.
দেশের অবস্থা হইতে তার্কিকরা অনেক দূরে, কখনও আদিস আবাবা কখনও স্পেনে। বিগত মহাযুদ্ধ যাহারা দেখে নাই তাহারা অচিরেই লড়াই প্রার্থনা করিতেছিল, লড়াইতে আমাদের মুক্তি! এক স্বর শ্রুত হইল; এখন বলিতেছ বটে! আমি পড়িয়াছি, লড়াই সাংঘাতিক, ঘরবার দুই যায়, গীতাতেও আছে বর্ণসঙ্কর জন্মায়, বিশৃঙ্খলা!
অন্য কণ্ঠ,ঘরবার ত কিছুই নাই…যায় যাউক!
ভিন্ন কণ্ঠে,–পৃথিবী ত আপনার নয়…মানুষ কিভাবে ভুলিয়া যায় যে অন্যজনও মানুষ! সরসে আর একজন জানাইল–মহাশয় মানুষ নিজেরেই ভুলিয়া যায়। নিজেকে না মারিতে পারিলে অন্যরে মারা যায় না… এই বচসার অদূরে দেশবৎসল জাতীয় চরিত্র অন্যর প্লেটের দিকে নালমাখা চোখে চাহিয়াছিল এবং সে অনেকের প্লেট হইতে ভাগ পায়–সে পাঁঠার ন্যায় হাসে!
অন্যত্রে নৃত্য আরম্ভ হইয়াছে, এ নৃত্যে চড়াই উৎরাই, অসমতল-সমতল ভূমিতে চলনের ভঙ্গিমার বাস্তবতা আছে, ধিতাং ধিতাং নাদে মাদল বাজিতেছে, একজন নাসারন্ধ্র দিয়া যুগ্মবাঁশী মাঝে মাঝে বাজাইতেছে, যাহার আওয়াজ নাই বলিলেই হয়, সাঁওতাল, নৃত্যরত রমণীদের বাহুমূলের রেখা, পেলব থরথর স্তর সমন্বিত উন্নত বক্ষগত অংশ যাহা–পাঁজড়ায়ে সম্মোহ বিস্তার করিতেছে!
দাশ মহাশয় তেমনই ছাতা খোলা! প্রধান শিক্ষয়িত্রী ঐ নৃত্যের দুয়েক সঞ্চারী দর্শনে অস্বাচ্ছন্দ্য। অনুভব করিলেন, স্বামীর ঐ স্বাতন্ত্র অন্যের চোখে হাস্যকররূপে প্রতীয়মান হইল! তিনি কন্যাদের প্রতি তিৰ্য্যকে নেত্রপাত করিলেন, তিনি অলোকাকে নেহারিলেন, অলোকাতে জড়বাদী রমণীত্ব নাই!
যে নাসারন্ধ্র দ্বারা এবম্প্রকার প্রায় নিঃশব্দ প্রায় বংশী বাদনে প্রধান শিক্ষয়িত্রী অশেষ বিকারগ্রস্ত, যে তিনি নয়ছয়, যে তিনি কোণ-ঠেসা, যেমন যে লম্পট কিছুর সমীপে তিনি, যে এবং তিনি ধূপ ভালবাসেন, ধোপদুরস্ত বস্ত্র যে তাঁহার তৃপ্তি বর্ধন করে, এখন ঐ দৃশ্যে ইহা সকল সর্বৈব ভিত্তিহীন; অনন্তর তিনি নিজেকে ধিক্কার দিয়াছেন। যে, উক্ত কায়দায়ে ঐ বাঁশীগুলি বাজান হইয়া থাকে, এই জ্ঞান আগেভাগে থাকিলে, যে বংশীগুলিতে–খাসা নকাসীকৃত কাজ শ্রবণে তাহা দর্শন মানসে উদগ্রীব হইতেনই না, অবশ্য মূলত মনিব পত্নীর অসংযত মন্তব্য এড়াইতেই তদীয় শিল্প প্রবণতা ঘটিয়াছিল, অন্যথা বাঁশীর শিল্পকর্মের প্রতি তাঁহার আন্তরিক টান ছিল না, হায় কি বিড়ম্বনা!
