তর্জ্জনী নির্দ্দেশ এক্ষেত্রে মারাত্মক, কেহ যদি ভুলক্রমে তর্জ্জনী দেখাইল, তৎক্ষণাৎ নির্দ্দেশকৰ্ত্তার তর্জ্জনী কেহ দংশন করিয়া দিয়াছে। একে অন্যরে মুষ্টিবদ্ধ করত ঐ টিনের দিকে দৰ্শাইয়াছে। আঃ স্বর তাহাদের অবাক মনোহর! তাহাদের হাঁ অনেকটা, ফোকলা যাহারা তাহাদের হাঁ তাৎপর্যপূর্ণ।
সেই দিবসই তিনি সেই আকৃষ্ট স্থানে যাহা নেহারিলেন, তাহাতে তিনি হাসিতে গিয়া কালো, যে এবং বজ্রাহত, একটি আবীজ আপনারে উন্মোষিত করিতে আছে–সূৰ্য্য ফাড়িয়া বর্ণসকল ফাড়িয়া কি এক দাম্ভিকতা। একি মাভৈঃ! কি এক মমত্ব!
উহার আঁশ সকল রোমশ, পসলা বারিপাত হেতু এক-আধ জলবসা নিটোল তাহাতে এ পর্যন্ত, কীদৃশী জঘন্য! কি লাম্পট্য! কোথাও কার এক গোপন রাত্র, শিকল-তোলার শব্দ যেখানে অহেতুক, প্রধান শিক্ষয়িত্ৰী যুগপৎ অসম্মানিত বিভীষিত হইলেন, বয়সী বালিকারা ইহা কি দেখিয়াছে? দেশের ভবিষ্যৎ অপ্রার্থিত কহিল, উহাতে বাঁশী হইবে!
ফোল্লা যে সে কহিল আমরা বাজাইব…আমি ফাষ্ট! ৩২২
অতীব বুদ্ধিমতী প্রধান শিক্ষয়িত্রী ঝটিতি চশমা খুলিলেন, বাস্তবতা ঝাঁপসা হইল। চোরা-অপম্মার তাহাতে উদঘাটিত হইল। মহা রোষে তিনি আজ্ঞা করিলেন,–যাও ক্লাসে।
তাহারা সকলে স্তম্ভিত, ধীরে পিছু হটে! কোন অবোধ কহিল,–টিফিন ত!
তিনি কর্কশ স্বরে কহিলেন,–গো! তাহারা পিছু খানিক হটিল যেন নাচে, হঠাৎ ঘুরিল, ছুটিল, তাহারা হাসিতে ছত্রাকার! ঘণ্টা বাজিল।
ইস অঙ্কুরিত ফাটা আবীজ কি অসভ্য!
আম্রবীজে তাঁহার প্রধান শিক্ষয়িত্রীর রন্ধন আউলাইল, উহা স্পর্শ করিবার কথায় তাঁহার জ্বর দেখা দেয়, তিনি বালি চাপা দিবেন? অবশেষে ঐ টিন সমেত উহা কোথাও, প্রাচীরের অন্যধারে, নিক্ষেপ করাই মনস্থ করিলেন। কয়েক দিবস পরে তিনি টর্চ হাতে, স্কুল যাইলেন। নিঃসঙ্গ স্কুল! দরওয়ান গেটে! মালীকে তিনি চিঠি ছাড়িতে পাঠাইলেন, হায়! তাঁহারে মিথ্যার শরণাপন্ন হইতে হইল। এখন টর্চের রশ্মিতে রামধনু বিচ্ছুরণে সেই বেলেল্লা, নোংরা, ব্যভিচার, শৃঙ্গার লালসা (!) উহাতে আবীজ যেন বেপথু!
প্রধান শিক্ষয়িত্রীর ভাব যেমন বা ঈর্ষান্বিত তাহা নিরীক্ষণে কিন্তু ইহা নহে।
ঐ আদিরসাত্মক বৈভব হইতে এক নিরীহ কমনীয় হরিৎ কাণ্ড উদ্ভূত যাহার শীর্ষ যুগ্ম পিঙ্গল-বেগুনী পত্ৰমণ্ডিত, ইহা কুলটার ভান এমত!
