চশমাটির ফ্রেমে ঠিক দিয়া প্রধান শিক্ষয়িত্রী অল্প হাসিলেন অর্থ এই যে কাহারও বিদ্যার অভিমানকে চোট দেওয়া তাঁহার অভিপ্রেত নহে কহিলেন বটে আপনার যুক্তি অন্যায় মানিবে না, বলা যায় পক্ষপাত অর্থাৎ শূন্য নহে…(!) আপনি একটি অনৈমিত্তিক বৃত্তিরে রাসিওনলাইজ করিতে। চাহিতেছেন…আমরা দৈনন্দিন জীবনেতে…জীবনের মধ্য হইতে অনেক তত্ত্বাভিজ্ঞতা লাভ করিতে পারি, তখন সিদ্ধান্ত হইবে যে, কথিত ঐ প্রকার খুনসুড়ী বা তদর্থবাচক শব্দ যে কোন…যে কি পৰ্য্যন্ত বিঘাতক…উদাহরণস্বরূপ ভাই-ভাইএর তাদৃশ পরস্পরের প্রতি আচরণ, কালে কলহ এবং যে কলহের। পরিণামে পরিবারের সকলেরই মর্মপীড়ার কারণ হয়,…এইরূপে প্রতিবেশীতে ও সমাজে বিশৃঙ্খলতা…আমরা দেখিব যে লঘুতা খেয়ালখুসী, বড়ই দুঃখজনক, বড় ব্যথার কারণ হয়…ঈশ্বর বড়ই…।
ক্ষমা করিবেন, যতদূর মনে হয় ভগবান উহার, সুঘরাইএর জন্য লজ্জা পাইবেন না…আর যে, আপনি যাহা বলিলেন তাহাতে বুঝায় উহারে আইন অনুগ করা–এবং যুগপৎ তিনি কহিলেন,–দেখুন দেখুন এবং তৎসহ দেখ দেখ সম্বোধনে আপন সহধর্মিণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিলেন সুঘরাইএর প্রতি, তদীয় গাত্রে জামা সত্ত্বেও ইহা ওতপ্রোত যে সে প্রজ্জ্বলিত কিছু শিখা সকল, তিব্বতীয় টঙ্ক যাদৃশ–তেমনই, এখন ডিগরিয়ার একদিকে সূৰ্য, তাহারই কিরণমালা, সুঘরাইএ প্রতিফলিত! মনিব মহাশয় জ্ঞাপন। করিলেন,–তাজ্জব সে মনে হয় প্রজ্জ্বলিত ও দুঃখিত, দেখুন উহার বা উহাদের ভগবান নাই।
প্রধান শিক্ষয়িত্রী এবম্প্রকার উক্তিতে অত্রাহি হইলেও, তাঁহার অধীনারা বিমূঢ় হইলেও, সকলেই এককালে সুঘরাইকে লক্ষ্যে অভিভূত ক্রমে তাহারা সকলে চীৎকাঠের বাঁধ, ও অগণন তালবৃক্ষ ও সিজেল জাতীয় বৃক্ষ (!) মহিমা আর অনেক সম-বিসম ইদানীং ফলসা-টে উঁচু নীচু জমির পিছনে ডিগরিয়ার দক্ষিণে মারচস্ সূৰ্য্য দেখিল! তাহারা বিমোহিত। ইহাদের মধ্যে পার্শী সাড়ী পরিহিতা সম্ভ্রান্ত সৌভাগ্যবতী যুবতী কহিল,–যে ঈশ্বর আছেন তাহা উহারে…জ্ঞাত করা বিধেয়…আঃ ঈশ্বর বলিয়া সে আপনকার উত্তমাঙ্গ বড় নিশ্চিন্তে অলৌকিক নির্ভাবনায় রিখিয়ার বৈভবের চারিদিকে ঘুরাইল। সে। নিকটে ছিল, সুতরাং বৈকালিক প্রসাধনে ব্যবহৃত জলসেকের আর্দ্রতার, এখনও, এত ভ্রমণেও, চাকচিক্য প্রতীয়মান, পার্শী কায়দায় সে বড় দূরে ছিল, তাই সে অদৃশ্য।
তাহার ঐ বাক্য মনিব দম্পতি, যাঁহারা ধর্ম্মবিশ্বাসে অন্ধ, ভগবান বলিতে যাঁহাদের নয়ন সজল হয়, তাঁহারা সমস্ত সৃষ্টি হইতে হস্তদ্বয় তুলিলেন, মনিব পত্নী গললগ্নিকৃতবাস হইলেন, আপন আপন জুতা ত্যাগ করিলেন ও বক্ষস্থলে করজোড় স্থাপন করিলেন। তাঁহারা অপূৰ্ব্ব শোভা ধারণ করিয়াছিলেন। অতঃপর এবং ঐভাবেই মনিব মহাশয় বলিলেন, আমার ধ্রুবজ্ঞান যে বালক আপনার ধর্ম্মবিশ্বাস আপনি বহন করিতেছে।
মনিব পত্নী তদীয় সমৃদ্ধ পুষ্ট দেহ দুলাইয়া এদিক সেদিন নজরের পর শান্ত স্বরে সুঘরাইকে আজ্ঞা করিলেন,–আ মোল যা ছোঁড়া সন্ধ্যেবেলা বলেছি না স্থির হয়ে থাকতে হয়, এত ঘুঘুর করছিস কেন মরণ…! কাছে কাছে থাক না–ইহাতে এই শেষোক্ত পদে ইনি কিছু ব্যক্ত করিলেন,এখানে আয়…ও লজ্জা কচ্ছে বুঝি, বুঝেছি খবার পাখীটারে কষ্ট দিস নি…শুনলি ত ওতে পাপ হয়!
