যে ধ্বনিতে এক অলৌকিক বিবাহ-যাত্রার ছবি!
৭. স্নেহশীলা মনিব-পত্নী
আর আর পরিচারকবর্গের কথায় স্নেহশীলা মনিব-পত্নী ইদানীং যারপরনাই চিন্তিত; সত্যই সুঘরাই ক্রমশ এক অদ্ভুত অন্ধকার হইয়া উঠিতেছিল, যেমন সে এক চরিত্র! যে সে, বৈদ্যনাথ যাওয়ার দিনের যত ব্যবধান বর্ধিত হইতে আছে, ততই যেন হন্যে, খাঁচার কাগজের ফুলের গন্ধ আর অনুপ্রাণিত নহে, বাগানের ফুল তাহাতে সঠিক স্বর শব্দ জাগায় নাই, খাঁচা সাজাইবার অভিনব উদ্ভাবনশক্তির জন্য সে উন্মত্ত আছে।
অতএব তিনি যখন শুনিয়াছিলেন যে সুঘরাই রাত্রে ঘুমের মধ্যে কি এক, কোন এক ডাক, আজকাল তুলিয়া থাকে, তখন তিনি সুঘরাইকে শুধু বলিয়াছিলেন,–মুখপোড়া রাতে হাত পা বেশ ভাল করে ধুয়ে তবে শুবি! অবশেষে মোহিলিকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। মোহিলি তাঁহারে আশ্বাস দিল, যে সে বিহিত করিবে।
সুঘরাইএর সম্বন্ধে বিবিধ খবরের পর যখন বিশেষত কয়েক দিন বাদে শুনিলেন, যে, ঘুমের মধ্যেই সে দাঁড়াইয়াছে, হাতে তাহার লণ্ঠন, এবং সে ধ্বনি তুলিতেছে! এবং যে তাহার মুখে মৃদু হাসি ছিল, যে সে পুনঃপুনঃ নাসিকা কুঞ্চিত করিয়াছে! এবং সে মাদুরে বসিয়া পার্শ্বস্থিত খাঁচাটিতে কি যেন করে! সে যেন কি বলিতে থাকে পাখীটিরে!
আদতে যাহা সুঘরাই তখন বলিয়াছে, তাহা এই যে, মা ঠাকরুণের নিকট যে কাগজের গুচ্ছ আছে তন্মধ্যে হরিৎ কাগজের পরেই যে কাগজ (যেহেতু সে ঐ রঙের নাম জানে না) সেই কাগজের ফুল করিতে মা ঠাকরুণকে বলিব, এবং সেই ফুল দিয়া সাজাইব, কেন না এখনই সেই ধ্বনি তুলিতেই আমি দেখিলাম বিবাহ-যাত্রার সেই সাজানতে সেই রঙ।
কল্যই আমি ঠাকুর ঘরের নর্দ্দমা পুনরায় শুকিব, তাহা হইলে নিশ্চয়ই আমার সমগ্র ঐশ্বৰ্য্য মনে পড়িবে, আজই নিশ্চয় হইত, হঠাৎ শনিচারোয়া আপন যদি না আসিয়া উপস্থিত হইত!
.
যে সুঘরাই, এখন দ্বিপ্রহর, প্রায় নিঝুম ঠাকুর ঘরের বাহিরের দিকের, নর্দ্দমায় আঘ্রাণ করিতে ছিল; সেখানে নানাবিধ গন্ধদ্রব্যের জল নিষ্কাশিত হয়, ধূম নির্গত হয়, সেখানে ফুলের পাপড়ী ছিন্ন, কখনও কখনও মৃদু পাখীরা জল পান করে। এখানেও যে চমৎকারিত্ব আছে, যে সুঘরাই তাহা জানিত!
শুদ্ধচারিণী মনিব-পত্নী যখনই উহা পরিষ্কার করিয়াছেন তখন সুঘরাই বাহিরে থাকিয়া পয়ঃনালীর মুখ হইতে দূরে রহিয়া কাজ সঠিক হইয়াছে কিনা তদারক করিয়াছে এবং এই সময়ে পবিত্রতার কাছে থাকিতে সে যেমন শঙ্কিত হইয়াছে–এখন ঐ নর্দ্দমায় কিছু ভীতি ছিল যে সে ডোম,তবু এখন যখন সে আঘ্রাণে ক্রমে ভরপুর এবং মুখমণ্ডল আরক্তিম, কোন একভাবে তীর্থস্থানের অপূৰ্ব্ব ধ্বনি ফুকারিতে চেষ্টান্বিত, ঠিক তেমন সময় শনিচারোয়া উপস্থিত, কহিল,–হে রে ঐখানে কি করিতেছ!
