সুঘরাই লজ্জাতে কাঁদিবে এমন, মরমে সে মরিয়াছে!
তাদৃশ সদ্য রক্তাক্ত ছাপ সকল বিস্ফারিতনেত্রে সুঘরাই দেখিতে থাকে, সে যেমন যে ইহা যে গণনা শিখিবে, ঐ এলোমেলো মুদ্রণে তাহার জিজ্ঞাস্য ছিল অঢেল, কিন্তু সে আর স্থির থাকিতে পারে না, সবেগে বাগানে গিয়াছিল দ্রুতই, কিছু গাঁদাপাতা আহরণ করত ক্ষত স্থানে চাপিয়া, ঐ কথিত স্থানে ফিরিয়া সে বজ্রাহত, তাহার মাথা আপনা হইতে আনত হইল, যে সে যেমন উচ্চবর্ণসভৃত, সে ডোম নহে, কেন না ছোটজাতদের মস্তক কখনও আনত হয় না, তাহার বেচারী নেত্রপক্ষ ভারাক্রান্ত হইল, তখনও সে হতবুদ্ধি সে তটস্থ, যে তাহাবই রক্ত তাহারই প্রাণাধিক প্রিয় পক্ষী খানিক মস্তক কাৎ করত অপূৰ্ব্ব শোভাতে চঞ্চু দ্বারা রক্ত পান করিতে একমনা আছে।
ক্রমে তদ্দর্শনে সুঘরাই শনৈশ্চর হইল, চক্ষুর্ঘয়ে জরাবর্ণ দেখা দিল, যে সে উঠানে মৃত্তিকায় দানবীয় ক্রোধে পদাঘাতে আপনারে জাগ্রত করিল, যে সে ঢেলা তুলে নাই, শুধু দৌড়াইয়া গিয়া দশ মরদ জোরে লাথি মারিল; এই রক্ষা যে লাথির সবটা অর্থাৎ পায়ের পুরা চোট, পাখীর গায় লাগে নাই, তাহা হইলে, বেচারী পাখী তৎক্ষণাৎ প্রবল বেগে উৎপাটিত উৎক্ষিপ্ত হওয়ত দেওয়ালের সংঘাতে নিশ্চয়ই মরিয়া যাইত! এখন লাথির স্বল্প ঘা’য়ে পাখীর দু-চারটি পালক খসিল আর যে পাখী ত্রাহি চীৎকারে এক কোণে যাইল, কম্পিত ছিল; ঐ আতঙ্কিত পক্ষীর ভয়ার্ত আর্তনাদ অনুরূপ তাহারও কণ্ঠে ধ্বনিত আপনা হইতেই অগোচরেই হইতেছিল, আপাততভাবে মনে হয় সে যেমন বা ভ্যাংচাইতেছে; এবং সুঘরাই নিজ বেগে বেসামাল হওয়ত, সশব্দে পতিত হয়।
ঐ শব্দে মনিব পত্নী দ্বিপ্রহরিক নিদ্রা উখিত হইয়া ঐ স্থলে যাইয়া এবং তখন সুঘরাইকে ছুটিতে দেখিয়া ও তৎসহ রক্তাক্ত মেজে প্রত্যক্ষে হা হা রব করিয়া উঠিলেন, তাঁহার মাথা কেমন করিয়াছিল, তথাপি জিজ্ঞাসিলেন,–ওরে এত রক্ত কোত্থেকে এল সব্বনাশ, তোর পাখী কৈ রে…কিরে অমন হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস…পাখী কৈ…শব্দ হল কিসের–তোর কাপড়ে রক্ত কি সব্বনাশ!
সুঘরাই আনুপূর্বিক সকল কিছুর বিবৃতি দান করিল না।
সত্বর ফার্স্ট এইড বাত্সটি লইয়া আসিয়া তাহার ক্ষতস্থানে ব্যাণ্ডেজ করিলেন, সুঘরাই আইওডিনে লাফাইতে লাগিল, মনিব পত্নী তখনও বিস্মিত হইয়া আছেন, বলিলেন, বেচারী তোর দুঃখেই বুঝি অমনধারা ক্যাঁক্যাঁ করে উঠল! আমি বলি বেড়াল টেড়াল…!
