মনিব মহাশয় বিনীত স্বরে প্রকাশিলেন,–তুমি বৃথাই আমারে দোষারোপ কর, আমি তামাসা করি নাই, যদি করিতাম উনিও তাহা বুঝিতেন, দেখ ভঁহার মুখমণ্ডল…আর জঙ্গলে ছাড়িবার কথা উহাতে সত্যই নাই…যাহারা ভগবানকে ঐরূপ জানে তাহাদের কোন কথা বলা নিরর্থক…!
মনিব পত্নীর আজও সেই ব্রজবাসীর (এই বৈষ্ণব যিনি বৃন্দাবনে থাকেন–ইহা নাম নহে) কথা মনে হয়, তাদৃশ সদানন্দময় মানুষ কমই চোখে পড়ে, ইনি মাঝে মাঝে কলিকাতায় তাহাদের বাড়ীতে আসিতেন, পূজার দালানে থামের নিম্নে বসিয়া যাঁহাকে তিলক সেবা করিতে তিনি দেখিয়াছেন, মুখে অহরহ কৃষ্ণ নাম; ইনি বলিয়াছিলেন,–ওহো তাহা নয়, খাঁচার পাখীতে মন আরোপ কর, মন আরোপের জন্যই পাখী পোষা–এই মরদেহ খাঁচা ঐ পাখী আত্মা…এ জানাই ঠিক জানা…! এই ভাব লও!
যে উপস্থিত হিরণার টিলায় প্রধান শিক্ষয়িত্রী সাঁওতাল নৃত্যের দিনকার তত্ত্বালোচনার উল্লেখে, মনিব মহাশয় শান্ত কণ্ঠে জানাইলেন,–দাশ মহাশয়ের কথায় তত্ত্বাভিজ্ঞতা আহে, উহা সূক্ষ্ম, সামান্য মানুষে উহা কেমনে ধারণা করিবে…সাধকরা উদ্দীপনার জন্য অনেক সময় পাখী পুষিয়া থাকেন…সে কথা ধরি না, তবে আপনি জানেন, বেদনা দুঃখ বুঝে না সাধারণে…মানুষের ক্ষমতা কতটুকু, সে ডাক্তারী করিতে পারে…কোন কিছুর বেদনা স্বয়ং অন্তর্যামী নারায়ণ বুঝিতে পারেন বা তাহার অবতার যেমন। ঠাকুর পারেন…মানুষ ছার!…তবে তিনি আমাদের ভালবাসা কথাটা জানাইয়াছেন…আমাকে একজনের। বা শতজনের মৃত্যু সংঘটনের ক্ষমতা যখন দিয়াছেন তখন নিশ্চয় তিনি ভালবাসার ঐশ্বৰ্যও দিয়াছেন। তবে নিশ্চয় তাঁহাকে জানাতেই সেই ভালবাসা আসে–তবু সুঘরাইকে যখন দেখি–উনি তিতি করিয়া ডাকিলে সাড়া দেয়, অবিকল তিতিরের মতোই আসে, তেমনই অদ্ভুত পদবিক্ষেপে ঘুরে…ইহা সেদিন আমার নজরে পড়িল, ভাবিয়াছিলাম যে উহা সাঁওতাল নাচ দর্শনে শিখিয়াছে, কেন না একই ভঙ্গিমা, একই ফের, অভিন্ন–কিন্তু উনি আমার সন্দেহ ঘুচাইলেন।
মনিব পত্নী সপক্ষে কহিলেন,–হ্যাঁ ছোঁড়া বরাবরই তিতিরের মত ভাবভঙ্গী করে, জানেন…আবার ছোঁড়া তিতিরটাকে নানা কিছু শেখায়, কত খেলা…ওগো সেইটে বল না, ও ছোঁড়া খাঁচার কাঠি ভগ্ন জায়গায় নিজের আঙুল বেঁধে জোড়া দিয়েছিল–আমি ত দেখে হেসে বাঁচি না…অন্য হাতে খাঁচাটা চাগিয়ে আমায় এনে দেখালে! আমার মনে হয় ও ছোঁড়া আজন্মে পাখীটার কেউ ছিল…আমি ভাবছি ওর মুরগী কাটা ছাড়িয়ে দেব…ওতেই মনে হয় বুঝলে…এখন আমার মনে হচ্ছে…তাছাড়া যখন পুষছে তখন ভাল নিশ্চয় বাসেই…।
মনিব মহাশয়, সুঘরাই আমার ধ্রুব বিশ্বাস উহারে খুব ভালবাসে, ভয়ঙ্কর ভালবাসে….. সুঘরাই ও তাহার খাঁচা এখন আবছায়ার কিছু, সুতরাং শুধুই ভালবাসা শব্দ আপনার বিশেষত্ব লইয়া প্রকট হওয়ত মায়া ধরিতেছিল। রিখিয়ার এই বিরাট চৌদিকের সর্বত্রে–প্রধান শিক্ষয়িত্রীর আর নেত্রপাত যযা ছিল না, ভালবাসা শব্দে তদীয় অধীনরাও নিজেও যেন কু কুঁ শব্দ করত ভীত! এই স্থল বুনো, লাট্টা খাম্বার শব্দ এতটুকু স্বাভাবিক করে না, কেহই সুতরাং নিজেকে জানে না। গা কেমন যেন ছম ছম করিতে আছিল। একমাত্র সুঘরাই ভাবিতে ছিল নূতন কোন অভিনব ধারায় খাঁচাটি সাজাইবে।
.
