হে বাবা বৈদ্যনাথ তুমি যদি সত্য, তাহা হইলে সুঁই-এর পরও তাহাদের কলেরা হউক, যে চিঠি তাহারা করিয়াছে তাহারও কলেরা হউক, সবংশে তাহারা নিধন হউক; এখন শালা চরকাবাজরা সুইবাচক। যাহাদের পাপে মেঘ অবধি বাঁজা হয়–ডোম চামার মেথর হাড়ি পাশি, যত শালা মাতাল ডুমনীখোর বদমায়েস, আংলিস খচ্চড়, গরুচোর ধানচোর, ও হো হো আমি জাত ভাঁড়াইলেও আমার সুরত দেখিয়া চিনিবে যে, ওহো সুঁই গে মাই, আমার আগে আমার ছায়া পর্যন্ত যাইতে–যাহার নামেই ডরে, দেখুন হে আমার ছায়া বটে কীদৃশী ভয় পাইয়াছে, দেখুন উহা আমার পিছে মুখ লুকায়। অহো বাবা বৈদ্যনাথ দেখ, আমার তরাস এখন আছে, তুমি ধন্য।
তথাপি যে মনিবরা অজস্র সাধ্যসাধনা করিলেন, হায় কোনই ফলোদয় ঘটিল না; সুঘরাইএর দেহে সিঞ্চি উপস্থিত, বধির কেরেট সাপ যেমন তাহার আশেপাশে, স্বীয় গ্রামের লোকের এরূপ ভীতি দর্শনে সে নিজেই দুর্বোধ্য হইয়াছিল; ইদানীং সে চামার মোহিলির মুখমণ্ডল পাঠে সম্যক উহারে বুঝিয়া লইতে ব্যগ্র থাকে; এই সেই চামার মোহিলি যাহার বাড়ীতে বিলাতী আমড়া গাছ আছে, যে হয় খুবই ঢ্যাঙ্গা, যে খুবই রোগা, যে হয় হাড়সার, সব তেমন তেমন আছে বটেই, তবে যে কি যেন উহাতে ছিল না।
যে তাহা ইহা, যথা যে–সেই যে চামার মোহিলি, যাহার বশে কত প্রেতাত্মা, যাহাকে কতবারই না দুর্বোধ্য ছড়া কাটিতে সঙ্গেই কুশ-পেয়ের ন্যায় পা করিয়া ইব্রাহিম মিঞার ভুটে ঘোড়ার মূত্র ঝিনুকে সংগ্রহ করিতে দেখিয়াছে; যাহাকে দেখিয়াছে ঐ মূত্রপূর্ণ ঝিনুক হাতে তদ্রূপ ছড়া উচ্চারণে, যে সদ্যজাতক-কে ইলড়া ভূতে পাইয়াছে অথবা যাহাতে না পায়, তাই উহা খাওয়াইতে গিয়াছে–ইহা তাহাদেরই মারণ ঐ জাতীয় ভূতের! যাহারা নবজাতককে বিকলাঙ্গ করে, দুমড়াইতে থাকে।
ঐ ঝিনুকসহ তাদৃশ কায়দায় মোহিলির মন্থর গমন, কি পর্য্যন্ত ভাব গম্ভীর, যে সে এতটুকু ভ্রুক্ষেপ কিছুতেই করে না, উহার পিছনে তখন গাছে পায়ে ভীষণ ভূতুড়ে দৌরাত্ম্যর শব্দ ও কাণ্ড ঘটিতেছে; কি আশ্চর্য্য রহস্য সে! আর এই সুঁই ব্যাপারে নিজেই শঙ্কিত, বেপথু শরীর উহার! ইহাই কি সেই মোহিলি যে যাহার ঘুনসীতে সকলের শুভাশুভ বাঁধা নিশ্চিন্দি, যে যাহার চৰ্ম্মে জনাজাতের ঘুম লাগিয়া থাকে। রাত্র যাহার দাসানুদাস।
মোহিলির বহমানতা লুপ্ত হইতেই, এতক্ষণকার, সেই রিখিয়া হইতে যাত্রা প্রীতিময়, যাহা উদ্দীপনায় নিশ্চিহ্ন বিশেষত এই কারণে যে একদা মোহিলি জানাইয়াছিল, যে এক একজন সন্ন্যাসী মহাপুরুষ আছেন যাঁহারা তত্ত্বদর্শী, যে রহস্য তুমি শুনিয়াছ তাহার সবিশেষ তাৎপৰ্য্য জিজ্ঞাসুকে তাঁহারা বলিতে পারেন, বৈদ্যনাথে যখন যাইব তখন আমরা, তুমি আর আমি, তেমন তেমন মহাপুরুষ দেখিলে তাঁহার নিকট নিবেদন করিব, ইহাতে আমরা জন্মান্তরে উঁচু ঘরে জন্মাইব। আমরা নিশ্চয়ই জন্মাইব…।
ইহাতে কি যেন ভাবিয়া সুঘরাই কহিল,–যদি উহা শুনিয়া অচৈতন্য হয়!