ভাগ্যশ তিনি সাঁওতালটির হাত হইতে ঐ নিদর্শন লইয়া পর্য্যবেক্ষণ করেন নাই! যদি ঘটিত তাহা হইলে অনেক ইউক্যালিপটস ওয়েল, কারবলিক সাবানেও তিনি বহুদিন অশুচি রহিতেন! যে এখন নিকট হইতে তাহা দেখিয়াছেন স্মরণেই দেহমন কাহিল, কর্দমাক্ত; তিনি পান করিবার ছলে, জল চাহিয়াছিলেন, যে জল আনিল তাহার সাহায্যে হাতমুখ প্রক্ষালন খানিক আড়ালে যাইয়া করিলেন। এবং তিনি নির্মল এবং আরাম হইলেন, এঃ নাক দিয়া বাঁশী বাজান!
কিন্তু তিলেক পরেই পুনরপি বাঁশীর চেহারা, উহা বাদন কতটুকু বা তথাপি সৰ্ব্বদাই তাহার সমক্ষে, যে, এমনও যে উহাদের উৎকীর্ণ মৎস্যলতা কুসুম কেয়ারি অবধি, যাহাতে তিনি অত্রাহি, যাহাতে উৎখাত। সুস্বন লহরী, খোদাই বৃথা হইয়াছে। তৎপ্রভাবে এতেক বিপর্যস্ত বটে–যে সুললিত, রিখিয়ার হাওয়ার শব্দ সহিত অপসৃয়মাণ খৰ্ব্ব-প্রায় ক্ষুদ্র-তরঙ্গ ব্যঞ্জনা সমান ঐ নৃত্য, মাদল বাদকের চুলের ঝাঁপটা–যেহেতু সে নাচে, সমস্তই কদৰ্য্য এরূপ সংস্কার জন্মাইল। তিনি আরবার চশমা মুছিলেন।
পার্শ্ববর্তিনী যাহারা, যাহারা গ্র্যাণ্ড বলিতে ব্যস্ত, যাহারা নৰ্তকীদের গীতের অর্থ একে অন্যকে জ্ঞাত করিতেছে, যথা ‘শালফুল, আমার দেহতে পড়িতেছে আমার চালাতে পড়িতেছে, আমার ভাতে পড়িতেছে, আমি তাই গীত গাহিতে আছি।’ যে দর্শকরা গীতের অর্থ কি পর্য্যন্ত মধুর মধুর বলিতেছিল, তাহাদের সকলের দিকে, উপরন্তু কন্যাদ্বয়কে, নেত্রপাতে তিনি, প্রধান শিক্ষয়িত্রী স্বাভাবিক হইতে পারেন না, তিনি ক্রমান্বয় যেন পাপপঙ্কে যেন নরকে (!), এ নৃত্য সদ্য অঙ্কুরিত আবীজ নহে যে স্বহস্তে। উপড়াইয়া ফেলিয়া দিবেন।
৬. তিনি তাঁহার অফিস কামরা হইতে
যাহা এইরূপ–তিনি তাঁহার অফিস কামরা হইতে প্রায়শঃই লক্ষ্য করিতেন, কিণ্ডারগার্ডেনের শিশু যাহাদের তিনি দেশের ভবিষ্যৎ বলিয়া অভিহিত করিতেন, শিশু বলিয়া নহে। ইহাদের–পুরাতন মরিচা-ধরা টিনের নিকট পরিবৃত হওয়ত এক জটলা, টিফিন খাইতে থাকিয়া ইহাদের অদ্ভুত কথা কাটাকাটি চলিত!–প্রধান শিক্ষয়িত্রী রুটিন ও নানান খাতা হইতে যাহা প্রত্যক্ষ করেন, এমনও যে ক্লাস চলিবার কালে অনেক শিশুই বাহিরে আসিয়া সেই পথে গমনাগমনের সময় ঐখানে কিছু সেকেণ্ড নিশ্চল, শুধু মাথার ফিতা স্পন্দিত, কখনও স্কার্ট নড়ে, কিন্তু কোনদিনই, ব্যাপার যে কি তাহা জানিতে অবসর ঘটিয়া উঠে না।
অথচ বাল্যখিল্যরা মালীকে হটাইয়াছে, ইহা তাঁহার চোখে পড়ে, মালীকে তাহারা মারিবে ইহা শুনিলেন, হয়ত অনেক ছোট ছোট হাত উদ্যত তাহা কল্পনা করিলেন। ইহারা বৃষ্টি মানে না, উহাদের চোখ বড় হইয়াছে, কেহ মস্তকে হস্ত স্থাপন করিয়াছে, কেহ টিফিনের কিছু সেখানে দিয়াছে। এক দিবস, সেই দিন খালি রোদ, ঐ টিনের সন্নিকটে ভারী সোরগোল, তুমুল উদ্দীপনা, আমি আগে,…আমি দেখিয়াছি…না মনু ফাষ্ট তারপর আমি…!