এখন অনুপমার দ্বারা ইহা পরিলক্ষিত হইল, যে বিলি ঐ চম্পক স্থান হইতে অপসৃয়মাণা হয়। যে সে শিশু আদৌ ভালবাসে না, ইহা অনুপমা জানিয়াছে এবং ঈদৃশ হলপে আশঙ্কিত হইলেও চোরা-মনে রাখিয়াছে। কিন্তু, অন্যপক্ষে শিশু যে নির্দোষ মাধুৰ্য, যে ইনোসেন্স যে বিলিকে এইভাবে যে আঘাত করে–তাহা নির্বোধ অনুপমা কভু বুঝিবে না; আঃ ইন্নোসেন্স কি মারাত্মক!
এখন বিলি সদলে চলিয়া গিয়াছিল, গ্রাভেলের কর্কশ আওয়াজ পুনরায় বিস্তারিয়াছিল, যে ক্রমে বিলি বেষ্টিত সহচরীদের মধ্যে আপন মুখোনি বিষাদ হইতে উন্নীতকরণে-সক্ষম হয়; এবার সে তীক্ষ্ণ, প্রকাশিল, যে ঐ হাস্যসূত্র গ্রাম্য দোষযুক্ত, যে উহাদের ভাষা অশালীন আনকালচারড, প্রায় ক্যাড।
আধা বৃত্তাকারে সহচরীবৃন্দ নির্বিচারে তাহার ডাগর মানসিকতা দেখিয়াছে। তাহারা উহার ঢলঢলে বেলোয়ারি মুখ–যাহার কারণে এইবিশনের স্নো-এসেন্সের দোকানদাররা অকাতরে সাম্পেল উপহার দেয়–সেই আকর্ষণ হইতে চোখ ফিরায় নাই, বিলি সাবাস! তাহার ক্যাড শব্দ উচ্চারণ সৰ্ব্বত্রে, খেলিয়া ফিরিতে আছে।
কখনও সভয়ে ইহাও সহচরীদের মনে পড়িবে, অমলাকেই বিলি ক্যাড বলিয়াছে, তাহারা যাহারা। বাঙালী জীবনে ল্যাভম্যারেজ অবধি শুনিয়াছে, তাহারা বিলি-কে কখনও শুনে নাই!
অমলা ক্যাড। এ অমলা সেই, যে খুব সরল, যে লক্ষ্মী, যে খুব ভাল, যাহার দ্বিতীয় পক্ষে বিবাহ হইয়াছে, যে সগৰ্ব্বে রুলী পরে, তাহার বিবাহতে এক কাণ্ড হইয়াছিল, যাবতীয় মিষ্টি গুড়ের তৈয়ারী হয়, কারণ তখন বয়কটের যুগ, সবই নষ্ট হইল কেননা কেহ মুখে দেয় নাই। সে সুন্দর গান জানিত, বহু সভায় উদ্বোধন সঙ্গীত বন্দেমাতরম্ সেই গাহিত, সে কাজী সাহেবের গান আরও ভাল করিত।
এই সেই অমলা, যাহার গানের খাতাটি অতীব মনোমুগ্ধকর ছিল। এই অমলাই সেই যে গত পূজায় ঁবিজয়ার দিন সিদ্ধি খাইয়া একটু এলোমেলো হয়, গীত গাহিতে প্রথমে পাতকী বলিয়া কিগো’ পরক্ষণেই ‘লালদীঘিতে আগুন’ অবিলম্বেই ‘আয় মন বেড়াতে যাবি’ সঙ্গে সঙ্গেই ‘শত কোটি কল কল নিনাদে’ ইত্যাকারে গীতপ্রবাহের কালে বহুবারই উহার বস্ত্রাঞ্চল স্থলিত হয়, আর বহুবারই সে জিহ্বা দংশন করে! তাহাতে কোন মতিচ্ছন্নতা নাই–সে বড় ঘর-বোলা। গত ভূতচতুর্দশীর দিন সে কোথা না কোথা হইতে এই রিখিয়াতে চৌদ্দশাক তুলিয়া আনিয়া সকলকে বিলাইয়াছে। সে বহু পাখী চেনে, উহাদের ডাক নকল করিতে পারে।
এই অমলাই এখন একটি চেয়ারে বসিয়া আপন পুত্রকে স্তন্যদান করিতেছিল। আঃ সমগ্র ধরণীর মঙ্গল হউক; আঃ দিক সকল সৌর সম্বন্ধীয় না হইয়া আপনি স্থিতিশীল হউক! আঃ পতঙ্গ সকল স্রোতস্বিনীতে নির্ভয়ে স্নান করুক!