মোহিলি উত্তর করিল–জানি তাঁহারা অজ্ঞান হইবার নহে।
যদিও মোহিলি এই কথার মধ্যে মধ্যে কাশিতেছিল তবুও সে আবছায়া সুঘরাইএর চোখে এবং ঐরূপ প্রস্তাবে তাহার, সুঘরাইএর দেহ নিয়মরহিত: এবং সুঘরাই অন্যত্রে, তখন সে প্রত্যক্ষ করিল, অদূরস্থিত সৌখীন টেবিল ল্যাম্পের আলো আশ্চৰ্য্য অহেতুক হঠাৎ বর্ধিত হইল। ইহাতে তাহার কণ্ঠস্বর ব্যাহত নয় যাহা একটানা ভিখারীবৎ ছিল; দ্বারদেশে থাকিয়া সে ঐ রহস্য কথা বলিতেছিল আর যে তাহার পশ্চাতে দরজায় উৎকৃষ্ট চিৎসের ফুলকারী পর্দা উড়িতে থাকে এবং বাহিরের সাঁওতাল পরগণার বিচিত্র অন্ধকার অনুভব হয়।
চিপ এণ্ড ডেল রীতিবিশিষ্ট ছোট লেখার টেবিলের সামনে মনিবপত্নী, যিনি এখন পুত্র ও কন্যাকে চিঠি লেখেন, হালকা ফলসা রঙের চিঠির কাগজের পাশেই তাঁহার বাঁ হাতখানি আড় করিয়া রাখা যেন কোন প্রসিদ্ধ আর্টিস্টের কাজের খানিক, কিন্তু অঙ্গুরীয়র চুনীর উজ্জ্বলতায় ঐ ভাবনা আর থাকে না, মনে হয় ইতিহাস একদা ভয় পাইয়াছিল; ডান হাতের কলমটির প্রান্ত তাঁহার সুমহৎ অধরে ছোঁয়ান; সামনে চমৎকার গিল্টকরা ফ্রেমে, নাবিক পোষাক পরিহিত কিশোর বালকের ছবি ও ইহারই পাশেই, একই ফ্রেমে, বালিকা কন্যা মেষপালিকার বেশে–এই কল্পনাকে তাহার জীবনপণ নৈতিকতায় বাঁচাইবে–আর তাহারা ঝরণা দেখিতে ছুটিয়াছে!
যেহেতু ইহাদের ঐ পুত্র কন্যাকে সুঘরাইএর পক্ষীবৃত্তান্ত জানাইবার জন্য মনিবপত্নী উন্মুখ ছিলেন। সুঘরাই বর্ণিত আছে, স্বরে তাহার জড়তা নাই, কিন্তু ছোট দেহখানি তাহার অস্বচ্ছন্দ, সে কহিল– মোহিলি অদ্ভুত গলায় বলিল, এখন তোমার পাখীতে যে রহস্য গোড়া বাঁধিতেছে সাবধান!–এবং তাহার জবানীর মধ্যেই টেবিলস্থ আলো কেমন করিয়া উঠিল।
মনিবপত্নী এই কথা শোনামাত্র চেয়ার ছাড়িয়া দণ্ডায়মানা, তাঁহার দেহ কোন প্রহেলিকা প্রভাবিত মৃদু টলিতেছিল, ফুলদানীর গোলাপগুলি, যেগুলি অনেক অনেকদিনই ভাবানুষঙ্গর সূত্র, তাহাদেরকে তিনি তদীয় সুষমামণ্ডিত বাম হস্তে আঁকড়াইতে চাহিলেন এবং শুধুমাত্র বলিয়া উঠিলেন, শুনছ শুনছ শিগগীর!
ইহাতে তখনই পাশের কক্ষে একটি কাঁচের গেলাসের আঘাতের আওয়াজ হইল; পরক্ষণেই মনিব। মহাশয় আসিলেন, আজ্ঞা করিলেন সুঘরাইকে, তুই যা। ইহা বলিয়া তদীয় সহধর্মিণীকে ধরিতেই যিনি অচৈতন্য হইলেন, সাবধানে চেয়ারে তাঁহারে বসাইয়াই তিনি স্মেলিং সল্টের শিশিটি আয়না দেরাজ হইতে তুলিয়াছিলেন; এবং অতঃপর ও-ডি-কোলনের এটমাইজারটি লইয়া কহিলেন, না না উঠিও না, মাথায় কাপড় দিবার কোন দরকার নাই…আবার সযত্নে তাহাকে বসাইয়া দিয়াছিলেন; পর্দায় ছায়া পড়িয়াছিল।