সুঘরাই থতমত, চকিতে আপন খাঁচাটি যাহা এখানে ছিল তাহা অন্যপাশে স্থাপিত করিল ও ফুল আর কিছু সুতা এবং ছুরিটি এবার হাতে লইয়া কহিল,নর্দ্দমায় ময়লা আছে কি না দেখিতেছি…!
কি দেখিতেছ? দেখিলাম, তুমি ফের সেইরূপ চীৎকার করিতেছিলে।…আমি দেখিলাম! আমি দেখিলাম!…বল এবার যে লড়াইএর মন্ত্র শিখাইতেছ নর্দ্দমাকে, লড়াইএর মন্ত্র শিখাইতেছ…!
যে সুঘরাই মাথা উন্নত করিতে চাহিলেও পারে নাই, কেননা নিকটের পিচ গাছ, কেন না পশ্চাতের ফলসা গাছ, ইহারা সাক্ষ্য দিতেছিল; তাহা সত্যই ঐ শনিচারোয়া উল্লেখিত যাহা, এখন তাহার যুক্তি নিরর্থক, যাহা অবলীলাক্রমে তদীয় জিহ্বায় আসিয়াছিল। সে তেমন স্বর লাগাইবে সিরিয়ার পিছনের মাঠে যেমত ঘটিল,–সেখানে সে খাঁচা সাজানর সরঞ্জাম রাখিয়া খাঁচাটি একহাতে লইয়া দাঁড়াইয়া, কেননা উপবিষ্ট ভঙ্গিতে সে জোর নাই ভাবিয়া, আপন সমগ্র আবেগ সৎসাহস সঞ্চয় করত সেই ধ্বনি তুলিতে থাকে।
সে ছোট্ট পাহাড়টির পাশে আছে। আজ তাহার পূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে, সে সেই শ্রুত শব্দটি পূর্ণ উচ্চারণ করিতে পারিবে! সে নিজেকে শাসাইয়াছে পৰ্য্যন্ত, যে, আজ যদি না ঠিক পার ত পাঁচ চড়! যে। এবং সে তারস্বরে, হাওয়ার বিপরীতে, সেই ধ্বনি অনুকরণে দিক সকল বিদীর্ণ করিয়াছে। তাহার নির্ধারিত অনেকগুলি তিনবার পার হইয়াও–তিনবার উচ্চারণ করিয়াও সে সফলকাম নহে।
কাগজের ফলসমূহে হাওয়া ক্ষেপিয়া উঠিয়াছে, ঝটিতি মনে হইয়াছে সন্ন্যাসী সাধকদের কণ্ঠস্বর সেখানে ফুলেতে দিব্য হইতেছে, হইয়া আছে; আর যে সে তিলমাত্র কালক্ষয় না করিয়া সেই সেই ফুলগুলি তুলিয়া কানের পাশেই ধরিয়াছে, এমত আশায় যে যদি ঐ সম্যক স্বর শুনিয়া নিজ কণ্ঠে তুলিতে পারে, তবেই তাহার সমক্ষে সেই বিবাহ-যাত্রা শোভা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে উদ্ভাসিত হইবে।
আর যে সে তেমনভাবে পক্ষীর খাঁচাটি সাজাইবে!
কিন্তু যতবার সে মনঃসংযোগ করে, ততবারই বেচারী প্রতারিত, সে বিড়ম্বিত! যে এখন কাগজের পাপড়ীতে বাঁচার-জন্য হাস্যকর আওয়াজ সেখানে, টিকটিকি ধৃত পতঙ্গ যেমন বা। যে সেই ফুলগুলির উপর আক্রোশ তাহার হয় নাই–যদিও সে বালকমাত্র–ইহারা তাহার তিতির নহে, এখন সে তাহা হৃক্ষেপ না করিয়া আবার একাগ্র হইয়াছে, যে ক্রমাগত মুখোনি প্রতিনিয়ত এক বিশেষ উচ্চারণে খেলাইতে চাহিয়াছিল।
ইতিমধ্যে এক অদ্ভুত অপ্রত্যাশিত সঙ্কল্প তাহাতে থাকিয়া থাকিয়া উৎচকিত হইয়াছে, যে সে ব্রাহ্মণ (পাণ্ডা) বাড়ীতে চুরি করিবে, বামাল বেচিবে ও পরক্ষণেই অদ্ভুত কাল্পনিক দৃশ্য উদঘাটিত হইয়াছে যে সে বামাল বেচিয়া মহুয়া কিনিল, ও তাহার ভগনীপতি মহুয়া খাইয়া শুয়োর ছানা কোলে লইয়া খুব নাচিতেছে!