এবং পার্থক্য ইহাদের সহিত তাঁহার নিজের ঐ সময়েই হৃদয়ঙ্গম হইল, পুরুষদিগের প্রতি চোখ ফিরাইতে পারেন না, ঐ সময় ভাগ্যশঃ অনেক আলো থাকিলেও ছায়া ঢাকিবার মত জোনাকী ব্যতিরেকেও, গোপনতা থাকে, সেই স্থলে উপস্থিত তিনি ক্ষিপ্রতায় ‘মুত’ শব্দটিকে নিজের কারণে সুখকর অনুবাদ (!) করিলেন ‘ছোট বাইরে’।
এবং অতঃপর তিনি অবোধ শিশু বালিকার ব্যবহারে ভদ্রতাবশে মৃদু হাস্যে কহিলেন: ও, ছোট বাইরে করেছ বুঝি! প্রধান শিক্ষয়িত্রীর চমকপ্রদ মনোলোভা স্বরে, সকলেই বুদ্ধির অঙ্ক হইয়া গেল, তখন সকলেই খানিক সচেতন ছিল, অবশ্য পরে বড় অসংযম উজরাইয়াছে নিজেদের মধ্যে ঐ পদসূত্রে।
দূরে সেই ভাবমুগ্ধকারী দল, আঁকিয়া বাঁকিয়া আসিতেছে, তাহারা আপনাদের স্বাভাবিক রাখিতে গীত গাহিতেছিল, নূপুর বেজে যায়, ক্রমে ঐ দল কোথায় যে তাহাদের স্বপ্নত্ব বাহার ত্যাগ করিল গোপন করিল তাহা বিস্ময়ের, পট তেমনই উজর আছে, পথ তেমনই মায়াযুক্ত আছে, সম্প্রতি যেমন বা ইহারা ঘোর জড়বাদের অন্তর্গত হইল। এখন তাহারা টিলায়। মনিব মহাশয় ও তদীয় পত্নী সহজ হইলেন, উদ্যোগী হইলেন, সুঘরাই অল্প তফাৎ রহিল।
ইহারা বিভিন্ন ধরনে সাড়ী পরিহিতা, তাই কিছু সলজ্জ, তাহারা একে অন্যের পশ্চাতে আশ্রয় লইতে সমুৎসুক, প্রধান শিক্ষয়িত্রী রুমাল দিয়া কপালে থুপি দিলেন, উপস্থিত দুই পক্ষই মৃদু মৃদু আনন্দ প্রকাশ করিতেছিলেন। কিয়দংশে এই ব্যবহার নিমকমিকাল বৈকি! তথাপি এই বিরাট ফাঁকা মানুষের যাবতীয় উপহাসাত্মকতাকে নিশ্চিহ্ন করিল। পার্শী মারাঠি মদ্র ধরনের এবং স্কুল ও সামনে-আঁচল রীতির কাপড় পরন দর্শনে মনিব পত্নী অনেক প্রশংসা করিলেন।
তৎকালে প্রধান শিক্ষয়িত্রী একবার বাবুটির, একবার পশ্চাতের চানোয়ার হোথায় নিরীক্ষণে কহিলেন–প্লেইজেনট! অপূৰ্ব্ব! বলিয়া তিনি মনিব মহাশয়ের দিকে ফিরিলেন।
তাঁহার মধুর স্বরসঙঘাত ব্যাপ্ত হইল; অবশ্য ঐ উক্তির রেশে যেন ‘কিন্তু আছিল, সঙ্কোচ নাই, অন্যপক্ষে যেন নিজ উপস্থিতি সম্পর্কে উহাদের সচেতন করার মতিত্বও যেন তাহাতে; এবং আরও তিনি মনে মনে যুক্তি রচনা করিতেছিলেন; এবং যে কেন তাঁহারা লোকালয় ছাড়িয়া উত্তরে যাইয়া থাকেন!
মনিব পত্নী তাঁহার অভিমান ত্বরিতেই বিচার করিতে পারিয়া সত্যই মজা পাইতে গিয়া সাবধান হইয়াছেন, তথাপি অসতর্কতায়ে তাঁহাকে তাঁহাদের গিরিডি চলিয়া যাওয়া বিষয়ে প্রশ্ন সূত্রে–গিরিডি প্রসঙ্গে: যে চমৎকার উস্রি, কি অদ্ভুত মেঘ করে! ধন্য পরেশনাথ! কি শান্তরসাস্পদ বারগড্ডা ইত্যাকার বাক্য স্থির করিতে অধুনা ন্যায়ত থমকাইয়া আছেন যে তাহাতে, ঐ সকল উল্লেখে, বেজার দেখা দিতে পারে ইহা মনে করেন।
যেহেতু প্রধান শিক্ষয়িত্রীর অভিজ্ঞতা হয় যে রিখিয়া অত্যন্ত গ্রাম্য! কুসংস্কারাচ্ছন্ন! আর যে তিনি সিন্দুর পরাতে বিশ্বাসী নন, সত্যনারায়ণ শুনিতে যাইতে রাজি নন!
