এবং পরক্ষণেই মনিব পত্নীই কহিলেন, উদয়শঙ্কর দারুণ না! নিরাশা নামে এক নাচ, মনে পড়ে, কি লিরিসিজম, সবসময়ে আমার মনে হইয়াছে মিউজিক হ্যাঁণ্ড একটু বেশী হইলে বড় ভাল হইত…!
মনিব মহাশয় তদুত্তরে বিস্ময় প্রকাশে সমর্থন করিলেন,–যথার্থ, সত্যিই উদয়শঙ্কর একটি আনন্দ, পারকাশ্যনকে লীলায়িত, মানে অন্য যন্ত্রে…নৃত্যের রেখা আর বাদ্যধ্বনি রেখা কোথাও এক মানে…আরে আসুন…অবশ্য আমি যদিও গৃহস্বামী নহি…।
মনিব মহাশয় যাঁহারে অভ্যর্থনা করিলেন তিনি দাশ মহাশয়, প্রধান শিক্ষয়িত্রীর স্বামী, ইহার হস্তে ছড়ি, মাথায় ছাতা, গলদেশে কম্পাটার, অথচ কেহ খুব কিছু মজা পায় নাই, এমনও যে অল্পবয়সীরাও নহে, যে মেয়েটি পুরুষের পোষাকে–তাহার বয়ঃক্রম দ্বাদশ হইবে, তাহার পায়ে ডারবি জুতা, তাহার পরনে ধুতি–ইহা মালকোঁচা দেওয়া, তাহার সিল্ক-টুইলের সার্টের উপর ওপব্রেষ্ট কোট, তাহার কানে মাকড়ী, তাহার নাসার পুটে পাতলা-রিঙ, যে এবং তাহার দুই দিকের বেণীশেষে চমৎকার গোলাপী ফিতা…! ইহার ভাই নাই তাই ঐ বেশ, এই প্রকার পুরুষবেশী কিশোরী শুধু অবাক হইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া অতীব গ্রাম্য চাহনিতে দাশ মহাশয়রে নিরীক্ষণে ছিল। যে অথচ এই পুরুষবেশী কিশোরী নাক। কুঞ্চিত খ্যাঁদা করিয়া হাসিতে পারে, কপোলে টোলের উদ্ভব হয়; এক ঘটা! সে হাসে নাই, যে ইহাতে দাশ মহাশয়ের কোন হেলদোল আসে না, তিনি খোলা ছাতার কারণে অনুমতি লইলেন না, কেন না তাঁহার ইত্যাকার অভ্যাস সকলের চোখ-সওয়া!
মনিব মহাশয় পুনরায় খেই ধরিলেন,–আঃ নাচ কিভাবে যে মায়া করে!…ভাবিতে থাকিলে আমরা। বিন্দুবৎ…ষ্টেজ কি সৃষ্টি, ষ্টেজ কি দারুণ সৃষ্টি!…আপনি নাচ ভাল নিশ্চয়ই বাসেন…! ঐ যে উহারা…ঐ দল দারুণ নাচে…নানাবিধ পশুপক্ষীর ডাক শুধু সঙ্গে করিয়া আনে নাই…মানে পারে নাই, যাহা মাদল, তিন ফুটো বাঁশীর টান যোগাইয়া থাকে…তবে আনা পাভলুভা উদয়শঙ্কর ছাড়াই আমাদের ইহা ভাল লাগিবে।
দাশ মহাশয় অত্যধিক গাম্ভীৰ্য্য ধারণে সম্মতি জানাইয়া, এখন নৃত্যের জমি চৌরস দেখিলেন, কেহ জল ছিটাইতেছে, কেহ মাটি পেটাইতেছে দুরমুস দ্বারা, ছাদ-পেটাই দিয়া। আর যে ইহারই পশ্চাতে অনেক সাঁওতালী মেয়ে, তাহাদের হাস্যে যেমন বা আলো যেমন কম, আরও পশ্চাতে তখন হাড়িয়ার ভাত লাল গামছাতে ছাঁকিতেছে পুরুষেরা, মেঠো-ইন্দুর চকিতে চলিয়া যায়!
