যে যাহা এই যে, গরুর গাড়ী রিখিয়া হইতে বেশ আসিয়া উত্তরিল বিলাসীর চৌরাহাতে–যে স্থলে পুবে দুমকার রাস্তা, পশ্চিমে জসিডি বরাবর; যেখানে তাহারা সকলেই–যখন, হর হর মহাদেব, জয় বাবা বৈদ্যনাথ ধ্বনি দিতে যাইবে, তৎসহ গললগ্নীকৃতবাস মনিবপত্নী সন্নিহিত বেলবৃক্ষের পত্রোদগম শোভা দর্শনে ‘আহা বলিবেন, যথার্থ লকারী ধ্বনি সেইখানেতেই; অতর্কিতে কূৰ্ম্মপৃষ্ঠ জমির শীর্ষভাগে, দেখা গেল কে একজনা ভূমি ছাড়িয়া অনেকটা লাফ বারম্বার দিয়া উঠে; লম্ফকারী সেইজন আপন বক্ষঃদেশে ঘন ঘন চাপড় মারিতে একটি হস্ত দ্বারা আঘাতিছে, এবং সে বেদনায় চীৎকার পাড়ে, কান্না যেমন, কিন্তু চোখে জল নাই; আর ‘ওহহ সুঁই’ কম্পিত কণ্ঠে বলিয়া উঠে।
এতাদৃশ সংঘটনে ভোরের মনোলোভা সমীরণ স্তোভ ছিল; এতাদৃশ নাটকীয়তায় শহরগামিনী সারিবদ্ধ সাঁওতাল রমণীকুলের গতি ব্যাহত হইল, ঐ লোকটির কিম্ভুত ব্যবহারে দারুণ আকৃষ্ট যে উহারা, উহাদিগের সুমহান মুখমণ্ডলে অবিশ্বাস্য ত্ৰাসজনিত কাতরতা আছে, উহারা আতঙ্কে তাই, যে তদানীন্তন কালেও তাহাদের কবরীস্থ ফুলসকলে আপন আপন অঙ্গুলির মঞ্জুল সোহাগ দিতে থাকে।
যন্ত্রণায়ে উৎক্ষিপ্ত লোকটির ছায়া আরবী হরফকার কাটিতেছিল, তজ্জন্য প্রায়শ ভগ্নস্বরে তদীয় সুতীব্র নিনাদউও হো পুঁই!
কথাটি আরও বিভীষিকা হয়। পুঁই শব্দ শ্রবণেই মোহিলি অব্যর্থই যে উৎপাটিত, গরুর দড়ি ছাড়িয়া কর্ণে অঙ্গুলি প্রদানিল; সৰ্ব্বনাশী আতঙ্কে উহার শিয়রে-বাঁধা গামছা খসিয়াছে, তথৈবচ অভিব্যক্তিতেই সে কহিল,–গে মাইরে হা মো কপহাড়! এবম্প্রকারে মহা আর্তনাদ করিল; এখন উহার খুদে চক্ষুদ্বয় হাঁইয়া হ্যাঁদা হইয়াছে, বুঝাইল, সে আর আগাইবে না।
সুঁই সুঁই রব চারিদিকে; ইহাতে সকালের আকাশে খরা, পথগুলি হইতে পরিপ্রেক্ষিত মুছিয়া গিয়া কোথাও নীলিমার ভাবান্তরে করবী ক্কচিৎ; সুঁই-এর ভয় মড়ক-অধিক, এ কারণ যে, তাহারা যে যারপরনাই কাঙাল; পুঁই এক ভয়ঙ্কর রক্তচোষা, যে যাহার ব্যথায় দিন কয়েক নির্ঘাত অপটু তাহারা হইবেক। ইহারা শহরের কৰ্ম্ম অন্বেষী; বেচারীরা প্রত্যেকেই ‘হা হতোস্মি!’ বিলাপে, ঐ শহরের প্রতি বড় গুঢ়তম বুক ভাঙা নয়নে চাহিয়া প্রত্যাবর্তন করিবে এখনই।
