অহো মহেশ্বরী।
শব্দের অক্ষহীন ধ্বনিতে, ঐ চীৎকারে তদীয় তিতিরের অবাধ উল্লাসে সবটুকুই পূর্ণ ছিল; সুঘরাই যেমন এতটুকু কাহিল না, ঘুম তাহার জলে ভিজিয়া গিয়াছে, যে এবং কয়েক মুহূর্ত পরেই সে নিখোঁচ গলায় ডাকিতে পারিল,–আ গে বিসরিয়ার বাপ!
এবম্বিধ ক্ষমতায় এতাবকার সমস্ত নিষ্ফলতার ক্ষোভ খেদ চমকপ্রদ কাহিনীতে সুবিন্যস্ত হইল। সুঘরাই যারপরনাই উচ্ছ্বসিত, যে সে পুলক ফেলিতে চাহিল না; বিসরিয়ার বাপের অনেক দিনকার
কামানো দাড়িতে চিড়ার কুচি, আর মুখময় জল, যে সে, বালক, তাহার স্বজাতিকে দেখিয়াছে, সে উহাকে ছুঁইতে চাহিল, আহা কতকাল যে সে মানুষ স্পর্শ করে নাই, নিশ্চয়ই বহুকাল, বহুকালই সে দল ছাড়া বিচ্ছিন্ন হওয়ত হারাইয়াছে।
সুঘরাইএর ডাকে বিসরিয়ার বাপের পদস্থিত ঘুঙুরের আওয়াজ হইল ঢাকেও মৃদু শব্দ ঘটিয়াছিল, যে এবং সে আড়নয়নে সুঘরাইকে লক্ষ্যের সঙ্গে শুধু মাত্র ‘আরে আরে’ জ্ঞাপনের পরই আর এক গণ্ডুষ জল গ্রহণ করিল, এবার মুখোনি তুলিয়াছে, নিবিষ্টচিত্তে সেই জল আপন বক্ষে বিশেষত সিঞ্চনে ক্রমে এখন লেপিতেছিল। এত নিকট হইতে সুঘরাই কখনও ইতিপূর্বে এই বৃদ্ধকে নিরীক্ষণ করে নাই!
বৃদ্ধ বিসরিয়ার বাপ কেমন যেমন অন্যমনস্ক আছে। ইহাতে সুঘরাই সত্যই আতান্তরে পড়িল, সে ত্বরিতে আশ-পাশ জলধারা সমস্ত কিছু দেখিল, সে কি সুঘরাই নয়! তৎক্ষণাৎ আপনার গেঞ্জী খুলিতে চাহিল, অধুনা জলে আর্দ্র বদনে করজোড়ে বৃদ্ধ বড় বিষাদে এই প্রার্থনা জানাইতেছিল,বাবা বৈদ্যনাথ তুমি দুঃখের দুঃখী, হয় কত দুঃখ আছে আমার, কবে ঘুম দিবে, আর কত দুঃখ আছে গো!
এই সরলতায় সুঘরাই নিশ্চিহ্ন মনে হইল, এখনও কি আমার হদিশ হয় নাই…মনিবরা? এখনও আমি কি হারাইয়া আছি…এই বিসরিয়ার বাপ কি সত্য!
ইদানীং তাহারা বিলাসীর টিলায়, বিসরিয়ার বাপ আর একবার মন্দিরের দিকে ফিরিয়া ভগবান বৈদ্যনাথকে নমস্কার করিল, এরূপ মনোহর উহার কৃতাঞ্জলি যেমন চৈত্রের শালবন প্রতিবিম্বিত হইতে পারে, অতএব মুহূর্তেই সুঘরাইএর আর উদ্বেগ নাই–এবং যেহেতু বিসরিয়ার বাপ এ সময়ে তাহার ঢাকে তিনবার কাঠি দেয়, এ কারণ যে ঢাকের আওয়াজ বড় সাহস!
উত্তর দিকে উৎরাই পথে অজস্র জোনাকি ভয়াল চক্ষুতে পরিণত হইবার নহে। এইবার তাহাদের রিখিয়া যাত্রা শুরু হইবে। বৈদ্যনাথের ধূলি মস্তকে লওয়া হইয়াছে।
বিসরিয়ার বাপ হাঁকিল,–হেরে মরোয়া রে!
মকরোয়া নামে ব্যক্তিটি নিশ্চয় কাছে কোথাও আছে!
.
