ঐ তিরস্কৃত মেয়েটি তখন মনিব মহাশয়দের চোখে অলৌকিক শোভা ধারণ করিয়াছিল, এ কারণ যে,–সম্ভবপর ইহা যে সাড়ী পরার অনভ্যাস বা অস্বাচ্ছন্দ্যের জন্যই–তাহার পদদ্বয়ের যাহা সৰ্ব্বলোক বন্দনার জন্য, প্রণামের জন্য গঠিত তাহা যেমন সাঁচিতে আছে ঠিক তেমন তেমনভাবেই পশ্চাতে ঈষৎ উত্তোলিত ছিল।
মনিব মহাশয় আপন সহধর্মিণীরে নিজ মনোভাব জ্ঞাপন করিলেন, কি মিষ্টি না,…যেমনটি সাঁচিতে…নয়? আহা কি!
মনিব পত্নী জানাইলেন, আহা কি ভাব! কি চমৎকার, এবং এই পৰ্য্যন্ত বলিয়া তিনি ইতস্ততর মধ্যে, প্রায় তাঁহার ওষ্ঠে আসিয়াছিল, যে, ঐ মেয়েরে পূজা করা যায়, কিন্তু প্রধান শিক্ষয়িত্রীর রুচি তাঁহার
অবিদিত ছিল না, এখন এইরূপে শেষ করিলেন, ওদের দেখ, প্রত্যেককেই বড় খাসা দেখতে নয়!
প্রধান শিক্ষয়িত্রী পুনরায়, তিতিরের ইংরাজী জিজ্ঞাসাতে, মেয়েটি উত্তর দিল,–পারর…টরিজ।
ছিঃ কি উচ্চারণ করিতে আছ, আর-এ র’য়ে মানে প্রথমটিতে…তারপর বলিলাম ত ঐ স্থানে ভাল স্কুল নাই…।
পার্শী সাড়ী পরিহিতা যুবতী ইচ্ছাকৃত অবশ্য কিছুটা উদ্বেলতায় ঐকথায় বাধা দিল,–শুনিয়াছি ইহাতে খুব ভাল রোষ্ট হয়…খাইতে খুব ভালও…!
নিশ্চয় খুব ভাল খাইতে…তুমি তখন খুব অল্পবয়সী, যখন আমি পেশোয়ারে…স্কুলে…উনি কলেজে…এই তিতিরের মাংসে অপূৰ্ব্ব রান্না হয়, তবে সেই রন্ধনে কাশ্মীরজাত লঙ্কার প্রয়োজন হয়…আমরা একটু হলুদ দিয়া থাকি বটে, এবং শা-মরিচ…বুঝিলেন, বেশ ভালভাবে কাটিয়া…প্রথমে ভিনিগার বা নেবু রসে ভিজাইয়া অথবা মাখাইয়া…হ্যাঁ কাটার পরই…।
মনিব মহাশয় ইহাতে অবশ্যই অবাক, সুঘরাইএর প্রতি অপরাধীর ন্যায় চাহিলেন, যে এবং খুব সোজাই মৃদুস্বরে বলিয়াছিলেন,–ও বেচারীর পাখী অন্ত প্রাণ!
স্বামীর এহেন নির্ব্বুদ্ধিতায়ে মনিব পত্নী ঝটিতি অপ্রতিভ হওয়ত, যাহাতে অভ্যাগতরা না ক্ষুণ্ণ হন। তন্নিবন্ধন অতীব তিক্ত শ্লেষে বলিলেন, ছাড়ুন ত ওঁর কথা, পাখী অন্ত প্রাণ না হাতী, অষ্টপ্রহর ওর পিছনে লেগে আছে, আবার কথা, ওই মুখপোড়া ছোঁড়ার ভগনীপতিই যে বলে…বলে পাখীটাকে কাটবে বলে শাসায়, ও ভয় পায় এখন…সত্যি যদি কাটে, রাঁধে তখন ছোঁড়াও হয়ত দেখব একটা ঠ্যাং খাচ্ছে…আজই পাখীটিকে এমন হিস্ শব্দ করে জাত সাপের শব্দ করে ভয় দেখাচ্ছিল, যে আমার এবং ওঁর পিলে চমকে গেসল!…বল…আমরা আঁৎকে উঠি…খুব বকলুম ব’লে অবলা জীব তারে পোষাই বা কেন…কি বলবেন বলুন…জাতে ওরা ডোম, ছোট জাতদের আবার মায়া মমতা…মন বলতে কিছুটি ওদের নেই…উনিও বললেন পূব্বজন্মের পাপ হলে হাড়ি ডোম হয়, যে এবং তাঁহার স্বর ক্রমবিলীয়মান হইল।
