তদুত্তরে বালিকা কহিল,–কি করিয়া!
পুরুষবেশী বালিকা বলিল, তাই ত শুনিলাম…!
উত্তর হইল,–আমি যদি আমাকে মারি তাহাতে কাহার কি?
এই কলহ পার হইয়া দাশ মহাশয় খাঁচাটি বিশেষ তীক্ষ্ণ সূক্ষ্মতায় নিরীক্ষণ করিতেছিলেন, কেহ টর্চ ফেলিয়াছে, পাখীটি সুস্পষ্ট যাহাতে, এখানে ফুল ছিল, সুতরাং নির্মল আনন্দ প্রকাশের দিক ছিল। অতএব ছাতার কারণে আর তাঁহার খুঁং থাকে না, তিনি আনুনাসিক স্বরে স্বভাব-ভীত ভাবে প্রশংসা করিলেন,–সত্যই এবম্প্রকার দৃশ্য অমৃতবর্ষী…দেখুন কুসুম সকল, তখনই মনে হয় কোথাও এক স্বচ্ছতোয়া নদী আছে…কুসুমের বর্তমানতা…আঃ!
এমত সময় অহঙ্কার মদমত্ত সুঘরাই, যাহার মুখের নিকটে খাঁচা থাকার দরুণ, যে দেখিতে পাইল পক্ষী ঐ তুমুল আলোতে দুই একটি পোকা খাইতে চঞ্চু পৃথক করে, গোলাপী অভ্যন্তরে ক্ষণেক, খুট শব্দ হয়, গলদেশ উঠে-নামে, যে তন্নিবন্ধন বালক সুঘরাই যথার্থ অপদস্থ, কেন না পক্ষীর তাদৃশ তৎপরতায়ে তাহার কল্পনা ম্লান হইতেছে, সে আশা করে যে তাহার পক্ষী লক্ষ্মী হইয়া থাকিবে, ভদ্র থাকিবে; যে রুক্ষদৃষ্টিতে তাহাকে শাসন করে, তোমাকে এত খেলা শিখাইলাম, কসরৎ শিখাইলাম, কত কি শিখাইলাম, সবই পণ্ডশ্রম হইল, যে এবং তাহাতে, সুঘরাইতে, কোপনতা আসিতেছিল।
সে অস্ফুট স্বরে পক্ষীটিরে সাবধান করিয়াই জনসমাবেশের দিকে বড় করুণভাবে তাকাইল। তৎকালেই ঐ খাঁচাটি বিশেষ সশব্দে নড়িয়া উঠিয়াছে, যে যাহাতে সে দৃষ্টি ফিরাইতেই নিরীক্ষণ করিল, সান ফ্লাওয়ার খসিতেছে, ইহাতে সে ঝটিতি রুষ্ট এবং অন্য কাহারও বিবেচনার সময় না দিয়া খাঁচার উপর এক চাপড় মারিল, পক্ষী ত্রাহি স্বরে ডাকিল।
মনিব পত্নী তৎক্ষণাৎ বলিলেন,–এই তুই…কি করছিস…পাগল নাকি…!
মনিব মহাশয় বলিলেন,-হারামজাদা তাই বলিয়া অত জোরে চাপড় দিতে কখনও আছে…খাঁচা ভাঙ্গিয়া যাইত, পক্ষী ভয়ে পালাইত…আর বলিবেন না, সেদিন বৃথা আমার প্রায় একডজন গুলি নষ্ট হইল…ঠিক এইভাবে,…দেখ বেচারী এখনও ভয়ে অস্থির…আ হাহা, তিতি বল, বল,…নিগার কোথাকার!
দাশ মহাশয়ের কাশি স্বাভাবিক হইয়াছে এমত সংঘটনে, যাহাতে তিনি মনোজ্ঞ অনুনাসিক স্বরে, অর্গান বাদ্যযন্ত্রের কিয়ৎ রেশ আছে যাহাতে, বিস্তার ব্যাখ্যা করিলেন,–যথার্থ এতদ্দর্শনে বারম্বারই এই সত্য মনে আসে, পরম কল্যাণময় ঈশ্বর…যিনি সবার প্রভু,…মঙ্গলময় তিনি…চাহেন কেহ কাহারেও দুঃখ দিও না,.এখন এই পক্ষীর সূত্রে বলা যায়…ইহাদের আমি সৃষ্টি করিয়াছি, ইহারা আমার, ইহারাই প্রকৃতির প্রকৃতিই, আমি ইহারাই প্রকৃত!
