কিন্তু ঐ সঙ্কল্প, ঐ দৃশ্য তাহাকে অবাক কিম্বা থ পৰ্য্যন্ত করে না এবং ইহাও সম্ভবত যে-একারণ যে, এখন সে সম্মুখে দেখিয়াছিল কয়েকটি উলঙ্গ বালক প্রায়-উলঙ্গ বালিকা নিকটে আসিল, যাহারা রাখাল ইহারা তাহার প্রতি চাহিয়া আছে, যে বালক কাঁড়ার (মহিষ) পিঠে আরূঢ়, যে কাঁড়ারের গললগ্নি ঘন্টি বাজে, কহিল,–তোমার কি হইয়াছে, তুমি এরূপ চীৎকার কর কেন?
যে এবং এই সঙ্গে আর আর নগ্নতা সকল হইতেও ঐ একই প্রশ্ন হইল।
সুঘরাই একদা আপনকার হস্তধৃত খাঁচার দিকে চাহিল, দেখিল, ফুল আর টুঙী; এবং দেখিল, আপন প্রিয় পক্ষী ঘাবড়াইয়া আছে; আর যে নিখোঁচ কণ্ঠে উত্তর দিল,আমি ইহাকে সাহসী করিতেছি, ইহাকে নির্ভীক…ইহাকে দুর্দান্ত করিতেছি…লড়াই তাহার কাছে শুনা ডাল ভাঙার মত যাহাতে সহজ হয়!…যাহা শুনিয়াছ তাহা এক দারুণ মন্ত্র, ইহাতে তিতির দামাল হয়।
যে নগ্ন অল্পবয়সীরা ইহা শ্রবণে নিজেদের মধ্যে তর্ক করিল, নিজেদের দেহের বিবিধ স্থানে হাত দিল, কেহ চুলকাইল; সিদ্ধান্ত করিল, আরেঃ বাববা! এক হাট ভৰ্ত্তি জমিদারের বাবার বাবার বাবা, উহার মনিব, কত কত ধনী…এরূপ মন্ত্র নিশ্চয় আছে…আমরা ডিগরিয়া জানি, ত্রিকূট জানি…কত কি জানি না!…আঃ খাঁচাটি কি সুন্দর!…ঐ গোল মত ফল কেমন যেন দেখিতে, আ আমরা কিছুই জানি না; উহাকে কি বলে? কি অপরূপ সে যাহার এরূপ খাঁচা আছে…সে খুব খুব!
এবং ঐ ধ্বনির কারণ রূপে সুঘরাই সকলকেই ঐ যুক্তি দিয়াছিল। এখন সে নিঃসম্বল দৃষ্টিতে নর্দ্দমাটি দেখিতে থাকে।
শনিচারোয়া যোগ দিল,–এখন…মালীর বৌ সবই দেখিয়াছে.যে তুমি নিত্য মাঠে যাও সেই তুমি বাহির-এ পাইখানায় গিয়াছিলে…তোমার ছাড়া কাপড় সিঁড়ির পাশে আতা গাছে ছিল (এই বাড়ীর আচার অনুযায়ী) তোমার খাঁচা সিঁড়ির তলায় ছিল…তুমি উলঙ্গ অবস্থায় আসিয়া সাজান-তে ঠিক দাও…পাখীটিরে খোঁচাও…সেখানে চীৎকার ঠিক কর নাই, চাপা স্বরে কর…তুমি বিড়ি খাও না অথচ তাহাকে বলিয়াছ উহা চন্দনী বিড়ি…সে যখন জিজ্ঞাসা করে এত ধূপের মত গন্ধ কেন…ইহার অর্থ কি?