সুঘরাই এখনও দারুণ রোষদগ্ধ, তাদৃশ বীভৎস কদর্য্য দৃশ্যে সে মতিচ্ছন্ন, তাহার ওষ্ঠ কাঁপিতে আছে, প্রকাশিল যে,–বেড়ালে ধরিলে খুব ভালই হইত, ঐ পক্ষী রাক্ষসী উহাকে আর সে পুষিবে না…উহা রাক্ষসী ভূত পেত্নী…আপনি শুনিলে বিকল হইবেন যে, উহা আমার রক্ত নির্ঘ মনে মাড়াইল, ঐ দেখুন সারা মেজেতে উহার রক্ত লাগা পায়ের দাগ, তখনও কিছু বলি নাই, দেখিলাম সে আমার রক্ত খাইতেছে, আমি রাগিয়া যাই আমি লাথি মারি আমি পড়িয়া যাই! উহা পেত্নী মনে হয়, উহাতে পেত্নী ঢুকিয়াছে নিশ্চয়…এই বার তাহার চোখে জল আসিল। এ বিষয়ে সে মোহিলিকে খবর দিবে।
স্নেহময়ী মনিব পত্নী তাহারে ভর্ৎসনা করিয়াছিলেন এইরূপে যে, তুই ছোঁড়া মহা পাগল,…দেখছি সাক্ষাৎ পাপ তুই–যা আগে কাপড় ছাড়…ফের যদি করিস তোর কান ধরে উনি বার করে দেবেন– পরে সান্ত্বনা দিয়াছিলেন,–দেখ দেখি কি কাঁপছে বেচারী, তুই না ওকে দারুণ ভালবাসিস…ওর কি জ্ঞান আছে…ও সব করবে, তুই তাতে মারবি কেন…তুই না বলিস আমাকে যে, মা আমাকে তি তি করে ডাকবে আমি আসব…তুই না সিরিয়া পাহাড়ে ওর নাম লিখবি!…ছোঁড়া উনি শুনলে তোকে আস্ত রাখবেন…তোর পাখী হারাতে উনি না খুঁজতে যান, কত টোটা নষ্ট হল (সেদিন অবশেষে মল্লিক লজের পশ্চাতে ভাঙা বাড়ীর কাছে যখন গুলি ছোঁড়া হইল তখন-তিতির কোথা হইতে বাহির হইয়া উড়িল–এবং একজন যুবক ও যুবতী, ইহাদের মুখ পাংশু ছিল। যুবতী শুনি, দুল হারাইয়াছিল, তাই যুবকের সহিত খুঁজিতেছিল)…ওর গায়ে পা দিলি!নমস্কার কর ছোঁড়া, ওতে না ঠাকুর আছেন? ও অমন হবে কেন…জানিস ওদের চোখেও জল আছে, নে ছোঁড়া নমস্কার কর শিগগীর।
সুঘরাই আপনার পক্ষীরে নমস্কার করিল। তিতিরটি গ্রীবা তুলিয়া সুঘরাইকে দেখিতে আছে। সুঘরাইএর দেহ সুমহৎ বেপথু খেলিয়া উঠিল, একদা শ্রাবণের ঘোর শ্যামবর্ণ মেঘের নিকট সে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল যে, সে পাখীটিকে বুকে রাখিবে, সে পিঙ্গল রক্ত স্রোত স্পর্শ করিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল যে সে পাখীকে বুকে রাখিবে, যে সে গম্ভীর অশ্বত্থ বৃক্ষের নবোদগত পত্র স্পর্শে প্রতিজ্ঞা করে যে সে উহাকে বুকে রাখিবে!
৫. প্রধান শিক্ষয়িত্রীর কন্যা
প্রধান শিক্ষয়িত্রীর কন্যা তেমনই শান্তকণ্ঠে তাহার মাতাকে অনুজ্ঞায় জানাইল, মা গো, এই সুন্দর স্থানে তুমি এনড্র মারভিলের সেই ‘অন এ ড্রপ অফ ডিউ’, আবৃত্তি কর না, কি মায়াময় স্থান ইহা হয়। যে–একবার বলিলেও মনে হইল সে যেমন বা এক বক্তব্য তিনবার বলিতেছে।
প্রধান শিক্ষয়িত্রী ঐ প্রশংসায়ে ছেলেমানুষ হইয়া থাকেন, সগর্বে ঝটিতি কহিলেন, তোমার আবৃত্তি আমি শুনিব–এবং তখন সুঘরাইকে নিকটে আসিতে দেখিয়া কিয়ৎ তাঁহার সারমর্ম নীতিসূত্র করার বৃত্তি হইতে, খানিক পূৰ্ব্ব-তর্কসূত্রে নিজের যুক্তি প্রতিষ্ঠাকল্পে, অবশ্য ইনি ঈষৎ খুসী ছিলেন যে, মনিব মহাশয় তর্ক নিয়ম অনুযায়ী করিতে পারেন নাই, মাত্র নিজের জাত্যাভিমান, যদি তাহা ব্যক্তিত্ব। হয়, তবে তাহাই ব্যবহার করিয়াছেন, আরও যে তিনি প্রমাণিতে চাহেন,–মনিব পত্নীর নাকছাবিতে হাত দেওয়াতে, ইহা সেকেলে যে তাঁহার নাকছাবি নলক দাগ নাই, আরও, আর যে তাদৃশী বিতর্ক তাহার ভাল লাগিতেছিল; তৎপ্রভাবিত সংজ্ঞাভূত করিলেন,–নিশ্চয় মানিবেন–কোন প্রাণী বিশেষত…এই সব জিনিষ পোষা ভাল নয়…সেদিন যেমন উনি স্বামী বলিতে ছিলেন…মনে পড়িবে।