.
সেই সাঁওতাল নাচের দিবস! আর প্রধান শিক্ষয়িত্রী যিনি বসন্তের হাওয়াকে নির্ঘন্ট্রচিত্তে শাসন করিতে পারেন বেশ তফাৎ আছিলেন।
এই বাড়ীর যেখানে কুঞ্জ গোছের, ছিটকান আলোয় দেখা যায় সাঁওতালরা পুরুষ-রমণী মিলিত সমাবেশ, চুটার ধোঁয়া উখিত, মহুয়া মদ তাহারা যেন চর্বণ করিয়া খাইতেছে! ঘুমন্ত মুরারীবাবু, ঐ শিশুকেন্দ্রিক গুলজার–যেখানে সেখানকার আধ-গ-আপ্লুত স্বর শুনিতে আছেন; কিন্তু উহা ছাপাইয়া–তাহাতে পরিতোষবাবু যিনি তাঁহার স্ত্রীর দক্ষতা বলিতে ক্রমশঃ এশা অর্থাৎ যে পুরুষ, রমণীর রহস্যময় বৈপরীত্যপরতন্ত্র বুঝিয়া মুগ্ধ বিহ্বল; ত্রাস-মিশ্র-শ্রদ্ধায় যে সদাসর্বদা আছে, সেই সেই ব্যক্তির গুমরান ধরনে, তিনি বিশদে বলিতেছিলেন, আমার স্ত্রী, নিজে ভুবনবাবুর মেজমেয়ে, যে ছেলে হওয়ার আগে খুব পাত খোলা চিবাইত, খুব চট সেলাই করিতে পারিত–তাঁহার পরম সুন্দর পুত্র। হইল, এই পুত্রের আঁতুড় দরজার পাশে আমার স্ত্রী নিজ হাতে চমৎকার দোয়াত কলম তালপত্র রাখেন–এই দোয়াত কলম তালপাতা আজও মদীয় গৃহে আছে…হ্যাঁ…রাত্র যখন নিশুতি…এক চমৎকার ফুলের গন্ধে তাঁহার তন্দ্রা কাটিয়া যায়, দেখিলেন এক তেজের মধ্যে বিধাতা পুরুষ! মদীয় স্ত্রী বুদ্ধিমতী, প্রণাম অন্তে জিজ্ঞাসা করিলেন,–প্রভু, মানুষে এত কষ্ট পাইয়া থাকে কেন! বিধাতা পুরুষ কহিলেন–যে সে জন্মায় এই কারণে।
আশ্চর্য্য যে পরিতোষবাবু কদাচ বলিলে বিশ্বাস করিবেন না বা পৃথিবীতে কত কি ঘটে আমরা কি জানি ইত্যাকার বচনে কৈফিয়ৎ কভু দেন না। মদ্যপ মনিব মহাশয় আপ্লুত স্বরের মধ্য হইতে বলিয়া উঠিলেন,–দেখ নৃত্যে জমি কি দারুণ চৌরস হইতেছে, এক অভিনব স্থাপত্যের গড়ন ও ভাঙ্গন পুনর্নির্মাণ হইবে…ডাগর নৃত্য হইবে! সুঘরাই তুমি খুবই ভুল করিয়াছ, যাও পক্ষী লইয়া আইস, সেই এ-ই জাঁকাল নৃত্য দেখিবে। ভয় পাইও না…কুকুর তোমার পক্ষীরে কিছু বলিবে না…।
সরসীবাবু যিনি মামলায়, প্রিভি কাউনসিলে তিনি বা তাঁহারা জিতিলেও, তিনি বা তদীয় পিতা সৰ্ব্বস্বান্ত হইয়াছেন, তাহাদের অট্টালিকার মৰ্ম্মর বিক্রীত হইয়া সুদূর সিংহলে গিয়াছে, বাড়ী ভাড়ার বিনামূল্যে রাবিশ দেওয়া হয় পড়িয়াছেন, এখন বাগান করেন, ইহার নিকট ছিলেন। পরিতোষবাবুই বা। কেহই এক্স-রূপে (X) পরিণত হয় না, সব সময় ইহার নাম উল্লেখ্য; ইনি সেই বিধাতা পুরুষের দুর্বল উত্তরে হাসিলেন, তখনই শিশুকেন্দ্রকে ভাঙ্গিয়া অনেক মহিলাকে দ্রুত পদে যাইতে প্রত্যক্ষ করিলেন। ইনি উদ্ভট অপ্রাকৃতিক, যে অথচ ইনি সুপুরুষ যে এবং একাহারী সংযমী! সকলকেই চিঠি লেখেন।
