তিতির পাখীটি তখন কয়েকদিনের বাচ্চা মাত্র, সুঘরাই আপনার হাতের উপরে বসাইয়া সেই পাখীটি লইয়া যায় মোহিলির কাছে, যে তখন কোদাল দিয়া জমি কোপাইতেছিল, সে তদ্দর্শনে তদীয় বক সমান লম্বা ঠ্যাং ভাঙ্গিয়া লাফাইয়া কহিল,–ছি ছি তোমার কোন কাণ্ডজ্ঞান নাই…তিতিরটি খড়ের উপর বা কোন কাটোরাতে (পাত্রে) আনিতে হয় জান না, তোমারে বলি নাই…সবে ইহার চোখ ফুটিয়াছে…খুব অন্যায় করিয়াছ!…জান না তোমার হাতে নোনা আছে…মানুষের নিজের হাত তাহার মনের কথা শুনে না–হাত ভারী খচ্চড়, কেরেট সাপ হইতেও পাজি…হাত সদ্যোজাত শিশুর দক্ষিণ প্রত্যঙ্গে যে ভূত পায় তাহা হইতেও নচ্ছার!
সুঘরাই ইহাতে মাটির দিকে চাহিয়াছিল, যে সে হয় পাঁশুটে, অথচ মোহিলির বাড়ী পর্যন্ত সারাটা পথ এই হাত দ্বারা এতক্ষণ এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতায় সে মথিত ছিল, ঐ ছোট শাবকের কম্পন তাহার হৃদপিণ্ডকে যেমন ছন্দিত করিতে আছিল এবং এক হাত হইতে অন্য হাতে শাবক রাখিয়া, শূন্য হাত গভীর কৌতূহলে আঘ্রাণ করিয়াছে…কম্পনের কি মধুর গন্ধ! কি মধুর!
সম্প্রতি মোহিলির ভর্ৎসনাতে সে বিচাল্যমান নির্জীব আছে।
মোহিলি কোদাল ফেলিয়া আসিয়া একটি স্থানে দাঁড়াইয়া মন্ত্র বিড় বিড় করিতে থাকিয়া বাম পদ দ্বারা যতদূর সম্ভব–উহা দূরে প্রসারিত করিয়া, ভূমিতে এক গণ্ডিচক্ৰ নির্ম্মাণ করিল, অদ্ভুতভাবে লাফ দিয়া গণ্ডির বাহিরে আসিল ও নানান ক্রিয়ার পর পক্ষীশাবককে গণ্ডির কেন্দ্রে বসাইয়া দিল। অতঃপর চারিভিতে অদ্ভুতভাবে হাঁক মোহিলি পাড়িল, এবার আকাশের দিকে তাকাইয়া স্বীয় বক্ষে চাপড় মারিয়া কি যেন গলাধঃকরণ করিতেই তন্মুহুর্তে মাটিতে সে নিজেই আছাড় খাইয়া পড়িয়া গোঙাইতে আছিল, এবং কাটা-ছাগলের ন্যায় সে কাঁপিতেছে; আশ্চর্য্য যে এবম্বিধ ঘটনায় পাখীটি স্থান ত্যাগ করে না; অন্যপক্ষে বালক থতমত হইয়া পলায়নে উদ্যত হইয়া তেমনই রহে, সে চিত্রার্পিত।
ক্রমে মোহিলির কর্ণদ্বয় নড়িল, এবং যে সে মাটিতে মুখ রাখিয়া অস্পষ্ট বিজড়িত কণ্ঠে কি যেন বলিতে আরম্ভিল,–এখন শোনা গেল, আমি সেই ভূত, আমি সর্বনাশ করিব, যে আমি…জল পান করি, ঐ বুতর কেন তিতিরকে শুধু হাতে বহন করিয়া আনিল, দুয়ার খুলিয়া দিল, পথ করিল; তুমি কেন দেখ নাই, এখন ফল ভোগ কর, তোমরা দুয়ার খুলিয়াছ, পথ করিয়াছ, সর্বনাশ করিব!
