সুঘরাই, তাহাকে একদিন লইয়া আসিও, দুটা ভাত দিব, ঝুমুর শুনাইব…’ত্রিকূট পৰ্ব্বতই চড়ি ডুমা ছাঁটে বাঁশরে কুরু বনে সুজনোয়া’…দারুণ তিতির, অনেক টাকায় বিকাইবে গো…বড় বড় ঘাটওয়াল জোড়া (কাপড়) দিবে হে, টাকাও দিবে…হা হা যখন তাহার (তিতিরের) বিয়ের ফুল ফুটিবে, তখন আমাকে বরাৎ দিও হে, হাটে হাটে ঢেঁড়া দিব…।
এবং তৎক্ষণাৎ বিসরিয়ার বাপ নৃত্যসহ ঢেঁড়া বাজানর ছন্দে, ঢাকে কাঠি দিল, সেই মত সে বাজাইতে থাকে তিতির বিষয়ক–একের পর অন্য পদবিন্যাসের বিরতিতে, যথা…চোখ উহার কাঁটি কাঁটি, রাগিয়া গেলে লাল, মেঘ ডাকিলে বেগুন বেগুন, আবার তারার মত বটে, নদীর মত হে, আকাশ বাতাসের ছায়া, তাঁহার মাথায় বাবুদের মতন টেরী কাটা, তাহার পাখার ঝাঁপটে পোকা পালায়, তাহার ডাক যেমন বা গাডের (রেল-গার্ডএর) হুইসিল,…রেল ছাড়ল হে…।
এবার তাহার ঘুঙুর বাজিল, পুনরায় ব্যাখ্যা করিল,…তাহার চাহনিতে মকরোয়ার রাত কানা ঘুচিবে, তাহার ডাকে মাদি তিতির পাছা তুলিয়া বসে,…সে বড় জোয়ান–গাছের পাতা তাহার সামনে উড়িলে সে রুখিয়া উঠে…জাত রাজ রাজপুত…বিড়াল হুলাড় ঐ তিতিরকে ডরায়, সুঘরাই তুমি যখন দেখিবে। পাখীটা ঘেঁড়া ন্যাকড়া, ঘেঁড়া দড়িকে ঠোঁট দিয়া কজা করিয়া চেঁকি করে,…তখনই আমায় খবর দিবে…তাহার বিয়ের ফুল ফুটিয়াছে বুঝিবে…যে জোড় খাইবে।…সে যখন লড়িবে শয়ে শয়ে পয়সা পড়িবে…কত লোক হারিয়া ধূলা চাপড়াইবে।
ইহাতে সুঘরাই আপন তিতিরের গুণকীর্ত্তনে নয়ছয় আছে, যে সে মকরোয়ার কম্পনে অত্যধিক প্ররোচিত, উদ্বুদ্ধ, যে সে ইতঃমধ্যে কখন যে মকরোয়ার হাত নিজে ধরিবার মনস্থ করে–ইহা তাহার অজ্ঞাতেই; এবং সে বুঝিল যে সে ঝটিতি আপন হস্ত মুক্ত করিয়া তখনই উহার হাত ধরিল।
মকরোয়ার হাত শিরাবহুল, ও অতীব রোমযুক্ত এবং যাহা অনুভবেই সুঘরাই চমকিত হইয়াছে, যে সে হোঁচট প্রায় খাইয়াছেকীদৃশী অলৌকিক ঘটনা উহা স্পর্শে, কি এক বিহান! সে ধানক্ষেত ঝরণায় স্রোতে পা ডুবাইবে, শব্দ হইবে–নিশ্চয় ও যে তখনই সে সঠিক আরবার মহেশ্বরী ধ্বনি শব্দত দিয়া উঠিল। ইহাতে সে বিস্ময়ে ছেলেমানুষ। অথচ সে নিজে তাহা বিশ্বাস করিতে পারিল না যে উহা তাহার কণ্ঠস্বর, উহা যেমত অন্য আর কেহ!