সুঘরাইএর বিসরিয়া বাপের হাঁকে, চক্ষু তখন সজল হইল এবং সে এতক্ষণে ক্ষুধা অনুভব করিল, কুয়া হইতে এতটা পথ বৃদ্ধ অনবরত তাহার রোজগার গণনা করিয়াছে, এক এক হিসাব স্মরণে ঢাকে কাঠি দিয়াছে, খেয়াল রাখিতে, যথা ভোরের গাড়ী, মোটা চেহারার যাত্রীরা তাহাকে লয় নাই, কিন্তু বিধবা বুড়ী হ্যাঁ হ্যাঁ যে মন্দিরের দিকে…কাঁদিতেছিল, সে ঢোল বাজাইয়াছে, সেই বুড়ী দুপয়সা, হ্যাঁ। হ্যাঁ…তারপর এক পয়সা…তাহার পর এক পয়সা…এই ভাবে কতবার সে হিসাব ভুলিল, এইভাবে সে নিজেরে গালি পাড়িল, কিন্তু যে তদীয় পায়ের ঘুঙুর নিয়তই বাজিয়াছে, এক সময় আচমকা আপনার গালে বুকে চাপড় মারিয়া তারস্বরে দিক বিদীর্ণ করিল,হাহা আমি দেড় পয়সার চিড়া খাইতে গেলাম কেন…রাতে ভাত খাইব কেমনে…ও হো ও হো!…আমি শালা…!
তখন তাহারা বিলাসীর অভিমুখে, এখন শিবগঙ্গা প্রায় অতিক্রম করিবে, সারা পথ সুঘরাই বারম্বার পিছনে দৃষ্টিপাত করিয়াছে, যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়, উপস্থিত বিসরিয়ার বাপের খেদোক্তিতে মহা ভীরুভাবে কহিল,–বিসরিয়ার বাপ, তুমি যদি আমার মনিবদের একবার পাণ্ডাপাড়ায়…আমার মনিব তোমাকে নিশ্চয় টাকা…
বিসরিয়ার বাপ সবেগে উত্তর দিল,–তুমি কি পাগল, তাহাদের ঠিক সময় ক্ষুধা পায়…তাহারা বড়লোক।
ইহাতে সুঘরাই, যদিও ডোম তবু, মুখ ঘুরাইল, অনেক যুক্তির উল্লেখে ইচ্ছা থাকিলেও সে অবতারণা করিল না, এবং যে সে নিজেরেই অদ্যকার দুর্দৈবের জন্য দোষী করিয়াছিল। যে তখনই এবং এক মহিমান্বিত ধ্বনিতে সে চমকিত! কেননা এই পুণ্য নগরের বিবিধ সোরগোল, জয়ধ্বনি, ইদানীং এখানে এক বিচিত্র শব্দ রণনে রূপান্তরিত হইয়াছে। এবং যে আশ্চৰ্য্য যে বালকের মনপ্রাণ তাহা উচ্চারণে দেদীপ্যমান!
ইতিমধ্যে বৃদ্ধের ‘এ গে মকরোয়া’ ডাক ও মুহুর্মুহু ঢাকের শব্দে, এক পাল্টা সাড় আসিল, আর যে ক্রমে দেখা গেল এক বৃদ্ধ কেমন একভাবে পশ্চিমের আকাশে চোখ রাখিয়া আসিতে আছে, সে যেমন খাড়া পশ্চিমে যাইবে, তদীয় পদশব্দ কাঁকরে ঘর্ষণেতে, তাজ্জব, যে যখন ব্যক্তি বেশ কাছে তখন বিসরিয়ার বাপ জানাইল,–হেরে মকররায়া অদ্য এই বুতরু তোমার হাত ধরিবে…আমি সারা রাস্তা নিজেকে শালা মারিব…আমি অতটা চিড়া খাইলাম…আমি কি…! …এই সেই মকোরোয়া…শিব ইহারে রাতকানা করিয়াছে…শালা পাপী তুই ইহার হাত ধরিবি!
ডোমপুত্র সুঘরাই অবলোকন করে মকররায়া বিষাদের হাসিতে তদীয় হাত প্রলম্বিত করিল। আর সে, শান্ত নেত্রপাতে ঐ রাতকানা বেচারীকে পর্য্যবেক্ষণ করিল, এতাবৎ তাহার মনে এহেন সঙ্কল্প থাকে, যে সে বিসরিয়ার বাপের কাছ ঘেঁষিয়া থাকিবে, এই বৃদ্ধের সেই প্রথমকার মর্মান্তিক প্রার্থনা তাহাতে কোন এক দুর্লভ স্মৃতি দিয়াছিল, যে প্রার্থনার পরে, ঐ বৃদ্ধ শতচ্ছিন্ন বস্ত্রপ্রান্ত দ্বারা একাধারে জল মুছিয়া ক্লান্তি অপনোদন করিয়া তাহার দিকে সরলভাবে হাসিল, তাহাতে সুঘরাইকে এক ঘোর দিয়াছিল যে, যেমন যে এই দুঃখময় বার্ধক্যে হাসি থাকে কেন! এখন সুঘরাই ঐ প্রলম্বিত হাতখানিতে প্রলুব্ধ–যে এবং যেইমাত্র সে ঐ হস্ত ধরিতে স্পর্শ করে যুগপৎ মকরোয়া অন্যপক্ষে সুঘরাইএর হাত ধরিল, ইহাতে ক্ষণেকেই দিক সকল প্রকৃতিস্থ হইল, এই পৃথিবীতে কখনও ঝড় হয় নাই, কিন্তু তিলেকের মধ্যেই দীর্ঘশ্বাস অবশ্য সে, বালক ফেলিয়াছে!