এবম্ভূত অভিযোগে, সুঘরাই বটেই যে নিগৃহীতই ছিল, যদ্যপি যে সে সহজ হইতে উন্মুখ, কিন্তু সে আপনাকে প্রকৃতই শান্ত রাখিতে লায়েক না, সে অসংলগ্ন হইয়া আছে; সে মনিব পত্নীর উপর যারপরনাই ত্যক্ত বিরক্ত হইতে সাহসী হইয়াছে; নিশ্চয়ই সে ভাবিয়াছে যে এত লোকসমক্ষে তাহাকে হেয় করা (!) সঙ্গত হয় নাই ও তপ্রভাবে সে দূরে থাকে, এবং সপক্ষে এই কথাই তাহাতে উত্থাপিত হয় যে সে বিবেচনা করে যে, যে কেন এই শালা!–এবং এই শালা উচ্চারণেই সে সচেতন যে, তাহার কোথাও এতক্ষণ গৰ্ব্ব হইতেছিল–অর্থাৎ আপন পাখীর কারণে ঐ গঞ্জনা তাহার গৌরব–যে সে আত্মপ্রসাদে, যাহা এইরূপে ব্যাখ্যা করা যায় যে, তবু ত অর্থাৎ তবু ভাল ইহা যে সে তদীয় পক্ষীর হেতুতে কথা শুনিতে আছে! পুনরায় সুঘরাই আপন পক্ষীর দিকে নজর রাখিয়া ইহা যেন কহিতে লাগিল যে:
এই শালা, এখন, যে, এই বিরাট জবা রঙ টিলায় ঘুরিতে ফিরিতে আছে শালা, তোমার জান না বড় খচ্চড়, কিছু দিন পূর্বে আমি যখন খাঁচার কাঠি বদলাইতে সারাইতে কাঠি চৌরস করি, একনিষ্ঠভাবে মোহিলির দেওয়া মন্তর উচ্চারণ করিতেছিলাম, যদি না করি তাহা হইলে, ভূত খাঁচার কাছে আসিবে; ভূত খাঁচায় ঢুকিবে, উহাকে বধ করিবে…আমি যে কত উহারে ভালবাসি…আমার তিতির তখন আমার কোলেই বসিয়াছিল, মন্তরের মাঝে মাঝে আমি তাহার সহিত গল্প করিতেছিলাম, আশ্চৰ্য্য যে সে আমার কোল সে নোংরা করে নাই, আমার হাতে ধারালো ছুরি, বাঁশ ফাড়িয়া দুই একটি কাঠি সবে মাত্র তৈয়ারী করিয়াছি হঠাৎ এমত সময় পাখী নড়িতেই আমার এই আঙুলটি কাটিয়া যায়, যে অনেক রক্তপাত হইল, আমার পরনের বস্ত্রে কিছু পড়িল,…অনেক অনেক মেজেতে; আমি লাফাইয়া উঠিয়া পড়িলাম, আমার এত আদরের পাখী শালা কিছুই বুঝে না; পাখী দূরে দূরে অবশ্য আমার দিকে চাহিয়াছিল, শুনিয়াছি…পাণ্ডাঠাকুরের ময়না পাখী। পাণ্ডাঠাকুর মরিতে অনেক কাঁদিয়াছিল, দু-তিনদিন কিছু গ্রহণ করে নাই, শুনিয়াছি বদরীবাবুর কুকুর, তিনি মরিতে, পাগল হয়।…দেওঘর হইতে দারগা আসিয়া তাহাকে গুলি করে! বেচারী।–অনেক রক্ত দর্শনে আমাতে ঘোর উপস্থিত, আমি আঙুল চাপিয়া বসিয়া পড়ি, প্রথমে পাখীটি আমার সেই পতিত রক্তের উপর দিয়া নিৰ্ব্বিবাদে চলিয়া যায়, মেঝেতে অনেক পায়ের রক্তাক্ত ছাপ অবলোকনে আমি ভীত হই–আঃ নাট্যকাররা কি সুদক্ষ কি চতুর, এহেন ভীতিকে চমৎকার স্বগত উক্তিতে রাখিয়া থাকে!