ইন্দুরগুলি উহাদের ডরায় না। এই অপ্রত্যাশিত সংস্থানের সহিত কখনও তাঁহার, দাশ মহাশয়ের পরিচয় নাই, বিদেশীর ন্যায় তিনি চাহিয়াছিলেন, একবার বিদ্যুতে খেলিয়া গেল, ইহারা নাচিবে! ততঃ দূরাগত শিয়ালের ডাক তিনি শুনিয়াছেন, এবং ছাতার নির্জনতায় তিনি স্বতন্ত্রই এযাবৎ; এখনও তাই; এইবার স্বেচ্ছায় আপনাকে মনেতে সঙ্কেত-আজ্ঞা দিলেন,নাচ হইবে! তন্মুহুর্তেই বোঙ্গা উপাসক (সাঁওতাল দেবতা) হইতে তাঁহার নিজের অদ্ভুত পার্থক্য যে তাহাই পরিষ্কার হইতেছিল।
পরক্ষণেই অল্প বাদেতেই দাশ মহাশয় সরসীবাবুকে আবিষ্কার করিয়াছিলেন। এই সেই সরসীবাবু, যে যিনি উদ্ভট, যে যিনি ত্ৰাসদায়ী। চেঞ্জারদের সহিত, স্বভাবতই আলাপ হঁহার হইয়া থাকে, আর যে যখন চেঞ্জাররা চলিয়া যায়, তাহাদের বিষয়ে তাঁহার দিব্য দর্শন সকল অন্যকে ইনি পোস্টকার্ডে জানাইয়া থাকেন; কোথাও লিখিয়াছেন, আপনাদের উনুনটি ভালভাবে ভাঙা উচিত ছিল, বলিয়াছিলাম বাড়ীটি। ভাল নয়, এই সেই দিন দেখিলাম আপনার স্ত্রী আঁচল কে যেন কাটিতেছে; কোথাও, হঠাৎ সন্ধ্যা স্পষ্ট দেখিলাম আপনি কাহাকে যেন দরজা খুলিয়া দিলেন, সেই লোকটির, আশ্চর্য্য দেখিতে সৰ্ব্বাঙ্গ ব্যাণ্ডেজ; কোথাও, অনুরূপ দর্শন ১৯২৮ হয়, আবার দেখিলাম, যে তুমি আমায় বলিলে, আমায় সি-অফ করিতে যাইবেন নিশ্চয়ই!
সুতরাং ঐ সরসীবাবুকে অবলোকনেই স্বতঃই ইহা তাঁহার মনে হয় যে, উহাকে কোন পর্যায়ে ফেলিবেন, এ কারণ যে তাঁহাদের জীবনধারা এক সূক্ষ্ম সমালোচনা হইতে উদ্ভূত, সমালোচনা তাঁহার অবলম্বন, যে কুসংস্কার তাঁহার নাই; সুতরাং পত্রের বিষয় তাঁহার আলোচ্য নহে, শুধু স্বল্পপরিচিতকে পত্র দেওয়া তাঁহাদের শিষ্টাচার বহির্ভূত; যে উহা সহবত-রহিত; আবার তৎক্ষণাৎ তিনি নিজেকে সংশোধন করিলেন, যে বিশেষ প্রয়োজন না হইলে উচিত নহে এমত পত্র দান করা। অথচ তিনি যে সরসীবাবুকে এই প্রথম দেখিতেছেন এমন নহে, যে তিনি তির্যক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করিলেন সরসীবাবু অতীব স্বাচ্ছন্দ্যে এক প্রলম্বিত হাই তুলিলেন। এই স্মরণের পর যে এবং দাশ মহাশয় স্বগত বলিলেন,-উহারাই নাচিবে।
.
সদ্যপ্রসূত শিশু, ইহা বালক, কাঁদে নাই, অত্যাশ্চর্য্য হুঙ্কার দিয়াছিল সে ঘোর গোলাপী বর্ণ হইতে, পুরীতে, সমুদ্রে, প্রথম উদিত দিবাকরের প্রায় লাল হইল, সহসা লণ্ঠন নিৰ্বাপিত আপনি! শিশুর দেহ হইতে ধূম বাহির হইল, সে নীল হইল, সেই শিশু শুধুমাত্র একটি মাত্র চক্ষুতে রূপান্তরিত পরক্ষণেই এক ত্রিকোণ বস্তু! আবার সে একটি হাত, কখনও বা একটি পা মাত্র, কখনও এক কলম; ধাত্রী চীৎকার করিল,–আরও লণ্ঠন, কি বিভীষিকা দেখ, প্রসূতির স্তন কি বিরাট হইতেছে, কি বিকট হইতেছে দুগ্ধস্রোত বহিতেছে, শঙ্খ বাজাইতে নিষেধ কর। শিশু আপন বক্ষদেশ ফাড়িয়া দেখাইল, হৃদয় নাই; কহিল,–যাহা দেখিলে তাহা সত্য, মানুষ ইহাই, তাই আমি মাতৃগর্ভ হইতে তাকাই। গৃহস্থেরা আসিল,–দেখিল সেই রূপান্তরের পুনরাবৃত্তি ঘটিল, এবং কহিল,–ইহা সৰ্ব্বনাশা, দাও ইহারে, ইহারে আমরা মাটি চাপা দিব: সেই দিবস ঝাপান ছিল, মাঠে অনেক সন্ন্যাসী–ইহা কুড়মুনের কাছে এক মাঠে ঘটে, জিলা বর্ধমান…তাহারা অন্ধকারে মৃত শিশু খুঁজিতেছিল, ঐ শিশু দর্শনে নানাবিধ রব তাহারা করিয়া উঠে, শিশুটিরে ছিনাইয়া শূল শীর্ষে বিদ্ধ করিয়া নাচিল, প্রমত্ত হওয়ত নাচিল–যে তাহারা সিদ্ধ হইবে…মেমারী আগত পুত্রহীনা বেশ্যা সনাতনী ঐ শিশুটি চাহিয়াছিল, কারণ সে তাহার অভাব পূরণ করিবে। ইহাতে দুই দল হয়, তাহারা মারপিট করে–আর সকলে অন্যেরা নাচিতেছিল।