.
ডাক্তারবাবু পাখীর খাঁচাটি দেখিয়া অভিভূত, যে তিনি খুব সন্তর্পণেই তাহা অবলোকন করিতে থাকিয়া প্রশংসায় কহিলেন,–অভিনব! এরূপ কখনও দেখি নাই…সার্থক!
সুঘরাই আপনার নিন্দাকে কজা করিয়া টেবিলের একান্তে দণ্ডায়মান যে সে এমন কি খাঁচাটির দিকে। নজর করিতে সক্ষম নহে! সে আপন পাখীটির গায়ে এখন হাত বুলাইতে আছে।
ডাক্তারবাবু পুনরায় প্রকাশিলেন,–নিশ্চয়…ইহাতে আপনার লক্ষ্মী-শ্রীযুক্ত হাত, নিশ্চয়ই হলপ না। করিয়া বলা যায় যে, আছে…আহা ইহা এই খাঁচা যেন অলকাপুরীকে হার মানাইয়াছে!
এতাদৃশ গুণকীর্ত্তনে ধীর সৎস্বভাবা মনিব পত্নী কুণ্ঠায়ে বলিলেন,–আমি না, ছোঁড়াই অষ্টপ্রহর ঐ। নিয়ে আছে…উনি বলেন ছোঁড়ার টেষ্ট আছে…খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে কিনে…ফুলগুনো বটে আমি করে দিয়েছি…ছোঁড়ার কত সখ তাজা ফুলের মত গন্ধ হোক, তাই একটু পারফিউম দিয়েছি, তাজা ফুলে পোকা থাকে, পাখী ঠোকরায় দেখে, মানে ওনার সাজান নষ্ট হয় দেখে, উনি খোঁচান ত…তাই বললুম…ও কি মানুষ!…সেই খুঁচিয়েই ত ঘা…এখন আবার আর এক জ্বালা পাখীটা মদ্দিখানে না থাকলে… খোঁচাবে দেখুন দিকি…। এই পর্যন্ত ব্যক্ত করিয়া মনিব পত্নী সুঘরাইএর প্রেরণা, বাস্তবতা, অভিজ্ঞতার কথা সবিস্তারে কহিয়া অনুরোধ জানাইলেন,–এখন দেখুন ত ঘা-টা–নিম-ঘি এটা-সেটা সবই ত দিলুম…এ সবই জানেন ওঁর জন্যেই ওঁর আহ্লাদেই হয়েছে…উনি কিছুই বলেন না…!
.
যে মনিব পত্নী বহুবারই তাঁহার স্বামীকে সুঘরাইএর এই স্বভাব জ্ঞাত করিয়াছিলেন; তদুত্তরে মনিব মহাশয় তখন বলিয়াছেন,–দেখ…তুমি উহাকে কোন জ্ঞান দিবার আদেশ লইয়া আস নাই…উহারে কুড়াইয়া খাওয়া পাপ অস্বাস্থ্যকর বলিয়া যেমন অনেকে ক্ষান্ত হয়…আমরা তাহা নই। আর যে উহারা এত দুঃস্থ এত নিঃসহায়…পাপ কোথায়…বেচারীর নিয়তি পৰ্য্যন্ত নাই। সে দেহ সচেতন মাত্র নহে…দেখ না হাঁ করিয়া মুখ দিয়া মাছি ধরে…! আমাদের ভক্তির জোর থাকিলে উহার পাপও থাকিবে না…। উহার পাপ আমরা লইব…! কেননা উহা তাহার নহে…! ঠাকুর ভিন্ন গতি নাই…। আমরা কেহ কিছু নই!
.
এখন ডাক্তারবাবুর সমক্ষে, স্নেহময়ী মনিব পত্নী এবং সুঘরাইকে আজ্ঞা করিলেন, মুখপোড়া ওকে…পাখীটাকে, উল্টে ধর না…আলতো করে ধর! আমি টর্চ ফেলছি…।
ডাক্তারবাবু পাখীর দিকে তাকাইয়া কুঞ্চিত করত মন্তব্য করিলেন,–এখন থাক, এ কি পাখী এমন ঝিমাইয়া পড়ে কেন…যেন নিস্তেজ…উল্টাও ত…বুকটা চিতাইয়া ধর…একটা এসেন্সের গন্ধ যেন!
ঘা থেকে বিশ্রী গন্ধ বেরুচ্ছিল, তাই আমি একটু পারফিউম দিলুম, অন্যায় হয়েছে…।
তাহা নহে…তবে গন্ধক মানে…।
গন্ধক…গন্ধক!…এ বাড়ীতে? অবশ্য প্রথম আসার আগে গন্ধক ধোঁয়া দেওয়া হয়…ছোঁড়া গন্ধক কোথায় পেলি…ও বুঝেছি, বন্দুকের টোটা তৈরীর কলে বারুদে…তাই বা…।
মানে মলম…হ্যাঁ নিশ্চয় কোন মলম এই দেখুন…নিশ্চয় এই মলম পাখী খাইয়াছে…!