সুঘরাই এবম্প্রকার প্রশ্নে আশ্চৰ্য্য যে একটুকু বিচাল্যমান নহে, সত্যই যে সে একটি ধূপ জ্বালাইয়া বারম্বার সেই ধ্বনি তুলিতে আপ্রাণ করিয়াছে, মাঠে ঘাটে ঈদৃশী চেষ্টা হাওয়ার নিমিত্ত বৃথা হইয়াছে। তজ্জন্যই, মল্লিক লজের পশ্চাতে একমাত্র ছাদহীন বাড়ীতে সে যায় নাই।
কারণ সেখানে স্ত্রী-লোকরা বহুসময় যায়! তাই ঐ স্থান, যেখানে সম্মুখের নোনা ধরা দেওয়ালে বিরাট মাকড়সা, ও পাশের দেওয়ালের গায়ে বিশ্রীদর্শন টিকটিকি…আর যে ইতিমধ্যে সে–প্রজ্জ্বলিত ধূপ হস্তে সে পবিত্র ধূমায়িত, সে খানিক চোখ বুজাইতে শঙ্কিত, তথাপি সে নিজেকে সোজা দৃঢ় করিয়াছে এবং সে সেই বিবাহ-যাত্রার সন্ন্যাসী সাধককৃত অভিনন্দন ধ্বনি তুলিয়াছে, ফলে তাহার শরীর কেমন যেমন বেসামাল হইল, তন্ময় হইল, যেন তাহার অন্তরীক্ষে কোথাও মনিব মহাশয়ের বিছানার মত বিছানা–সে শঙ্কিত হইয়া উঠিয়াছিল–কি ব্রণ-বিরহিত শুভ্রতা! এখন এবং সে দৃপ্তস্বরে মালীকে কহিল,–সে বিড়ি খাইতেছিল।
আবার মিথ্যা!…পাপ হইবে…অবশ্য তোমরা ডোম, পাপের কি জান বটে।
আবার আমাকে ডোম বলিতেছ…দাঁড়াও মাকে বলিব…।
…কোথায় ডোম বলিলাম? ও…ও…উহা আমার মুখ হইতে…আপনি…। এবং শনিচারোয়া অসহায়ভাবে থামিয়াই আরম্ভিল,কতবার বলিলাম মোহিলিকে আবার ডাকিতে…এখনই সুরাহা হইত!…আমরা ভাবি তোমার কি হইল…!
সুঘরাই শনিচারোয়ার এই ডোম সম্বোধনে চোরা-হৃষ্ট ছিল। কিন্তু মোহিলির উল্লেখে অল্প বিমর্ষ, অবশ্য মমতাময়ী মনিব পত্নী এখনও, পরিচারিকাবর্গের অনুরোধে কর্ণপাত করেন নাই, এমনও যে স্বল্পভাষী মরদ মিয়া সে-ও এবং অনেকে তাহাকে সুঘরাইকে মাঠে মহাধ্বনি তুলিতে দেখিয়া বলিয়াছিল, ইহা এরূপ কাণ্ড ভাবিবার কথা মা!
কিন্তু তিনি মৃদু হাসিয়া ব্যক্ত করিয়াছেন উহা সুঘরাইএর উল্লাস মাত্র খাঁচাটি যেহেতু মনোরম দেখিতে হইয়াছে! কিন্তু ইদানীং সুঘরাই বেশ অনুভব করে যেন তাঁহার সেই-পরিচিত ভাব–যাহা প্রশান্ত প্রসন্নময়ক্রমে অন্তর্হিত হইতেছে; বিশেষত গতকাল সে লক্ষ্য করিল, যে তিনি পাখীটির ঘা বৃদ্ধি দেখিয়া ঔষধ দিতে থাকিয়া কহিয়াছেন,–ফের যদি দেখি খুঁচিয়েছ তাহা হইলে কিন্তু ভাল হবে না…আমি কিন্তু…।
সুঘরাই এক নূতন স্বরে কহিল,–উহা ঐ পাখী নিজের ঠোঁটেই…বিশ্বাস করুন…খুঁচাইয়া মানে…ঔষধ পৰ্য্যন্ত খাইয়া ফেলে…তাই…।
ও সব কথা থাক…খবরদার প্রাণী হত্যা হয় যদি তাহলে তোরই একদিন কি আমারই একদিন…আমি বুঝি না…ও অজ্ঞান…নড়বে চড়বে কোথায়…অত যদি তাহলে পায় দড়ি বেঁধে রাখ…সাজানর চোটে বেচারীর জল খাবার বাটিটা পর্যন্ত সরিয়েছিস, ডোম না হলে এমন নির্মম বুদ্ধি হয়।…চোখ নেই, বেচারী প্রায় ঐখানটিতে বসে থাকে…।
যে এবং তিনি পাখীটারে সোহাগ জানাইতে কালেই পুনরায় বলিলেন,–তো চন্নামেত্তর খাওয়া কেন? আমারই ভীমরতি!…তুই যে মুখপোড়া বলিস ওকে একবার মারলে আমি নিজে দশবার খাই…কৈ দেখি কোথায় তোর এমন ঘা…বজ্জাত…ঠাকুর, মাগো, এত লোককে তুমি সুমতি দাও, এই ডোম হারামজাদাকে একটু দিতে পার না…পাপ হয় জানিস না…ফের যদি খোঁচাবি!…