হায় ডোমেদের দীর্ঘশ্বাস আছে!
কিন্তু দীর্ঘশ্বাসের কারণ জানিতে সে প্রস্তুত নহে! (বিস্ময়ের যে সে নিজেকে চালিত করে) তৎপরিবর্তে, সে বেদম উল্লাসে নাচিয়া উঠিল, অবাক দায়িত্ববোধে সে উষ্ণ, তদীয় গেঞ্জী যেমত শুভ্রতর হইল; লক্কড় ভূত প্রেতকে সে বিদ্রাবিত করিতে পারে–সে হুঙ্কার দিয়া নির্ভীকতায় সামনের পথ নজর করিয়াছিল।
অপার্থিব গর্বে তদীয় গ্রীবা উন্নত দৃঢ়, ইহা আপনা হইতেই ঘটিল, ক্কচিৎ এই ভঙ্গীতে ইহাতে বুঝায় যে তিতিরস্বভাব তাহাতে অনেকদূর প্রবেশ করিয়াছে, যে তাহাতে অধুনা এই অভিব্যক্তি সম্বন্ধে ধীরে বোধ আসিল এবং সে আপনকার গ্রীবায় মহা ভাবুকতায় হাত বুলাইয়াছে।
.
সেদিনও ঠিক আর এক যশোগরিমার আশায়ে এমনই ঘটে, স্নেহবৎসলা মনিব পত্নী যখন, কাগজের ফুল সকল নির্ম্মাণ করিয়া তাহাকে দিয়াছিলেন–সেই ফুলরাজি মনোলোভা, ইহাতে পোকা নাই, ইহা শুকাইবে না, বর্ণ নিষ্প্রভ হইবার নহে এবং উহাতে পক্ষীটি তাহার বিরাগভাজন হইবে না। সে আহ্লাদিত যে কাহারও খাঁচা–যাহা রিখিয়ার হাটে আনীত হয়, যাহা মোহনপুরে আসে–এমত ফুলে শোভা বর্ধন ঘটে নাই।
সুঘরাই সচকিত পদক্ষেপে চলিতে আছে, মকরোয়ার ধৃত হাতে বার্ধক্যের কম্পন; মধ্যে মধ্যে তাহাকে অন্যত্রে লইতেছিল–এতাদৃশই আরএক কম্পন! তাহা কিছু আজব প্রকারের উমের পিছন হইতে আগত শীতের কুয়ার জলে যে উম নাই! সুঘরাইএর কোমরের ঘুনসী ঢ্যাঁটার চাবিটির পাশেই যে বাঁধা রহিয়াছে, ফলে যাহা কখনই খোয়া যাইবার নহে, এবং যাহা মাঝে মাঝে মনে পড়ে। এ কম্পন অভিনব, প্রথম যখন বনে গিয়াছিল ইহা তখনকার।
সে সুঘরাই বনসম্পদের একটি হইয়াই ব্যাঙের ছাতি সংগ্রহে ঘুরিতেছিল, তাহার স্কন্ধ যখন বৃষের তুল্য, যখন সে ভয়ঙ্কর! তখন এই এহেন কম্পন স্পর্শ করে–সবে চোখ ফোঁটা এক পক্ষী শাবকেতে।
শুধু তখন হয়ত তাহার মনে হইল বহুদিন তিতিরের সেই কম্পন ছোঁয়া হয় নাই, কিম্বা মনে হইবার আগেই তাহার গাত্রে ঝুমুরের কয়েক মাত্রা দুলিয়া উঠিল–কেননা বিসরিয়ার বাপ ঢাকে কাঠি দিয়া তখন এক ঝুমুর গাহিতেছে।
মুখে হাসি, সব্বলাশী, বাঙালি কা বিটিয়া।
কলকতা তে বেচতরে তামাকুল টিকিয়া ॥
এই ঝুমুর আন্দোলনে সে অচিরাৎ শিশুহস্তী, কিন্তু তখনই সে আপন দায়িত্ব ভুলিতেই বেচারী মকরোয়া ত্রাসে মৃদু হাহা করিয়া উঠিয়া ব্যক্ত করিল কিছু।
কিন্তু পরক্ষণেই বিসরিয়ার বাপ পথিপার্শ্বস্থিত আধা ঘুমন্ত গ্রামবাসীদের সম্বোধন করিয়া বলিয়া উঠে,–শুন শুন আমার কপাড় হে, আমার এককুড়ি দুইটি ছেলে…অনেকেই মৃত, আমায় খাইতে দিবার ভয়ে অনেক শালারা মৃত, যাহারা আছে তাহারা আমায় ফেন পর্য্যন্ত দেয় না গো…।
আবার কয়েক পদ অগ্রসর হইয়া তেঁড়া দিয়া চীৎকার করিল, তোমরা শুন, ঘরে ফিরিবার আনন্দ আমার নাই, তোমরা শুন রেলের জনম আমার জনম এক (সময়)…আমার জনম বড় দুঃখের হে, দুঃখই আমার বয়স…শুন…। এবং ঢাকে কাঠি দিয়াছিল।
তাহার কথার উত্তরে পারিপার্শ্বিক নিথর নিঝুম হইতে উৎসারিত হয়, শালা তুমি মর, তুমি মর তুমি মর লক্কড়ে তোমারে খাক!