অমলার স্তন্যদান-এই নিপটতার ছায়া, চলমান লণ্ঠনে, গাছে, পাতায় দেওয়ালে জানালায়, বিলি কঠিন দৃষ্টিতে ঐ প্রতীয়মানতা লক্ষ্য বিতৃষ্ণায় করিল, তদীয় হাল্কা দুল জোড়া ক্ষিপ্র আন্দোলিত হইল, ব্লাউজের গলার নিকট রাখা রুমাল লইয়া স্বেদ অপনোদন করিল। (হাতব্যাগের তখনও চলন নাই) যে সে নিম্নগ্রামে উচ্চারিল, ক্যাড! সহচরীরা ভাবতঃ ঈষৎ অপরাধী।
বিলির খাসা শ্রীযুক্ত মুখোনি, যাহা দক্ষিণ ভারতীয়দের মত সদাই নড়ে, তাহা খানিক স্থির, জানাইয়াছিল, অধুনা স্তন্যদান কুশিক্ষা প্রণোদিত, উহাতে রমণীর রম্য সুষমা খৰ্ব্ব হইয়া থাকে, যে অমলা বৃথাই স্বদেশী (!) করিয়াছে। আর যে এহেন বাক্যে সকলেই ত্রস্ত, ক্রমে অবশ্যই দৈবক্রমে। দেখিল, স্তন্যদানের বিপরীতে যে রমণী–সে রমণী আর এক রহস্য!
আঃ বিলি তুমি আহেলী ডিকাডেন্স বহন করিতেছ! আঃ বিলির শুধুমাত্র বাম হাতের অনৈসর্গিক কালো চূড়ীর পৌনঃপুনিকতাই কি সবুজতা!
এখন ঐ শিশুকেন্দ্রিক দলের আশেপাশে গিরি ঝরণা নদী সৃজিত হইতেছিল, শিশুটি তখনও সমানভাবে খুসী, আর আর সকলে তাই বড় উৎফুল্ল। কাণ্ড এই যে, মনিব মহাশয় মহা-অথৈ আদরে বিজলী নাম্নী একটি মেয়ের সাত মাসের কন্যারে কোলে লইয়াছিলেন, আর সে সেই শিশু হঠাৎ প্রস্রাব করে! মনিব মহাশয় তাঁহার মহামূল্য চীনাংশুক পাঞ্জাবীর নিমিত্ত কোন খেদ না করিয়া বরঞ্চ উদাত্তে, গ্র্যাণ্ড…এ্যাণ্ড! বলিয়া এই সংবাদ সমবেতদের দিয়াছিলেন, তাই ঐ হাস্য-ঝটিকা!
এখন প্রধান শিক্ষয়িত্রী, যিনি রাশভারী, ইনি তড়িৎ দাশ সি.আই.ইর স্ত্রী, এবং এই সময়েতে ইনি। পুরুষদিগের সহিত বাক্যালাপ করিতে থাকিয়া–পুরুষগণের সহিতই আলাপ তাঁহার শোভা পায়– ক্কচিৎ অন্যত্র মনস্কা ছিলেন, রকমারি আসন ইজিচেয়ার, টুল, তক্তাপোষ হইতে বহু আকৃতির পশ্চাতে এখন সাঁওতাল রমণীগণ ইতস্তত আছে।
প্রধান শিক্ষয়িত্রী সহবতে ঐ সূচনাতে মনঃসংযোগ করিলেন; তিনি আপনকার চশমার তলা-কার কাঁচ দিয়া দেখিতে ব্যর্থ হইলেন; তৎক্ষণাৎই কোন সুলক্ষণা রমণী আলোকবিহীনতা হইতে শিশুকে কপট শাসন করিলেন,–ওরে আবার হাসা হচ্ছে, শয়তান মুতিয়াছ আবার…এবং মহিলার রম্য দম্ভপাতি ভাস্বর হইয়াছিল।
যাহা শ্রবণেই প্রধান শিক্ষয়িত্রীর স্নায়ু দুষ্ট হইল, অভিজাত মনিব পত্নী এবং অলোকার প্রতি অসহায়ভাবে একাধারে নেত্রপাত করিলেন, অবশেষে স্বীয় স্কন্ধের কাছে বস্ত্রাঞ্চল প্রান্ত ধৃত ব্ৰচ আছে, যাহা মনোহর কাজনিদর্শন–সোনার বসানে প্রত্যাগত এক পক্ষী, লার্ক সম্ভবত, তাহাতে যত্ন দিলেন।