তদুত্তরে মোহিলি ঈষৎ তাহার নিজ স্বাভাবিক স্বরে, কি যেন কহিল, সম্ভব মার্জনা ভিক্ষায়। …আমি মরদ মিয়ার একটি ছাগল এখন বিনষ্ট করিয়াছি; আমি এখনই তোমার ও ডোমপুত্রের সৰ্ব্বনাশ করিব, ও তুমি লোহা ছুঁইলে বেশ…তোমরা রক্ষা পাইলে; কিন্তু তিতিরের রক্ত পান করিবই…কেন না যে রহস্য সূৰ্য্যকে ত্রিকূটের পশ্চাতে উঠায় আবার ডিগরিয়ার বামে এবং ডাইনে সরাইয়া ডুবায়, সেই রহস্য যেক্ষণে সবে পক্ষীতে গোড়া লাগে তাই পক্ষীশাবক কম্পিত, সেইতে বালকের হাত লাগিয়াছে যে সে চোর ছ্যাঁচড়া হইবে, উহার হাতে তাই নোনা, (নোনা মানুষের হাত, উহার হাতও নোনা) সেই নোনা লাগিয়াছে, আমি পক্ষীশাবকের রক্ত পান করিব।
মোহিলি স্বাভাবিক স্বরে মিনতি করিল।
…আচ্ছা! যেদিন পিঙ্গল বর্ণের কিদিম কাঠকোম (কাঁকড়াবিছা) খাইবে সেইদিন গোড়ালাগা উহাতে পুরা হইয়াছে জানিও…।
মোহিলি কোদাল পদদ্বারা ছুঁইল এবং অতঃপর উঠিয়া সুঘরাইকে পক্ষীশাবক সম্পর্কে অনেক নিয়ম-মানার উপদেশ দিল, আপাতত মৃৎপাত্রে ছোট কেঁড়েতে পাখীটিকে রাখার কথা কহিল, তিন হাট তিন দিন পর খাঁচা! কঞ্চি কাটার মন্ত্র তাহাকে বলিল। এবং ইহার পর তাজ্জব যে বালকের ভগনীপতি, পাখী যে অপছন্দ করিত, সেও কিছু বলে নাই!
সে, সুঘরাই, সারাদিন এক বিশ্রীদর্শন খাঁচা লইয়া ঘুরিত! আর সূর্যের দিকে সভয়ে চাহিত। কেন না সে এতাবৎ শুনিয়াছে যে সূৰ্য্য নিজে উঠে! নিজেই নিজের জমিদার! এখন জানিল অন্য কথা, যাহা কাহারও সহিত আলোচনা করাতে দিব্বি আছে। শুধু খাঁচার বাঁশ-চৌরস সময়ে নিজ গাত্রের কম্পনে ভীত হওয়ত মোহিলিকে বলিয়াছিল।
মোহিলি উত্তর দিল,–উহা হাওয়ার জন্য বা ঠাণ্ডায় ও কিছু নয়!
সুঘরাই যখন ঐ বাঁশঝোপে যে ইহা রাস্তার পাশে আছে, তির্যক নিরীক্ষণ করিতে থাকিয়া, অদ্ভুতভাবে মকরোয়ার হাত সন্ধান করিতে আছে, তৎকালেই মকরোয়া অনুচ্চ কণ্ঠে বলিল,–হে বিসরিয়ার বাপ, এই বুতরু খারাপ, খচ্চড়…আমার হাতে বড় জোর আবার চাপ দিয়াছে…আমি হোঁচট খাইতাম হে।
বিসরিয়ার বাপ ঐ বক্তব্যের প্রতিধ্বনিতে মন রাখিয়া উত্তর দিল,আহা সে বুরুমাত্র…এখন রাত্রকাল, তাই সে ভীত…নিশ্চয় স্বেচ্ছায় নহে, আরেঃ বাবা! মনিব কত ধনী, সে কিরূপে খচ্চড় হইবে।
রাতকানা মকরোয়া কোন যুক্তিতে কর্ণপাত না করত প্রকাশিল,হাঃ, শালা খচ্চড়!
যে সুঘরাই কায়িকভাবে যেমন এই ছোট তাহারার মধ্যে, তেমনই সে অন্তরেও নিমেষেই উহাদের সহিত এক; কটুক্তি এখনও বিশালতায় প্রতিধ্বনিত হইতেছে, কিন্তু যেহেতু, ক্রমে খচ্চ শব্দটিও বড় হইতে ছোট হওয়ত সৰ্বশেষে দক্ষিণের ক্ষেতের আল হইতে আসিল! তাই সে ক্ষণেক বিভেদে আছিল; এবং যে তাহাতে ইহা আভাসিত হয় যে যেন মকরোয়াতে কোন রহস্যেরই গোড়া লাগে নাই; কিন্তু তৎপ্রবর্ত্তীত অনুতাপ নহে, ছোট ছিছিও নহে, একটু অপ্রতিভ হইবার পূর্বেই পুনরপি, সেই মহাধ্বনি তুলিতে যেন মরীয়া হইল।