আমি তাহারে ভালবাসি যে!
কিয়ৎ দূরেই সুঘরাই এই সতর্ক-আজ্ঞা মানিতে অবশ্যই প্রস্তুত হইলেও ইহাও সে জ্ঞাত করিতে উদগ্রীব, কেননা হস্তে-অঙ্কিত বিছা সে দেখে, যে শুধু তাহার দ্বারা বা কোন কিছুর দ্বারাই উহার ক্ষতিসাধন সম্ভব নহে, এ কারণ যে উহাতে এক রহস্যের গোড়া লাগিয়াছে! সুতরাং তাহার মুখে এক নির্ভাবনা অস্পষ্ট হইয়া রহে, কিন্তু ইহা কতক্ষণ, অবিলম্বেই সে বুঝিয়াছিল যে তিনি, মনিবপত্নীও তাহার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকাইয়াছিলেন। যাহাতে তাহার অন্তঃস্থল পর্য্যন্ত উদঘাটিত, আর যেমন সে ত্রস্ত ছিল।
.
যে ইহা সত্যই, তাহাকে তিনি অনেকবারই ঐ ধ্বনি সম্পর্কে মধুর কণ্ঠে প্রশ্ন করিয়াছেন; কিন্তু সুঘরাই কোন সময়ই মূল কারণ প্রকাশিতে সৎসাহস পায় নাই। মধ্যে মধ্যে অদ্ভুত কথা মনে আসিয়াছে, যে একদিন তুমুল বৃষ্টি হয় তখন বলিব, একদিন সাগরি পাখী বাজের দ্বারা তাড়িত হইয়া কুয়োর ভিতরকার বট গাছে বসে তবে–তখন বলিব, একদিন আমার খুব জ্বর হইবে–তখন বলিব।
মোহিলি বলিয়াছে,-যতদূর মনে হয় দেওঘরে যাওয়াটাই অঘটন হইয়াছে…ডোমের ছেলে…নিশ্চয়ই কোন ফুল বা প্রসাদী কিছু মাড়াইয়াছে…কিম্বা কিছু ছুঁইয়াছে, কোন দেবস্থান চুঁইয়াছে। বা…ভূত হইলে অনেকবিধ জ্বালাতন করিত, তবে সে হয়ত এইরূপে ধীরে ধীরে পাগল হইবে…তবে এখনই সব বুঝা যাইবে… সুঘরাই কোথায়!
সত্ত্বগুণশালিনী মনিব পত্নীর ডাকে সুঘরাই আসিল, ভৃত্যবৎসলা রমণী সুঘরাইকে আপন কক্ষে লইয়া বলিলেন,বলবি ত বল, না হলে পাখী খোঁচানর আদত কথা মোহিলি তোকে এইসা মতোর দেবে যে…।
এই পর্যন্ত শুনিয়াই যে সে মোহিলিকে একবার দেখিতেই তাহার আপনার দৃষ্টি যেন কোথাও বা নিবদ্ধ হইয়াছিল–সমক্ষে আয়না ছিল, সে ওষ্ঠদ্বয় জিহ্বার দ্বারা ঈষৎ বুলাইয়া কহিল,–আমি সেই চীৎকার যে কেন করি তাহা বলিতেছি…আমি পাগল নই…আমাতে কোনও প্রেতাত্মা ভর করে না…আমি বহুজন্মের পুণ্য (!)…তাই এই বাড়ীর দাস…এখানে আমি গেঞ্জী পরিয়াছি…বালিশ পাইয়াছি…এমন কি বৰ্ত্তনে খাই…বহু জন্মের পুণ্যবল আমার…তাই মাঠাকরুণ আপনি আমারে বৈদ্যনাথ লইয়া যান…আমি এক উৎকৃষ্ট রত্নসামগ্রী মণ্ডিত, শোভাযাত্রা দেখি! যাহা ভগবান বৈদ্যনাথের কাছে যাইতেছিল!
আঃ অলৌকিকত্ব! ধৰ্ম্মশীলা মনিব পত্নী নিশ্চয় ইহা বলিয়া করজোড় করিয়াছিলেন।
চৌকোণা ছত্র-এর তলে অলোকসামান্য বালিকা, হস্তে ধান্যমঞ্জরী!
আঃ ষড়ৈশ্বৰ্য্যময়ী কাব্যবীজ! সম্পূর্ণ চিত্র মনিব পত্নীর সমক্ষে ভাস্বর হইল!
সেই নববধূ চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া আবার নাসাথে চাহিলেন, তাহাতে সকলেই করজোড়ে কহিল, আমরা সুখী, সুখী! মুক্তি মুক্তি! আঃ সৌন্দৰ্য্য!
