বালকের এক হাত উত্তোলিত ছিল, উহা গরাদ ধরিয়াছিল, সে কহিল, নাচ হবে বুঝি…আমি নাচ বড় ভালবাসি, আমার বাবাও খুব নাচ ভালবাসিত, মাও ভালবাসে আমি ভালবাসি নাচ…নাচ…কতক্ষণ হইবে…রাত্র বারোটা অনেক রাত পর্যন্ত আমি জাগিয়া থাকিতে পারি…।
সকলেই নিম্নস্বরে, ‘বেচারী’ উচ্চারণ করিল।
আবার সকলেই ভারী পদক্ষেপে গেট হইতে ফিরিয়া আসিতেছে; যাহারা বিলিকে ঘিরিয়া তাহারা এহেন পদধ্বনিতে সচেতন, তাহারা ঘাড় বাঁকাইয়া পশ্চাতে নেত্রপাত করে! ইহাদের মধ্যেই জনৈক ভদ্রলোকের হাতের অন্যমনস্কতায় ছড়ির এলেবেলে আওয়াজ গ্রাভেলে সংঘাতে হইতেছে, যুগপৎ আরও অন্যান্য হস্তের ছড়ি লাঠির উৎসাহহীন শব্দ ঘটিল। সহচরীবৃন্দ এই সূত্রে অবলোক নিয়াছে যে নাচের জন্য মাঠ চৌরস করা চলিতেছে, এই ব্যক্তি কাজ করে কপাল হইতে ঘাম অপনয়ন করিল, উহার পশ্চাতে জলপানরত রমণী।
নাচ হইবে। মাদলের আওয়াজ আসিতেছে, মদ চলিতেছে! অভ্যাগতরা সকলেই এখন অনবরত একটি পদ মুখস্থ করিতেছিল, ‘পেট ত ভর’ল মহন ভরল না হে’–ইহা সাঁওতাল সর্দার মাঝি মহুয়া খাইতে খাইতে বলিয়াছে; চিড়া গুড় তাহারা পেট ভরিয়া খাইয়াছে, কিন্তু মদের অভাব! তাই মন ভরিয়া। উঠে নাই।
সাঁওতাল সর্দারের কথা, ঐ সংজ্ঞা ওষ্ঠ হইতে ওষ্ঠান্তরে! বাবুরা উহা প্রতিধ্বনিত করিলেন, বাতাস ভারী হইতেছিল, যে সাঁওতাল রমণী বক্ষবস্ত্র সামালিয়া বাঁকিয়া জল, স্বচ্ছ জল পান করিতেছিল সে। তিৰ্য্যকে চাহিল। সরসীবাবু সম্ভবত মনিব মহাশয়কে উপদেশ দিলেন,–আজ্ঞে এংগসট্রা বিটরস মিশাইয়া মহুয়া আপনি ট্রাই করিয়া দেখিতে পারেন…ভাবা যায় না! এই সেই সরসীবাবু, তখনি অতীব উদ্ভট।
আমার স্ত্রী, মহাশয় বলিয়াছি ত, একপ্রকার উন্মাদ, সেইবার শিমূলতলায় এক কাণ্ড ঘটে, আমাদের। বাড়ীর পাশেই নাম বলিব না এক সত্ৰাহ্মণবংশীয় ভদ্রলোক বাস করিয়াছিলেন, তাঁহার এক কন্যা মাত্র পঞ্চদশবর্ষীয়া, সে পরমাসুন্দরী রাজার ঘরে পড়িবার মতই, বিবাহের চার মাসের মধ্যে সে শাঁখা ভাঙে, এবং যে এই কন্যার দুঃখে দুঃখিত হইয়া তাহার মাতাও পান ও মৎস্য যাবতীয় বিলাসাদি ত্যাগ করেন। বেচারী সত্যই হতভাগিনী! পুত্রসম্ভবা ছিল। পুত্র জন্মিল, আশ্চৰ্য্য এগারো মাস সাত দিনের দিন, আমার তখনই বিশ্বাস ধ্রুব হইল, এ কোন মহাপুরুষ! আমার স্ত্রী খালাস করিবার পরে কাঁদিতে কাঁদিতে বাড়ী আসিলেন, তাঁহার মুখে, কি দেখিলাম কি দেখিলাম, শুধু এই কথা ছিল। তখন রাত্র অনেক, আমি কুয়ো হইতে জল তুলি, তিনি স্নান করেন, এই জল ধারার মধ্য হইতে জ্ঞাপন করিলেন–মহাপুরুষ! নবজাতক এক মহাপুরুষ আমি দেখিয়াছি কপালজোড়া হীরা জ্বলজ্বল করিতেছে, আহা আমি মধু দিয়াছিলাম, হায় তিনজন যমদূত আসিল, আমারে ধাক্কায় দূরে সরাইল! সময় পার-হওয়া (দশমাস দশ দিনের পর জন্ম) সন্তান যতই শ্রীমণ্ডিত হউক, ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক ঘরে রাখিতে ভরসা পান নাই। আমি, মহাশয় জানি, তিরিশ এগারং তিনশো তিরিশ প্লাস সাত, তিনশো সাঁইতিরিশ, এইবার আসুন তিন তিন সাত হইল, এইবার যোগ দিন। কত? তেরো! তেরো দারুণ শাস্ত্রসম্মত পয়া শুভ সংখ্যা! মহাপ্রভু নিজেই…আচ্ছা…আমার স্ত্রী ঐ যমদূতের পশ্চাতে ছুটিলেন, ঐ যমদূতরা বনেতে যখন হাঁড়ী রাখিল, যমদূতগুলি বিস্ময়াবিষ্ট হওয়ত দেখিল, হাঁড়ীর সরা আপনি খুলিয়া গেল, দেখিল যে; মণিময় এক শিশু উঠিয়া দাঁড়াইল; দেখিল যে, ঐ তাহাদের মানে যমদূতদের প্রতি মৃদু হাসিয়া অনেকানেক রকমের আলো বিকিরণ করত গভীর বনের মধ্যে।
সহচরীবৃন্দ তখন নৃত্য অঙ্গন প্রস্তুতি দেখিয়া পুনৰ্ব্বার বিলির দিকে; যে এবং শ্রদ্ধায় গম্ভীর হওয়ত এতাদৃশ অভিব্যক্তিতে একে অন্যে নয়ন মেলিয়াছে, যাহাতে বলিয়াছে, আমরা লাভ ম্যারেইজ শুনিয়াছি, আমরা বিলিকে শুনি নাই।
আঃ বিলি আশ্চর্য্য, বিলি আশ্চৰ্য্য, বিলি আশ্চর্য্য। উহার জন্য যে যে যুবক আত্মহত্যা করিয়াছে, আঃ বিলি! আত্মহত্যার খবরে বিলি হুঙ্কার দিয়াছে, প্রেমকাতর মাজ্জারের ন্যায় তাহাতে স্বরভেদ পরিলক্ষিত হইয়াছে, পুলিশ ইন্সপেক্টার বলিয়াছে, ডেপুটি কমিশনার এইচ. কিউ. তোমাকে দেখিতে চাহেন, তুমি নিদারুণ! ইংরাজ ডেপুটি কমিশনারের সিগারের ধোঁয়ায় বিলি অস্বস্তি বোধ করে নাই, কেননা সে হয় কালচারড তাহারে দেখিয়া ঐ ধোঁয়া নিপট হয়, তিনি বলিয়াছেন…পর পর আত্মহত্যা! বিলি তুমি ব্যবিলন…অন্তত অশোকের সময় ফিরিয়া যাও! এ শতাব্দীতে তুমি অত্যধিক, বিলি বিলি বিজ্ঞান আমাদের বিস্ময় অপহরণ করিয়াছে! জীবনধারায় এমন কোন কূট-আতঙ্কও নাই। আমরা গোবেচারা। তোমার মযাদা আমরা দিতে অপারগ!
আঃ লাভ ম্যারেজ আমরা শুনিয়াছি, আমরা কখনও বিলিকে শুনি নাই! একাবলী ছন্দে ঈদৃশী বাক্য বলিতে, সাবেক পরিবারের কুমারীগণ, তাহারা এক উপত্যকায় গিয়াছে এবং হর্ষ পুলকিত।
ওগো পুণ্য নগরী কলিকাতা। গঙ্গা বিধৌত শ্ৰীশ্ৰীকালীমাতা আশ্রিত, ভগবান রামকৃষ্ণ পদ-ছোঁওয়া তুমি, ধন্য নগরী কলিকাতা! উচ্চবর্ণের অভিজাতবর্গের কলিকাতা। বিলিকে দয়া করিও, আর যে প্রকৃতিরে অনুনয় করিও, সে যেন বিলির প্রতি দয়া রাখে।
এই সেই সরসীবাবু, যাঁহার মুখমণ্ডল ভাসা-ভাসা ভাগবৎ পাঠকারীকে বিদ্রাবিত করিবে, অবশ্য যদি নিম্ন স্থানাৎ আলো আসে। ইনি মুরারীবাবুকে দেখিলেন। তখন মুরারীবাবু তেমনভাবেই ঘুমাইতে আছেন, যদি ঘুম ইহা, যে, কোন মুহূর্তেই অথচ উঠিয়া ইনি হাসিয়া কহিবেন, আমি জাপানের সূৰ্য্যবংশীয় রাজপ্রাসাদ অন্তর্গত খিড়কির বাগানে জাফরান পদ্ম ফুটিতে দেখিয়াছি, আহা হরিদ্রা! তোমার মননে আমার চক্ষু জলভরা হউক। অয়ি আমার মহত্ত্ব। যে এবং আশপাশে দৃষ্টি সঞ্চারে ইহা তাহার অনুমান হইবে যে নাচ এখনও আরম্ভ হয় নাই।