সুঘরাই অবসাদে নৈরাশ্যে যারপরনাই ক্লীব আছে, তাহার কান্দিবার মত আর ক্ষমতা ছিল না, ইহা যে শহরের অংশ তাহাও জ্ঞান ত নাই, এখন তাহার ভাবনাতে একমাত্র যে বাস্তবতা ছিল তাহা হয় ঘুম, নিজের ঘুমকে, যাহার চেহারা যেমন বা সে স্পষ্টই প্রত্যক্ষ করে, সে বড় ভয় পাইতেছিল, ইতিমধ্যে দুয়েকবার তন্দ্রাচ্ছন্ন হওয়াতে আতঙ্কিত বটে হইয়াছে।
পশ্চিমের আকাশ তাহাকে পীষিতেছিল, কেন না সন্ধ্যা সমাগত–নিজেকে এখন তাহার প্রহার করিতে ইচ্ছা করে, সে টলিতে টলিতে যেদিকে আরও কোলাহলপূর্ণ, যেদিকে সে ঘুম ভুলিতে পারে, সেই অভিমুখে শ্লথ পদক্ষেপে চলিতে আছিল। কুয়ায় হইতে জল তুলিবার শব্দে, কুয়া বাঁধান পাথর, যে স্থলে অপেক্ষাকৃত বেশী আরামদায়ক ঠাণ্ডা, সেখানেই সে থ, সে যেমন জাগিতেছে বলিয়া তাহার মনে হইল।
এবং যে দ্রুত কয়েক পদ অগ্রসরেই সুঘরাই এক কুয়ার সম্মুখে; যে লোকটি জল তুলে, সে জল দান করিতেছিল–কেহ জল পান করে, জলকণা সকল সুঘরাইএর দেহের এখানে সেখানে ছুটিয়া আসিতেই আপনা হইতেই তাহার চেতনা হইল, যে সে অনেকক্ষণ এখানে, ও ঝটিতি কি এক শব্দরোলে তাহার দেহ পূর্ণ হইল, যাহা সঠিক বুঝিতে না পারিলেও, যাহার উদ্দেশে ঐ ধ্বনি উঠে–সেই ছবি তাহাতে ক্রমে আবছায়া খেলিয়াছে। ক্রমে ভাস্বর হইল!
.
অলৌকিক বিবাহ-যাত্রা!
আশ্চৰ্য্য যে এহেন সঙ্কটেও সে ঐ শব্দ অনুকরণে–উহার যথার্থ স্বরূপ নির্ণয়ে উথলিতও হইয়াছে; এবং ইহাতে আপন কণ্ঠস্বরের পশ্চাতে মনিব মহাশয়কে সে অনুভব করিল। আশ্চৰ্য্য জল সম্বন্ধে সে যে তৃষ্ণার্ত, নিশ্চিত ক্ষুধার্ত, সে যে ঘুম ভয়ে ভীত তথা পরোক্ষভাবে সে যে হারাইয়াছে, তাহা ক্ষণেকের জন্য খেলিয়া উঠে নাই, জলধারায় শেষ সূৰ্যছটায় সেই মহিমা উদ্ভাসিত হইতে আছিল।
যে এখন যে ব্যক্তি জলপানরত সে ঈষৎ মুখ তুলিতেই সুঘরাই যেমন বা স্তম্ভিত, তথাপি কোনমতে সে ছায়া হইতে মানুষটিকে হদিশ করণে, কুঁড়িতে প্রয়াস পাইল; যখনই সেই ব্যক্তি আপন দেহ বাঁকাইয়া এক বিরাট ঢাক কাঁধে তুলিয়া অতীব স্নেহে এক গণ্ডুষ জল লইয়া ঢাকের ছাউনিতে ছিটাইল, যেমন উহা তাহারই ন্যায় তৃষ্ণার্ত! সন্নিহিত সুঘরাই এক চিরপরিচিত নাম ধরিয়া ডাকিবার অপ্রত্যাশিত স্বর আনিতে। মরিয়া হইল, অনতিকাল পরেই সে অদ্ভুতভাবে চীৎকার করি উঠিল, ইহাতে সেই ‘অহহা মহেশ্বরী! পদের রেশ থাকে!