বিসরিয়ার বাপ ইহাতে গাহিয়া উঠিল–
পাগলা মনা পাগলা মনা।
পাগলা মনা রে।
আনন্দে হরি গুণ গাও!
সম্প্রতি সুঘরাইএর দেহে অনেক কথাই আঁচড়াইতেছে, সারাদিনের নানান ফেরে সে আর একে যেন পরিবর্তিত, অনুকম্পা, করুণা আদি বহুবিধ সত্ত্বগুণ তাহাতে আছে এখন, সে পারিপার্শ্বিক আঁধারে চোখ রাখিয়া উচ্চৈঃস্বরে স্বীয় মনোভাব জ্ঞাপন করিতে প্রস্তুত বিসরিয়ার বাপ ঢাক বাজাইয়া খানিক কাহিল যেহেতু, এই উদাত্ত স্বরে বলিতে পারার জন্য সে খুসী,–বিসরিয়ার বাপ তুমি খেদ কর কেন, তুমি ইচ্ছা করিলে একটা কাঁটাহার, (কাঁঠাল) একটা পাঁঠা, এক পালি চাল খাইতে পার, তোমার ত দুঃখের কথা নহে!
বিসরিয়ার বাপ এহেন প্রশংসায় উজ্জ্বল হইয়াছে, রাতকানা মকরোয়া বেশ বুঝা গেল ঈর্ষায় হাসিয়া কহিল, কে দিবে হে…?
যে সুঘরাই একশত বিচার করিয়া বলে নাই, অথবা কি যে সে ব্যক্ত করিতে মনস্থ করে তাহা তাহার খেয়াল নাই; সে অপ্রতিভ; সে ত্বরিত নিজেই সংযত হইল অথবা সমক্ষের কোন অন্ধকার দেখাতে আকৃষ্ট; আদতে ঐ বৃদ্ধের খেদ কমাইতে সে বলিয়াছিল। এবং আরও নিশ্চয় যেহেতু এই বিসরিয়ার বাপই যে তাহাকে কুয়াতলায় সবিস্ময়ে বলে,–হ্যাঁরে বুতরু তোমার তিতির কোথায়? তিতির বিনা তুমি! আশ্চর্য্য! তোমাকে আমি চিনিয়া লইতে পারি না,…আমি ভাবি একটা গেঞ্জীওয়ালা কেহ…। সেই কারণেও হইতে পারে!
যে এখন মকরোয়ার কম্পনেই ঐ বাক্য স্মরণেই উপস্থিত যে তাহা হদিশ পাইল–যে বৃদ্ধের কুয়াতলার ঐ কথারই জন্য সৌজন্য কৃতজ্ঞতা জানাইতে এযাবৎ সে যেন সুযোগ সন্ধান করিতেছিল, কিন্তু সে অযথা সূত্র ধরিয়াছে!
এমত সময় বিসরিয়ার বাপ যে গর্বে উত্থালিত আছে, বলিল,-হা রে মকরোয়া রাতকানা, যে বুতর তোমারে অদ্য পথ দেখাইয়া লইয়া যাইতেছে, সে খুব ভাগ্যবান…আরে বাবা!…বেজায় ধনী লোকের বাড়ী কাজ করে,…বেজায় ধনী হে…তাহারা ইহারে খুব যত্ন করে, রোজ এ পোয়া চালের ভাত দেয়, কি না বল?…
এই সুঘরাই খুব চতুর হে, এ ডালিম বেদনা দেখিয়াছে…যাহা গ্রামের আর কেহ দেখে নাই…আমি, আমার কথা ছাড়…সে ডালিম বেদানা খাইতে দেখিয়াছে, আসছে জন্মে…সে বড় ঘরে জন্মাইবে…হা রে দুঃখ!…হা হা এই বুতরুর চমৎকার এক তিতির আছে…আহা ঘরকে ফিরবার টান বটে…সুখ দুঃখের সাথী সেটা…।