এবং আপনাদের স্তবস্তোত্রের অনুরণনেও শিবগঙ্গার শীতলতায় উহার, সেই বালকের, দেহ মন পরিবর্তিত আর যে তাহাতে এই শুভ বুদ্ধি মনে হয় জন্মে যে শিবই প্রাকৃতজনের অদ্বিতীয় জ্ঞান এবং ইহাতে সে স্মিতহাস্য করিতে চেষ্টিত হইয়াছিল…আপনারা শাশ্বত ধর্মের, মন জানে, সূক্ষ্মগতি অভিজ্ঞ আপনারা, বলুন, তাহার ঐ ভাব যেন সত্য হয় এবং এখন ধর্ম্মপ্রাণ আপনারা এই লৌকিক খবর কি বলিবেন যে সে কোথায় গেল?
কিন্তু তিনি জিজ্ঞাসিতদের উত্তর আন্দাজে, অনুৎসাহে যে সকল কুসুম শিবগঙ্গার পাপহারিণী জলস্তরে হতাদরে ভাসে অধুনা সেই সেইতে নেত্রপাত করিলেন, এখন তদীয় ক্ষুণ্ণ মানসে ফুলগুলি, ফুলগুলি, ফুলগুলি!
অনেক সন্ন্যাসীর মধ্যে এক তেজঃপুঞ্জ কলেবর ভস্মাবৃত সন্ন্যাসীর নিকট তিনি যাইয়া প্রণতি পুরঃসর কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদিলেন,–ভগবন, যে বালক অশ্রুভারাক্রান্ত নয়নে, স্বীয় মস্তকোপরি হস্ত রাখিয়া আপনাকে অবলোমাত্রেই থ হয়, সুতরাং আপনাদের মতন সন্ন্যাসীর সম্পর্কে মোহিলির উল্লেখ তাহার খেয়াল নাই; আবার ক্ষণেক পরেই সেই বালক এক আতঙ্ক দেখিল, সে দেখিল সমক্ষে থাকিয়াও নাই–এর মধ্যে আপনি আপনার ধুনির অমোঘ তর্জ্জনী আছে, সে দেখিল আপনার ধুনিতে সূর্যের যাত্রাপথ পুড়িয়া খা হইয়াছে।
সে নাসিকা কুঞ্চিত করে–আমরা জানি যে ঐ ধুনিতে পানপাত্রের কিনারের আঙুরলতা কেয়ারী করার সভ্যতা দাহ্যমান, মানুষ নিজেকে ভালবাসার নামে নিজেকে সজ্ঞানে যে তামাসা ব্যঙ্গ করিয়াছে– কত না ব্যঙ্গ উক্তি রচনা করিয়াছে–তাহারই পোড়া গন্ধ আপনার অনিৰ্ব্বাণ ধুনি হইতে নির্গত, ধূম্রজাল অনেক ঊর্ধ্বে উঠে, ইহাতে উজ্জ্বল হংসযুথ বহুদূর হইতে নিশানা পাইতেছে অথচ চন্দ্রসূর্য নক্ষত্রাদি বহুকাল হয় আপনার দিমণ্ডলে নাই–এই জটিল ঘটনা আবৰ্ত্ত কথা যেন সেই বালকও জানিয়াছে, কেন না সে নিশ্চিন্ত ছিল। অথবা এইজন্য সে স্থবির যে আপনার দর্শনে অবশ্যই সুদুর্লভ স্পন্দনরহিত যাতনা তাহাতে যেমন প্রভাবিত হইয়াছে!
অভ্রান্ত ইহা যে আপনার দিব্যদেহই পূৰ্ব্বদৃষ্ট সেই শোভাযাত্রার গূঢ়তম মন্ত্রগুপ্তি এবং যে আপনি অলৌকিক নগ্ন, আপনি অজর দুঃখবোধ, অলৌকিকী দুখের দুখী আপনি…হে মহাত্মন, হে ভেদজ্ঞানহীন, এখন যদিস্যাৎ অভেদজ্ঞান বিচারে সেই বালকটিরে নজর করিয়া থাকেন, আপনি লোকহিতকামী সৰ্ব্বজ্ঞ বলুন সেই অল্পবয়সী, যে বালকত্বে অপরিসীম, সে কোথায়?
.