অন্যপক্ষে রাতকানা মকরোয়া, উঃ বলিয়া সবিনয়ে জানাইল,–হে বুতরু, আমি তোমার উপর নির্ভর করি…বেসামাল হইলে আমিও হইব…আমাকে বুঝিয়া চল…আমাকে বুঝিয়া চল হে…।
অবাক যে এহেন কাতরোক্তিতে সে বিচলিত নহে, যে সে তখন আপন কর্ণে সেই মহাধ্বনির অনুরণনই কেবল শুনিতেছিল, সেই ধ্বনিকে পূর্ণভাবে নিখুঁত শব্দে জানিবার কারণে সে কেমন যেমন নিষ্ঠুর, যে এবং ক্ষণিকেই বুদ্ধি করিল যে সে ভীত ভাণে পুনৰ্ব্বার সেই আস্বাদ লইবে! সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলিয়া আছে।
তাহারা সকলেই পথ চলিতেছিল। বালসরাইয়ের অন্যধারে চড়াইয়ের পূর্ব দিকে রাঙাপড়ির শালবন সেখান হইতে মাদলের আওয়াজ আসিতেছিল, ইতিমধ্যে আঁকাবাঁকা রাস্তার বালি সাদা দেখা যায়–সুঘরাইএর চোখ ছোট হইয়াছিল, আড়ষ্ট গলায় অনুরোধ করিল,–হে বিসরিয়ার বাপ একটু ঢাকে কাঠি দাও…কেন না লক্কড়টা যদি…এবং অথচ এখন ধীর পদক্ষেপে বাজনার অপেক্ষায় না থাকিয়া সে অগ্রসর হয়, এই উত্রাইএর কোথাও বিশেষত কালভার্টের কাছে সে নিশ্চয়ই আপন কম্পিত সুযোগ পাইবে, সুতরাং! ঐ কথা।
তথাপি সে অতীব শান্ত কণ্ঠে প্রকাশিল,দেখ হে মকরোয়া আমি ইচ্ছাসুখে তোমার হাত চাপি নাই, ইহা আমি জানি তুমি বৃদ্ধ, তুমি রাতকানা…আমার কথা তুমি জান না, আমি খাওয়া দেখিয়াছি কিন্তু খাই– নাই সারাদিন…আমি উপবাসী…তাহাতে আমার দুঃখ নাই…আমার মনিবদের হইতে আমি বিচ্ছিন্ন হই– আমি এখন যেহেতু ছেলেমানুষ, লক্কড় ভীতি…।
রাতকানা মকবোয়া এই সুদীর্ঘ আধ ভাঙ্গা বাক্যবিন্যাসে যেমন বা হৃদ্বয় কুঞ্চিত করিল, অন্তত সুঘরাই ইহা অনুমান করিয়াছিল, তন্নিবন্ধন সে যথার্থই সঙ্কুচিত, যে সে আপনার কথার আওয়াজে পীড়িত, সে আপনকার বাম হস্ত এই অন্ধকারে দেখিতে উৎসুক হইল।
ভাগ্যশ বিসরিয়ার বাপ এখন ঢাকে কাঠি দিয়া ত্রিভুবনকে জ্ঞাত করিল,হি সে শালা লক্কড় পেটে যে শালা বোবা, সেই শালার পেটে মদ ছিল, লক্কড় শালা মদের আস্বাদ পাইয়াছে…মাতাল ছাড়া আর কিছু সে খাইবে না…হাঃ আমি কি দুঃস্থ, বহুদিন আমি মদ খাই নাই…আমি তালের কেঁড়ে চুষি!–ইহার অন্তে সে গাহিয়া উঠিল…।
‘ফুলল গুলাব রে ভোমরা চুষাল…’।
যদিও এহেন স্থানে ঐ প্রকারের মস্করা বিসদৃশ, তথাপি সুঘরাই যেমত স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করিয়াছে এবং সে মকরোয়াকে বলিল,-তোমাকে আমার তিতির দেখাইব…তুমি দেখিলে তাহাতে তোমার শীত গ্রীষ্ম বোধ থাকিবে না…। কিন্তু ইহা জ্ঞাত করিতে সে যেমন তটস্থ হইতেছিল, কেন না সম্মুখে বাঁশঝোঁপ, ঝটিতি সে মকরোয়ার হাত সজোরে চাপ দিল, এখন নিশ্চয়ই কম্পন উপলব্ধির আশে নহে।
মকবোয়া ইহার নিমিত্ত প্রস্তুত ছিল, ফলে সে দাঁড়াইয়া পড়িল। অন্যপক্ষে সুঘরাই সভয়ে সেই বাঁশঝোঁপ অবলোকন করিতেছিল, সে শুনিয়াছে এই বাঁশঝাঁপ বড় দুষমন, ভূত আছে; যে ভূত দুইটি বাঁশ পাশাপাশি ভূমিতে আনত করাইয়া মানুষকে মারার কল পাতে, সুঘরাই এই সংস্কারে–অবশ্যই চোরা এই সত্য যে তাহার হাতে নোনা আছে–ত্বরিতে মোহিলি হইতে প্রাপ্ত এক অমোঘ মন্ত্র মনে মনে উচ্চারিয়া আপনারেই প্রদক্ষিণ করিয়াছিল।