মনিব মহাশয় বলিলেন, সত্যই বলুন! হাড়ি ঢোম উহাদের মন থাকিবে, মমতা থাকিবে ইহা আশা করাই বাতুলতা…।
প্রধান শিক্ষয়িত্রী ও তদীয় পার্শ্ববৰ্ত্তিনীরা সরমে কুণ্ঠিত, অধোবদন; মারাঠি সাড়ী পরিহিতা ও তাহার দিদি পৰ্য্যন্ত, যদিও তাহারা বঙ্গের বাহিরে প্রায় বাঙালীবর্জিত স্থানে থাকে, তবু, যে সকলেই মলিন, যে সকলেই নিজেদের আড়ষ্টতা কাটাইবার মানসে সুঘরাইএর প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়াছিল।
প্রধান শিক্ষয়িত্রী এহেন নোংরা ধারায়, মনিব পত্নীর, বলার ভঙ্গী জীবনে শুনেন নাই, একমাত্র এখানে স’স টানের রাহিত্য থাকে; অতএব তাঁহার ভিতরে এখন বিতৃষ্ণা উদ্ভূত হইয়াছে, তাজ্জব যে। এমনও একদা সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে অন্তত সব সত্ত্বেও মনিব পত্নীর শুধু আরশোলা ভীতি আছে। জানিয়া তাঁহাকে মার্জিত বলিয়া বিবেচনা তাঁহার হইয়াছিল।
আরশোলাকে ঘৃণাতে প্রধান শিক্ষয়িত্ৰী বড় সুখী হইয়াছিলেন, নিজের সহিত মিল দেখেন, যে মনিব পত্নীরও একই ঘৃণা আছে। এখন নিশ্চয় মনে হইল তাহা মিথ্যা বালখিল্যতা, সম্প্রতি কোনমতে যেন স্বগতেই তাঁহার ওষ্ঠে বাক্য ফুট হইল! কি অসভ্য! তৎসহ ভঁহার গোষ্ঠির সকলেই সুঘরাই প্রতি নেত্রপাতে সমস্বরে মন্তব্য করিল, ওমা কি অসভ্য ভাই!
অবশ্যই এবম্প্রকার উক্তি মেয়েরা যেন তাহাদের স্বীয় ইজ্জতের কারণেই বিশেষত করিয়াছিল। এবং, ঐ পদ প্রকাশের বৃত্তিতেও প্রধান শিক্ষয়িত্রীর কিন্তু যে পূৰ্ব্বলব্ধ ভ্রষ্টতা যেমন তিরোহিত হয় না, এক ঘৃণা হইতে অগণন ছুঁৎমার্গে বিশালা ব্যক্তিত্বশালিনী প্রধান শিক্ষয়িত্রী উৎক্ষিপ্ত হইলেন।
অন্যপক্ষে যে এরূপ সঙ্গীন তিনি যে তদীয় অভিভাবকত্ব অধীনাদের প্রতি তাকাইতে তিনি অসমর্থ; ক্কচিৎ আপনার সূত্রের কথা মনে হইল যেন, ধীরে তিনি শিক্ষয়িত্রী-বিহিত রীতিতে মস্তক আন্দোলিত করত সকলকে একাগ্র করত অনেক কষ্টে আরম্ভিলেন, সিলি দ্যাটাস ব্যাড! অর্থাৎ মেয়েদের ঐরূপ মন্তব্য।
যে এইটুকুতে তাঁহার হৃতমান ফিরিল, যে এই টুকুতেই ক্লান্তি বিদূরিত হইল, যে এই টুকুতেই প্রত্যয়ের সঞ্চার হইল। ঐ ছোট ইংরাজী পদ ব্যবহারে ভব্যতা সম্পর্কে তিনিই প্রথম সচেতনতা আনিলেন, যে অবশ্যই তিনি সদসৎ তত্ত্ব পৰ্য্যায়ে মনিব দম্পতিরে লইতে পারিবেন।
সুতরাং সুঘরাইকে কেন্দ্র করা তাঁহার কোন অভিপ্রায় নাই–শুধু মাত্র তাহারে উপলক্ষ করিয়া সাজাইতেছিলেন যে ডোম বলিয়া ইত্যাদি। কিন্তু অসাধনেই যেন বলিলেন, আপনি না শুনিলাম, খাদ্যাখাদ্য বিচার করেন না…অক্সো (oxo) খাইয়া থাকেন, এবং যাহাতে এই উক্তি আঘাতরূপে না। বুঝায় তজ্জন্য তাঁহার মুখে স্নেহপ্রযুক্ত হাস্য ছিল।