আমি কি দেখি, আমিও চাই সকলেই তাহা দেখুক!.আর নড়া চড়া করিও না, যাহা ঘটিবার ঘটিয়াছে!
সত্যই খাঁচাটি সাজানতে তদীয় বিস্ময় নিভাঁজ নিখুঁত পূর্ণ মাত্রায় ঝমরিয়া উঠিয়াছে; ইহাতে তাহার ডোমজ সৰ্ব্বাঙ্গ বিশাল হইল। এমনও যে মহুয়া গাছটিতে টানান হাটতলার যে লাল পোস্টবক্স না-ছুঁইতে-পারার আঁট-হাটতলার ঐ পোস্টবক্স প্রত্যক্ষে সে ঝটিতি তাহারা হয় যে তাহারা সাক্ষাৎ পাপ!ব্যতীত পৃথিবীর পরেও যে আর এক সত্য আছে যে যাহা সুঘরাইতে উদ্ভিন্ন!
সে খাঁচাটি লইয়া মন্থরগতিতে চলিতে আছে, এখন তাহাতে ইতস্ততর মাত্রা আর নাই! খানিক পথ। অতিক্রম করিতেই এখন এমন হইল যে,–তাহাদের গ্রাম ও রিখিয়ার রাস্তার মধ্যে নলিনীবাবুর বাড়ীর পিছনে (অর্থাৎ আমাদের বাড়ীর) যে বিরাট প্রাচীন অশ্বত্থ গাছ আছে, সেখানে অনেক জনসমাবেশ, অনেক খাঁটিয়া, অনেক হুঁকা, অনেক ধোঁয়া, অনেক কাশির শব্দ, অনেক কথাবার্তা; এক বৃহৎ চক্র দিয়া বহু লোক উপবিষ্ট!
ইহা ছোট না-জলচল জাতির সম্মেলন, মনুষ্যচক্রের কেন্দ্রে, মধ্যখানে, এক অগ্নি প্রজ্জ্বলিত; তন্নিকটে এক যুবতী আসীনা–সে কেঁদে, তৎসহ এবং হুঁকা খাইতে আছে–এই সেই যুবতী, একদা মধ্যরাত্রে তদীয় স্বামীকে হত্যা করে শ্বশুরালয়েই, এবং যে, সেই রাত্রেই সেইখান হইতে একটি মস্ত কাঁঠাল লইয়া প্রায় চার ক্রোশ পথ ভাঙ্গিয়া রিখিয়ায় পিত্রালয়ে পালাইয়া আইসে। এই যুবতাঁকে লইয়া মারাত্মক তর্ক, অন্যান্য জাতির লোকও এখানে উপস্থিত তাহারা দুরে দাঁড়াইয়া আছে।
মুসলমান সম্প্রদায়ের অনেকেই এখানে আছে–যাহারা অনাহূত তবু তাহারাও মাঝে মধ্যে যুক্তি সরবরাহ করিতেছিল!
এবং যেইমাত্র ঐ ঐ লোকেদের, সমবেতদের, সুঘরাইকে দৃষ্টিগোচর হয় সেই ক্ষণেই এই বিজ্ঞ সম্মেলন প্রায় ছত্রাকার, যে, ঈদৃশ রোল উঠিল যে, ঐ সে বালক যাহার সুন্দর তিতির আছে, ঐ সেই বালক যাহার খাঁচাটি দেখিতে মহারাণী সমান, ঐ সেই বালক যে এখন খাঁচা লইয়া যায়! যে এবং অজস্র হাতছানি ওতপ্রোত হইল।
ইহাতে সুঘরাই গৰ্ব্বমিশ্র অস্বস্তিতে আপনার স্কন্ধস্থিত গামছায় ক্কচিৎ যত্ন দিল, তাহার এক পার্শ্বে রৌদ্র, পাখীর খাঁচা সমেত ছায়া তাহারই পদপ্রান্তে, ও যে তাহার পিছনে অনেক গ্রামের শিশু সকল! এবং সমগ্র সভার অনুরোধেতে সে সকলের প্রীতি সম্পাদন পরতন্ত্র খাঁচা হাতে ধীর হস্তীগমনে অগ্রসর হইল।
প্রাচীন যাহারা তাহাদের অভিপ্রায় অনুযায়ী, যাহারা ঘেরিয়া বসিয়াছে তাহাদের সকলকে–ইহারা প্রায়ই দূরাগত ভিন্নগ্রামের লোক সুঘরাই পক্ষী দেখাইতে পরিক্রমণ করে, যাহা দেখিতে কালে বিবিধ বিস্ময়সূচক আ আ শব্দের মধ্যেই সুঘরাই শুনিতেছিল, তুমি তোমার রুগ্ন পুরুষের উপর যথেষ্ট অত্যাচার করিয়াছ এবং অবশেষে তাহারে, প্রমাণ না থাকিলেও, সকলেই বুঝে, হত্যা করিয়াছ, এখন ঐ অগ্নির দিকে চাহিয়া বল, সেই সকালে…, এই দোষারোপ এক প্রাচীন কর্তৃক সেই যুবতী উদ্দেশে ব্যক্ত, ইহাতে সুঘরাই সেই যুবতাঁকে তির্যক দৃষ্টিতে পর্য্যবেক্ষণ করে, যে তাহার মন ঘৃণায় বিষাইয়া উঠিল।