তিনি বলিয়াছেন এখানে প্রায়ই স্ত্রীলোকেরা অশিক্ষিত; তাঁহার লারডারের (খাদ্যসামগ্রী রন্ধনের ছোট আলমারী) উপরে কাঁচে, কালোর উপরে সোনার জলে ‘ঈশ্বর মঙ্গলময়’ লেখা আছে এবং সেই লেখার মধ্যে ‘ঙ্গ’ অক্ষর ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়া মিটিয়া গিয়াছে, এবং ইহা লইয়া অর্থাৎ এখন যে কথা দাঁড়াইয়াছে এবং তাঁহার ভাষা লইয়া গ্রাম্য-রিখিয়ার সকলে তামাশা করিয়াছে! এবং তাঁহারা তাই গিরিডি যাইবেন, সেখানে নিজেদের ব্রাহ্মগোষ্ঠি আছে, একটি সমাজমন্দির আছে! প্রাণীজগৎ ও উদ্ভিদ ছাড়া প্রাচীনতা সাবেকত্ব উপরন্তু নাই।
অতএব এখানে মনিব পত্নী অল্প অস্বাচ্ছন্দ্য বোধের ক্ষণেই আপন সরলতায় আসিলেন, একারণ যে, সমক্ষেই ফুলমৃদু বালিকারা–যে তাহাদের অনেক অলৌকিকতা ছিল। তিনি খুব বন্ধুতায় কহিলেন, একদিন আসুন না…আমাদের বাড়ীতে।
প্রধান শিক্ষয়িত্রী এই আহ্বানে, সম্ভবত খুসী হইয়া তৎক্ষণাৎই, নিশ্চয় আমরা খুব খুসী হইব, বলিয়াই অল্প অন্যমনা–মিথ্যা তাঁহারা প্রয়োজনে বলিয়া থাকেন কহিলেন, সময় যদি পাই।
অন্তরে তিনি–মনিব পত্নীকে, যিনি ধর্ম্মপ্রাণা, এখন এড়াইতে চাহেন যেহেতু ইহার ভাষা কুশ্রী– অথচ চালচলনে ভীষণ ইংরাজ–যেহেতু ইনি ভূতপূজক হিন্দু; জন্মান্তরবিশ্বাসী ও গঙ্গা-সমর্পিত মন, যাহাদের প্রধান শিক্ষয়িত্রী হিসাবে ঘৃণা করিতেন, অপছন্দ করিতেন! সুতরাং এই ক্ষেত্রে তিনি যে কি করিবেন তাহা মনস্থ হইবার পূৰ্বেই ফ্রক-পরা অল্পবয়সী মেয়েটিও যে মারাঠি ধরনের সাড়ী পরিহিতা, সে বিস্ময়াবিষ্ট হইল, সুঘরাইএর পাখী দেখিয়া কহিল,–পিসিমা দেখুন দেখুন, কি বিউটিফুল পক্ষী, দেখুন পক্ষীটি বালকের হাত টুকরাইতেছে! ইহা আশ্চর্য্যের! উহা কি পক্ষী!
প্রধান শিক্ষয়িত্রী ঐ অপ্রার্থিত সুযোগ লাভে স্বস্তিতে যোগ দিয়াছিলেন, সত্যই চমকপ্রদ! মহাশয় উহা কোন জাতীয় পক্ষী? এবং যুগপৎ স্বীকার করিলেন, যে এইসব বিষয়ে আমরা এত অল্পই জানি…এবং যেক্ষণে তিনি হাসিয়া উল্লেখ করিবেন যে, ঈসল্স বা হিতোপদেশে ইহার কথা নাই, তখনই শুনিলেন যে, উহা তিতির!
এবং ঐ তিতির শব্দ তিনি সুষ্ঠুভাবে উচ্চারণের পরে পার্শ্ববৰ্ত্তিনী মারাঠি সাড়ী পরিহিতা কিশোরীকে প্রশ্ন করিলেন, তিতিরের ইংরাজী কি বল ত দেখি… সিনি? আঃ অত দুলিতেছ কেন! ওকি! ভদ্র হও…ছিঃ! এই মেয়েটি এবং ঐ মেয়েটি আমার মধ্যম ভ্রাতার কন্যা…গত পরশু আসিয়াছে…আবার দুলিতেছ…যেখানে উহারা থাকে সেখানে ভাল স্কুল নাই…দুঃখের…অমন করিও না…ইহারা কি ভাবিতেছেন ছিঃ…!