মৃদু শ্রাবণ বাতাসে দুলিতে আছে…মনুষ্য জাতি হিসাবে তিনি উহা অবলোকন করিলেন, মনুষ্য হিসাবে তাহার স্মৃতি নাই! তিনি ইংরাজি বলিতে বাঙলা, বাঙলা বলিতে হিন্দি, পুনৰ্ব্বার ইংরাজিতে আপনাকে, দাস আপনাকে, প্ররোচিত আপনাকে হুকুম করিলেন; কিন্তু টিন চাগাইয়া তুলা অসম্ভব হইল; যে তদনন্তর তদীয় মুখমণ্ডল অশ্বখুর দষ্ট হইল। তিনি ঝাঁপাইয়া পড়িলেন, এক পৈশাচিক ধ্বংসউন্মাদনায় তিনি কম্পিত, ঐ মৌনতাকে বিনষ্ট করিলেন। তাঁহার বিদ্যার ডিগ্রী অম্লান রহিল– তাঁহার সৌখীন এক লহমার অনুতাপ, স্বীকারোক্তির, নিমিত্ত এই নৃশংস দুষমনী সংঘটিত হইল!
.
ভারতের জাতীয় চরিত্রটি তাঁহার প্রধান শিক্ষয়িত্রীর কন্যাদ্বয়ের প্রতি চাহিয়াছে, ইহা তাঁহার নজরে এতক্ষণ পরে আসিল, সেই ব্যক্তি যে দাবার খুঁটির ন্যায় সকলের অজানিতে সান্নিধ্যে আসিবার কারণে বহু আসন বদলাইয়াছে, ইহা তিনি বুঝিলেন, বুঝিলেন কন্যাদ্বয় স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে না। তিনি উঠিয়া সেখানে যেখানে সুঘরাই তাহার খাঁচাটি কিছু তুলিয়া ধরিয়াছে! আর দাশ মহাশয় নৃত্য হইতে চোখ ফিরাইয়া উহাতে মনোনিবেশ করিলেন।
এবং মনিব মহাশয় উল্লাসে আপন সহধর্মিণীরে জ্ঞাত করিতেছিলেন,–তোমারে পূৰ্বেই। বলিয়াছি…দেখ…আমার কথা সত্য ত…বলি নাই হারামজাদা খাঁচা সাজাইতেছে?…দারুণ সাজাইয়াছে। যেন রেড ইণ্ডিয়ান হেড! পাখীটি কি গর্বিত দেখ…!
স্নেহশীলা মনিব পত্নী তদুত্তরে বলিলেন,-মরণ, ছোঁড়া তোকে কত বারই বারুণ না করেছি…রেতে গাছে হাতে দিতে নেই…তখন দেবতারা আসেন…সত্যিই ডেলিয়াগুলো আঃ ঐ সান ফ্লাওয়ারটা…মনে হচ্ছে এখানেই ফুটেছে…পাখীটা সাক্ষাৎ…সাক্ষাৎ…চমৎকার না!
দাশ মহাশয় এতক্ষণ নাচ উপভোগ করিতেছিলেন, ঘুঙুরের আওয়াজ–অবশ্য মাত্র পুরুষ নৰ্ত্তকদের পায়ে–গানের সঞ্চার এবং উল্লম্ফন ও দৈহিক দোলাতে তদীয় কাশির শব্দ অবধি বদলাইতে আছিল, যে তিনি তাহা সম্যক বুঝিতে পারিয়াছিলেন, এই দেহ স্থাপত্য-ধ্বনি সঞ্জাত, এখন কিন্তু আর সেই সত্যের রেশ নাই, এখন ইন্দ্রিয় সজাগ প্রায়!
একদা ছাতা বন্ধ করিতে চাহিলেন, যে তিনি নৃত্যর পশ্চাতে বৃক্ষসকল, ক্রমে দূরে রিখিয়ার নিগূঢ় আকাশ পর্য্যবেক্ষণ করিলেন! যেন সদ্য বিধবার ক্রন্দনধ্বনি শুনিলেন, (যেমন তদীয় স্ত্রীর অশৌচ বস্ত্র পরিহিত বালককে দর্শনে স্বস্তি হয়) তদনন্তর পুনৰ্ব্বার নর্তকীদের প্রতি একাগ্র কিন্তু ইউক্যালিপটসের পত্ৰমৰ্ম্মরে স্বামী-হারা বিলাপ নিশ্চিহ্ন হইল। তাঁহাকে অধৈৰ্য্য করিল–তিনি নাচ দেখিবেন! ভূমিতে পদাঘাতে উড়ন্ত ধূলায়, নৃত্যতে সাধারণ পদক্ষেপে হইতে, সকলকে উদ্বুদ্ধ করিতেছে। এমত কালে মনিব মহাশয়ের সংযম তাঁহারে আকৃষ্ট করিল, তিনি এক খাঁচা দেখিলেন।
অথচ ইতিমধ্যে সেই পুরুষবেশী বালিকাকে বেণী দুলাইয়া বলিতে শুনিলেন,–আমি যদি নিজেরে হত্যা করি মানে বিষ খাই তাহা হইলে জেল হইবে।