এই পৰ্য্যন্ততে, যেন অতীব গূঢ় কিছু মীমাংসা ব্যক্ত করিতে, দাশ মহাশয় সমর্থ হইলেন; রহস্যসই করাই তাঁহাদের সাধনরীতি, যে এবং অধুনা তাঁহার গাম্ভীর্য অনুধাবনে ইহাই অনুমিত হইবে যে জীবন হইতে জীবনীর প্রতি তাঁহার শ্রদ্ধা আছে; কিন্তু তিনি নিজে যেমন জীবনীর চাপে কবে যেন মৃত…এখন কালো ছাতার পশ্চাদপট ক্রমে ইহাই বুঝায়–যেন কোন এক ছোট স্টেশনে তাঁহার লাশ পড়িয়া আছে।
এখন দাশ মহাশয় শুধু অনুনাসিক স্বর মাত্র। যে পার্শ্ববর্ত্তী নীরবতা, যাহা যেমন ধমক খাওয়া, যদিও সবাই তির্যক দৃষ্টিতে নাচ দেখে; ইহা তাঁহাকে অনুপ্রাণিত করিল, যে আবার সেই সঙ্গে তাৎপর্য্যপূর্ণ কাশির শব্দ ও অবিলম্বেই চোস্ত বাচনভঙ্গি শ্রুত হইল,–মঙ্গলময় সদাসর্বদা বলিতেছেন, নদী গিরিমালা লতাগুল্মবৃক্ষ কীটপতঙ্গের ভাষায়–তাহাদের সকলের ভাষায়…তোমরা আত্মসুখপরতন্ত্র ইহাদের খাঁচায় আবদ্ধ করিওনা…প্রকৃতিকে ফিরাইয়া দাও…ইহাদের সুখদুঃখ আমি জানি…তোমরা আত্মসুখে নিমজ্জিত…ইহাদের সুখদুঃখ বেদনা তোমরা কিছুই বুঝ না…ইহাদের পুষিও না…উহাতে পাপ হয়–!
সমবেত জনমণ্ডলী, নাচ দেখার ফাঁক মধ্যেই খুব একাগ্র, দাশ মহাশয়ের তত্ত্বাদেশ শুনিলেন, যারপরনাই পরিতুষ্ট হইলেন; সকলেই একবাক্যে এবং যে সাধুবাদ জ্ঞাপনকরত বলিলেন,-মহাশয় আপনি সঠিক চিন্তা করিয়াছেন। ইহার পর তাহারা সুঘরাই, যে অপ্রতিভ যে থতমত আছে, তাহারেই অবলোকনে ঈষৎ ভ্রূকুঞ্চিত করিলেন–সুঘরাইএর এতক্ষণ পরিবৃত উচ্চবর্ণের মধ্যেও এতটুকু আঁট বোধ হয় না, কিন্তু ইদানীং সকলের এহেন মনোভাব অনুভবে, সে খুব অস্বস্তিতে আপন প্রভুর প্রতি অসহায়ভাবে তাকাইয়াছিল।
মনিব মহাশয় যিনি এবম্ভূত দাশ মহাশয়ের বচন পরম্পরায় মৃদু হাসিতেছিলেন। তাঁহার কোন কথাই মানে লাগিবার নয়, কেন না দাশ মহাশয় শুধু বলিবার জন্যই বলিলেন, উনি কিছু আদিষ্ট পুরুষ নহেন; তাই তিনি শুধু নিবেদন করিলেন,–মহাশয় আপনি যা বলিলেন তাহা সত্য…তবে আমরা জড়…জড়বাদীর মানে…অবশ্য এক হয়, তিনি আছেন, তিনি যদি আসিয়া বলেন…তাহা হইলে অন্য কথা। আদতে ইনি, মনিব মহাশয় বলিতে চাহিয়াছিলেন, জড়বাদীর উপলব্ধ ভগবৎ প্রসঙ্গ বৃথা! কিন্তু আপনাকে, উচ্চবংশীয় সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ ইনি যেহেতু, সংযত রাখেন। এবং বরং আপন প্রিয় ভৃত্যরে। ধীরতার সহিত আজ্ঞা করিলেন,–আর পাপে প্রয়োজন নাই, ইনি যাহা কহিলেন তাহা অর্থপূর্ণ সত্যই, সুঘরাই তুই ঐ পক্ষীটিরে কল্যই জঙ্গলে ছাড়িয়া আসিবি…!
মমতাময়ী ধৰ্ম্মশীলা মনিব পত্নী তদুত্তরে স্বামীরে একান্তে লইয়া বাধা দিয়াছিলেন,–কি যে অলুক্ষুণে কথা বল…এই সন্ধ্যে মানে সবে সন্ধ্যে উতরোল, কেন মৎতে ও পাখী ছাড়বে ছি ছি…তুমি কি যে বল…মনে নাই ব্রজবাসী কি বলেছিল…পাখী পোষা কি যাতা…সে কথা তুমি ওনাকে বলছ না কেন?…অথচ মনে হল তুমি ওনাকে ঠাট্টা করলে যেন…!