ঐ মহাপুরুষের ধুনি গন্ধে সুঘরাই নাসিকা আবার কুঞ্চিত করিতেই সে শুনিতে পাইল তালপাতা পথের কাঁকরে ঘর্ষণে ভারী বিশ্রী আওয়াজ উঠে…পরক্ষণেই প্রতীয়মান যে ঐ তালপাতার উপরে একটি মৃত কুকুর বাঁধিয়া রাখা; এক অদ্ভুতদর্শন লোক, অনেকাংশে তাহার ভগ্নীপতির মতন দেখিতে, এক দীর্ঘ তালপাতার ডাঁটা ধরিয়া টানিতে থাকিয়া মন্থরে আসিতেছে, লোকটি চমৎকার কণ্ঠে গান গাহে এবং কোঁচড় হইতে মাঝে মাঝে যেন কি খাইতেছিল। পথচারিগণ মৃতের পচা দুর্গন্ধে নাকে কাপড় দিয়াছে, থুথু ফেলিতে ফেলিতে চলে।
ঐ বিষমত্বে অন্যপক্ষে সুঘরাই যেন জমিয়া উঠিল, ইহা তাহার নিকট অন্ন, ইহা জল! সে মুষ্টিবদ্ধ করিল, তাহার ক্রন্দনের কোনই কারণ নাই, সে নিবিষ্টচিত্তে ইহা লক্ষ্য করিল যে অনতিদূরে এক গাড়ঢ়ায়ে সেই মৃত কুকুরটিকে ফেলা হইল। তখনই সে যেমন বা নিজের সূত্র পাইল, তখনই দ্রুত পদসঞ্চালনে সে সেখানে–যেখানে আর কিছুকাল পরেই শকুন আসিবে; ধৰ্ম্মত সে আপনার অহঙ্কার ফিরিয়া পাইল, তাহার অজ্ঞানতা! পুনরায় লাভ করিল, পচাগলা পূতিগন্ধময় যাহা কিছু তাহার সহিত তাহার কি অবিচ্ছেদ্য যোগ! সে সুখী, সে হারাইবার নহে।
যেখানে, চাতালেই, কোন অতীব নিষ্ঠাবান আচারী ব্রাহ্মণ, সূৰ্য্যকে যিনি একাগ্র মনেতে জল-অর্ঘ্য দেন, ইহারই নিকট, ঐ কৰ্ম্মানুষ্ঠানশেষে ঐ সুঘরাই কল্পিত রীতিতে মনিব মহাশয় অবতারণা করিলেন–এক ছেলেমানুষ চপলমতি আপনকার অধরের প্রহেলিকাময়ী কম্পন হেরিয়া ও যুগপৎ সূৰ্য্য তথা নভোস্থল প্রতি নেত্রপাতে কিছু এক সমাধান উদ্দেশ্যে এতই অচেতন থাকে, যে তাই অসাবধানবশতই, আপনারে ধাক্কা দিয়ে ফেলে; তৎকালে আপনি, হে মহানুভব, তাহার দিকে ঈষৎ তাকাইয়া ঝটিতিই আবার কৰ্ম্মানুষ্ঠানে ব্যর্থ হন; অন্যপক্ষে সেই বালক কৃশ হওয়ত, রুগ্নবদনে, কিছু এক বোধ তাহার এই বিচ্ছিন্নতায় নিতান্ত দরকার কেন না আপন অন্তঃস্থিত অন্ধকারকে সে ভয় পাইতেছিল এবং তাই অন্য বোধ অভাবে কিছু সময় নিজ দুষমনী বোধে নিশ্চল ছিল–কেন না যে সে হয় জাতিতে ডোম।
তবু সে এইটুকুন তাহার সপক্ষে বলিতে নিশ্চয়ই একশা, যে তাহার দিকের খবর নাই, এমনও যে, এখন দিনমান কিম্বা নহে ইহা, অথবা কোনটি তাহার বাম হাত তাহা, সারা কিছুই উহার জ্ঞানকাণ্ডবহির্ভূত অধুনা; যেহেতু সে আমাদিগকে আকুল হইয়া খুঁজিতে আছে; বেচারী দৈবদুর্বিপাকবশত আমাদের কাছ-ছাড়া, আমাদের সান্নিধ্য হইতে বিচ্ছিন্ন। সুঘরাই তাহার নাম, বেচারী হারাইয়াছে–হ্যাঁয় যে ষড়ৈশ্চৰ্য্যশালিনী নগরীতে মানুষ আপনারে ফিরিয়া পায় সেইক্ষেত্রে সে হারাইয়াছে, এখন যদি…।
এই অবধি ভাবিতেই সুঘরাইএর চোখে মোহিলির বহু পুরাতন শতচ্ছিন্ন জুতার ন্যায় মুখোনি প্রতিভাত হয়; এখন মোহিলি হয় একজন গো শকট চালক। যেটিতে সে এবং মনিবদ্বয় আরোহী ছিল, মুখ্যত ইদানীন্তন বিপর্য্যয় ও দুর্গতি মোহিলির নিমিত্তই।