জনৈক ঐ উজ্জ্বল শহরের প্রতি তাকাইয়া, যে যেমন লোকপ্রসিদ্ধ বিরাট সনাতন দেউল তাহাতে সম্যক বিম্বিত-সুতরাং, সে আপন হৃদয়াবেগ জ্ঞাপন করিল, পাপ! আমাদিগেরই পাপ, বাবা বৈদ্যনাথ দেবাদিদেব, কিন্তু কে সেই জন যে এরূপ বিশ্বাসঘাতকতা করিল যাহাতে বহু কোল নিঙড়াইবে, বহু ছন্নছাড়া হইবে; হায় কে এরূপ বিশ্বাসঘাতকতা করিল–সে কত বড় পামর! যে, সে যদি শহরবাসী হয়। তাহাকে ধিক্, সে যদি বাহিরের মফঃস্বলের তাহাকে শত ধিক; তুমি বাবা বৈদ্যনাথ থাকিতে এত পাপ! জানি শত কুঠার আঘাতেও সুমহৎ বৃক্ষ যেমন ছেদনকারীকে ছায়া দিতে নিস্তেজ নহে, তদ্রূপ তুমি…কিন্তু আর ক্ষমা নহে তুমি জাগ্রত, তুমি ইহাদের তোমার ত্রিশূল দ্বারা খণ্ডিত কর, সেই বিশ্বাসঘাতকের সমুচিত শাস্তি বিধান কর। আমরা শালা জাতে অধম ছোটলোক, আমরা আলেখ কীড়া, অনেক জন্মাই অনেক মরি, আমরা রোগের ঘর…কিন্তু অদ্য, সূৰ্য্য সাক্ষী, আমরা কোন রোগ বহন করি আনি নাই। আমরা দীন, আমরা অভুক্ত, শহরের যাহা অসৎ তাহা দূরে লই, আমরাই অসৎ…এ সময় ধান পাকিবে, বহু অচেনা পাখী আসিতেছে, কুয়ার জল যেক্ষণে স্বচ্ছ, এ সময় পুঁই! ভীতি আমাদের সম্বল, আমরা ভীত, আমরা কাঁদিয়া থাকি।
সুঘরাই উক্তিসকল যেমত দেখিল; আর মোহিলি এখন, মনিবদের পীড়াপীড়িতে, উপরন্তু ইত্যাকার আশ্বাসে যে–ইহা সুনিশ্চিত শ্মশানের অপর পার্শ্বে দুধ-কাড়া ভণ্ড সাধুর ডেরা, যে প্রতি গোয়ালার নিকট হইতে আদায় করে, আস্তানার কাছেই সুঁই-এর ডেরা পড়িয়াছে, ফলে এক রশি মতন রাস্তা মোহিলি অগ্রসর হয়; পথ নিঝুম, গাড়ী রুখিয়া মোহিলি নামিল; শনৈঃ অত্যধিক সন্তর্পণে, পদক্ষেপে, শ্মশানাভিমুখে সে চলিতে থাকে; এবার সে অনেক নিসিন্দাও আতা গাছের আবডালে, তদৃষ্টে সুঘরাই মেরুদণ্ড টান করিল।
অনন্তর কিছু সময় বাদে নিদারুণ বিকারগ্রস্ত মর্মন্তুদ নখিলা রোল শ্রুত হইল, যে যাহা ক্রমে পশ্চিমের নাবাল ক্ষেতে সরিয়া অল্প রেশ সম্প্রতি, কেহ সেখানেতে ছুটিয়া আছে, সে আপাতত থামিল, দেখা গেল সে হয় মোহিলি, যে এবং গরুর গাড়ীর দিকে মুখ করত জানাইল সে-শহরে যাইবে না, সুঁইওয়ালারা শ্মশানের এই দিকে, তাই ডরে আমি রাস্তা ত্যজিয়া ক্ষেতে, যে আমি মাটির যাতনা বটে, বড় কাঙাল বটে, আমি পলাইব, পলাইব হে!
.
মোহিলি না-বাগমানিতে মাথা দুলাইল, পরে মনিবদের যথোচিত ভদ্র সুসঙ্গত অভয়বাক্যে মোহিলি সতর্ক চলনে ক্ষেত হইতে এখানে সন্নিহিত হইল, তাজ্জব যে, আপন চুটা ধরাইতে মনিব মহাশয়ের কাছে দেশলাই মাগিল; পরক্ষণেই ভূতচালিতের রকমে সে বাঁচাল, আরম্ভিল–হে রে শাললোঁ হরিজনরা, যে বেটা দুষমনরা চিনি যে কি তাহা জানে না, যে শয়তানরা হাঁটুর নিম্নে কাপড় পরিতে ভয় পায়, যে হাজতীরা (হাজতে থাকে) বাপকে শালা, আপন পুত্রকে খচ্চড়, দিবানিশি সম্বোধন করে, যাহারা মহিষের মাংস খায়, যারা ভাগাড়চারী শকুনের সহিত দাঙ্গা করে, মরা পশু খায়, হা মরি তাহারা লইবে মন্দিরের দখল! ঐ শালো হরিজনদের জন্যই এই সুঁই।