লোহার গেটের ছায়া গ্রাভেলে, অরকেরিয়ার গাছ হইতে মাগনোলিয়া-গ্র্যাণ্ডিফ্লোরাতে-আঃ মাগনোলিয়া কি অদ্ভুত কৌশলে তাহার পাপড়ী মেলিয়া থাকে–এ কারণ যে এই বাড়ীর গেট আগে-পাছে করিতেছিল! এ কারণ যে একটি সুকুমারমতি বালক, নবম বর্ষীয় যে মাত্র, গেটের পাল্লার সর্বনিম্ন বাতায় পা রাখিয়া, পায়ের দ্বারা ঠেলিয়া দুলিতে আছে, গেটে হাঁসকলের করুণ শব্দ উখিত হইতে থাকে, তৎসহ মাঝে মাঝে অন্য মৃদু সুখবর্ষী শব্দও আছে, যাহা একটি চাবির সংঘাত, যাহা বালকের গাত্রের দোছুটিতে (কাছা গলায়) লগ্ন আছে, যেহেতু কয়েক দিবস হয়, বালকের পিতৃবিয়োগ ঘটিয়াছে। এখন সে এখানে।
উৎসবের মধ্যে যাইতে তাহার বালকের মন সরে নাই, সকলে যখন সমীপে, যখন সকলে আপন আপন উচ্ছ্বাস-উদ্যমের নিমিত্ত সবিশেষ অপ্রতিভ, যখন সকলেই কথঞ্চিৎ বিমূঢ়, তখনও বালক পাল্লাতেই! গরাদের অন্যপার্শ্বে তদীয় দুঃখ-চাবকান মুখোনি বড় সুন্দর, বড় ক্লেশ অন্যদের দিতে ছিল; সকল সম অভিব্যক্তিতে উর্ধে তাকাইয়াছেন, ঐ ইউক্যালিপটসের চামর পাতার আরও ঊর্ধে, পুনরায় দৃষ্টি আনত ইহাদের, সমস্বরে বলিলেন, বেচারী, হায় ভগবান!
একান্তে প্রধান শিক্ষয়িত্রী আতঙ্কিত মনে তর্ক তুলিলেন,–ইহা খারাপ, এই হয় প্রকৃতই নিষ্ঠুর! ছোট ছেলে, দেখিলে প্রাণ ফাটিয়া যায়, এই নির্দোষ শিশুকে এহেন বস্ত্রে…উহাকে দোষী করা…এরূপ করার ঔচিত্য দেখি না…কবে আমাদের দেশ হইতে এই সকল যাইবে। আশ্চৰ্য কোনও ভদ্রলোক নামটা করিব না (মনিব মহাশয়) বলিয়াছেন, আমাকে ব্রাহ্মণ ভোজনে উহারা বলিতে চাহে, আমি নিশ্চয়ই যাইব…কি হৃদয়হীন!
কয়েকজনের, নারী ও পুরুষ সত্যই ঐ লৌকিকতা যে নির্দয়, এমত বুদ্ধি হয়, তাহারা সত্রাসে প্রধান শিক্ষয়িত্রীর প্রতি গভীরভাবে চোখ মেলিয়াছিলেন। তৎকালে গৃহকর্ত্রী যেখানে নাচের আয়োজন, আপনার ঘোর ছাড়িয়া, মধুর স্নেহযুক্ত কণ্ঠে জানিতে চাহিলেন, ও মা তুমি হঠাৎ।
হ্যাঁ আমাদের চাকরটি বোকা কিনা, তাই মা বলিলেন তুই উহার সহিত, ঐ জঙ্গলী ‘স্পিরিট’ কিছুতেই উচ্চারণ করিতে পারে নাই–এই বল ত স্পিরিট! (নিকটে চাকরটি ছিল) দেখুন কি মজা হয়…এই বল না…।
এই সরলতায় সকলেই অত্যধিক শোকে নিমজ্জিত, যে সকলের বক্ষঃদেশ আলোড়িত হইল, আঁখি নিষ্প্রভ ও যে সজল হইল, প্রধান শিক্ষয়িত্রী যিনি আপন উক্তি কারণে এতাবৎ কিন্তুতে, যে তাঁহার কথার সারবত্তা, বালকের চাপল্যে (!) অর্থ-সামঞ্জস্য লাভ করিল, ফলে কপালে বিকার নাই, অবশ্য তিনিও সন্তপ্ত হইলেও তাঁহার কণ্ঠে, ইহা হয় খারাপ, ইহা হয় অমানুষিকতা, আওয়াজে স্ফীত! অথচ ইহা অচিন্ত্যনীয় যে চোরা খুসী, যে ঈদৃশ এক বর্তমান এই শোকচিহ্ন এখানকার ফাজলামি হইতে রক্ষা করিবে, ইহাতে প্রশ্ন যে কঠিন কি তিনি, তাঁহার কন্যাদ্বয় ঈষৎ বিমূঢ় হইয়া তবুও ছিল।