কোথায় পেলি আমি ত দিই নি…তুই কি সেই ফেলে-দেওয়া টিউবটা থেকে…তাতে ত কিছু ছিল না…সেটা বিষ লেখা থাকলেও এত কি…নিশ্চয় তুই সেটা দিয়েছিলি…?
না…তাতে এমন কিছু হইয়াছে বলিয়া মনে হয় না…তবে সাময়িক একটু কাজ করিয়াছে…তুমি ত বাপু বড় নিষ্ঠুর,…তুমি ত বড় তামসিক হে…দেখ কি করিয়াছ–শোৎ! পুঁজ, ছি ছি খাঁচাটিরে এরূপ সাজাইতে যখন তোমার মন আছে…তখন…ইহার জন্যই ত বাপু সাজান ছিছি…যতবারই আমার খাঁচার প্রতি দৃষ্টি যাইতেছে ততবারই জানেন আমার মন হইতেছে যে এতেক মনোরমত্ব বুদ্ধি উহাতে যে আছে তাহা আমার কল্পনাতীত…যাহাদের ছটাক জমি পর্য্যন্ত নাই–যাহাদের তাল ও কাঁঠাল আর ব্যাঙের ছাতা খাইয়া জীবনধারণ…গরুর জন্য রক্ষিত ফেন বৈ অন্য কিছু যাহারা চুরি করিতে সাহসী নহে…পাণ্ডা বাড়ীর গাছের শুকনা উড়ন্ত পাতা স্পর্শ করিতে যাহারা ত্রস্ত হয়, তাহাদেরই একজন এই বালক…তাহাতে এত সূক্ষ্মতা!…এই নিষ্ঠুরতা তোমায় পরিত্যাগ করিতে হইবে…পরিত্যাগ কর…তোমার কি মন চাহে না যে পাখীটিরে সকলে দেখিয়া সুখী হয়…! দেখ ত কি বিশ্রী গন্ধ বাহির হইতেছে…।
যে সুঘরাই, ইহা বলার কথা নহে, ঐ উৎকট ঘেমো গন্ধ কখনও কখনও শুকিতে থাকিয়া, লোকচরাচরের চারিদিকে অপটু দৃষ্টিতে চোখ ফিরাইয়াছে বটে, কিন্তু তাহাতে ঘেন্না নাই ও সে ভীত নহে; যে ঐ গন্ধ কুৎসিত ইহা তাহার দ্বারা বিচারিত হয় না, এবং ইহাও নির্ঘাত যে তাহাতে ক্কচিৎ আভাসিতও হয় নাই যে চন্দনাদি গন্ধ দ্রব্যের নিমিত্ত উন্মত্ততা তাহার অন্তরে আছে।
ঠাকুর করুন তোমাতে মায়ামমতা দেখা দিক! ডাক্তারবাবু যেন প্রার্থনা করিলেন।
ড়াডুপোকা ফণীমনসার পাতা দিয়া ধরিয়া তিতিরকে খাওয়াইবার বিধিমতে সে লুড়িয়া গ্রামের ঝাঁকাল ফণীমনসা হইতে পত্ৰসংগ্রহ করিতে যায় এবং সেখান হইতে খাঁচাটি হাতে সুঘরাই যখন তাহার ভগনীপতির ঘরের সামনে, তখন হাওয়াতে বৃক্ষের ডালসকল নুইয়া অদ্ভুত রূপ ধারণ করিল, অদূরে কাতার দিয়া লুড়িয়া গ্রামের অনেক উলঙ্গ শিশু–ইহারা পড়িমরি করিয়া সুঘরাইকে অনুসরণে এখানে আসিল, ইহারা খাঁচাটি অবলোকনে সম্মোহিত।
সুঘরাই হৃষ্টমনে চারিদিকে নেত্রপাত করিল; সে সেই চির-অভ্যস্ত ঘেমো গন্ধ পাইল, কিন্তু খাঁচাটি টলে নাই, যে নিশ্চয় ঐ গন্ধে সে নাসিকা কুঞ্চিত করিবার মুহূর্ত পায় না, যে অথবা অবশ্যই এখনও কোথাও তাহার স্বভাবে সেই গন্ধ সহজ স্বাভাবিক রহিয়া থাকে। কোথাও সে কিস্তৃত হাড়ী, ঘরের কোথাও ছেঁড়া ছেঁড়া চটের থলি এতদিন তরাসে যাহা লক্ষ্য হয় না, অদ্য স্পষ্ট এ সকল তাহার দ্বারা লক্ষিত হইল; ভগনীপতি তাহাকে দেখিয়া, তাহার খাঁচা অবলোকনে এক কোদাল-হা হইয়াছে, সে খুসীতে কখনও কহিল, খুব…খুব…খুব বহুদিবস পরে আত্মীয় দেখিলে…এক পাতা চিড়া দধি দেখিলে, যে আমোদ সেই আমোদ হইল, তোমাকে ও তোমার খাঁচাটি ও পাখীটি দর্শনে বটে আমোদ হইল।