এবং সাধক সন্ন্যাসীবর্গ নববধূর ত্রিনয়ন দর্শনে নানারূপ ধ্বনি তুলিয়াছিল, এই বলিয়া সে বিচিত্র ধ্বনি সৃষ্টি করিতে থাকে।
আঃ আধ্যাত্মিকতা! বলিতে সময় শুদ্ধা ভক্তিমতী মনিব পত্নীর দেহ পূত রোমাঞ্চে ভরিয়া উঠিল। তাঁহার আয়ত বিশাল নয়নে অশ্রু সঞ্চারিত হইল। ক্রমে যে তিনি নিস্পলক শিখাবৎ তিনি তাঁহাদের প্রিয় নীচকুলোদ্ভব ভৃত্যের প্রতি অতীব শ্রদ্ধায় চাহিয়া আছেন। আশ্চৰ্য- সে পূজা হওয়া ফুল সকল খাইয়াছে।
যে তখন সুঘরাই কহিতেছিল, আমার খাঁচাটিরে তদ্রূপ আমি সাজাইতে অভিলাষী, আমার কেন কি জানি সমগ্র সজ্জা আমার এক কালে মনে পড়ে না…তাই আমি সেই সন্ন্যাসীবর্গের মত উদাত্ত স্বরে ধ্বনি তুলিয়া থাকি, কথাগুলি আমার যদিও মনে নাই, ধ্বনি তুলিলেই আমার কিছু কিছু প্রত্যক্ষ ঘটে, আমি খাঁচাটিরে সাজাইতে চাই…সেই ছত্র, সেই বিবিধ রত্ন সমুজ্জ্বলতা সেই সামগ্ৰী সমন্বিত!
মোহিলি দেখিল ঐ ত মৃত্যু! এবং সে মন্ত্রর ধ্বনি হাঁকিল, বালকও দমে নাই–দুজনে নানা ধ্বনি তুলিতে লাগিল।
পরম বিবেকী মনিব পত্নী আশ্চর্যান্বিত হওয়ত তখনও আত্মস্থ, একদা মনে হইল, এই বালক অপরিমিত! পরক্ষণেই খাঁচার দিকে নেত্রপাত করিলেন, বুঝিলেন যে কেন সুঘরাই খাঁচার অভ্যন্তর ইদানীং সাজাইয়া থাকে, হায় সে যদি পক্ষীটিকে সাজাইতে পারিত–সঠিক থামের মত প্রলম্বিত ফুল রেখা…পূর্বে যেখানে সাজান, খাঁচার বহির্দেশই, প্রতিসম ছিল, উত্তর প্রতি-উত্তর ছিল এখন সেখানে ভেদ উপস্থিত, এক কেন্দ্র ধরিয়া নির্মাণ সঙ্ঘটিত, এক বিস্ময়! এবং তৎকালেই তিনি পক্ষীটিরে নিরীক্ষণ করিলেন, যাহা শ্রান্ত যাহা অপ্রাকৃতিক যাহা বেচারী! যে এবং তিনি অমোঘ স্বরে বলিলেন, ইহা পুরুষ! হায় তাঁহারও ভগবতীতনুর কথা মনে আসিল না!
সুঘরাই মনিব পত্নী উত্থাপিত এবম্ভূত সত্যের সমক্ষে তথাপি সমগ্র আবেগ দিয়া মহা ধ্বনি তুলিয়া সলজ্জ কণ্ঠে শুধু জানাইল, হয়ত নিশ্চয় সেই কথা এইরূপ! অবশ্য এই ধ্বনি এখন শেষের অক্ষর অর্থাৎ–’রী’ সুস্পষ্ট অভিধানে শুত হইল!
ধর্ম্মপ্রাণা মনিব পত্নী কহিলেন,–এতদিন কেন বলিসনি…আমি তেমন তেমন সাজিয়ে দেব, যা হোক এখন ডাক্তারকে আমি আসতে বলেছি, পাখীটা কেমন ধুকছে!…বুঝতে পারছি না হঠাৎ কেন এমন হল! খুব খুঁচিয়েছিস বুঝি? একে ত তাজা করতে হবে…না হলে সব বৃথা…।
সুঘরাই কহিল,–আপনি ভাবিবেন না কাল শনিবার…আমি ড়াডুপোকা উহাকে খাওয়াইব, আমাদের ঘরের পাশে ফণীমনসা হইতে পাতা চয়ন করিব…কেননা তদ্বারা ডাডু ধরা বিধেয়…ডাভু পোকা খাইলে উহার আরোগ্য হইবে…আপনি নিশ্চিন্ত হউন।