কিন্তু যে আদতে ঐ সূত্রে বিলি ঘোষণা করিয়াছিল, যে আমাকে অপূৰ্ব দেখিতে হইয়াছিল, মাথা ঘষিয়াছিলাম, সাগর-খেলা চুল মাথায়, পরনে বাসন্তী রঙের সাড়ী, কলেজের মেয়েরা সমস্বরে ‘আঃ!’ আনন্দিত ফুকারিয়া উঠিল, উঃ সত্যই আমাকে যা চমৎকার দেখিতে হইয়াছিল না, রাস্তার আবালবৃদ্ধ, সবাই হাঁ হইয়াছে, এক অতি নীচু ক্লাসের একজন লোক আমারে দেখিয়া উল্লাসে আতিশয্যে হাঁটু পর্যন্ত লুঙ্গি সংবৃত করত, লোকটি আপনার সমগ্র দেহ যেন ছুঁড়িয়া দিল, শ্রুত হইল…মাইরি দুইটি (ভাত) ছড়িয়ে দিও–পায়ে পড়িয়া থাকিব!
এবং বিলি কহিল আমি মন্তব্য করিয়াছিলাম কি অসভ্য! কি আস্পর্ধা! ছোটলোক মেয়েদের করিতে জান না!
আর যে অনুপমা যাহা স্মরণেও জন্মমূর্খের মত আপনকার মুখে ভাব আনিয়া স্থির থাকিয়া মাতাকে কহিল অন্য আর একটি মেয়েকে আপন সপক্ষে মানিল, কোকোও জানে জিজ্ঞাসা কর না কি গল্প হইতেছিল!
য-বাবুর ভগিনী, ইনি নিকটেই ছিলেন; ইনি বর্ষীয়সী, ইনি বিধবা, ইনি ‘উদভ্রান্ত প্রেম’ মুখস্থ বলিতে পারেন, হঁহার পায়ে কেডস এবং ইহার কারণে ইনি ঈষৎ কিন্তু-তে আছেন, ইনি কোকো নাম শুনিয়া বিস্মিত হইলেন, কোকো আবার কে? অবিলম্বেই তাঁহার দৃষ্টি ঐরূপ নামধারিণী অল্পবয়সী মেয়েটির প্রতি, এত বয়সেও তাহাকেও কুঞ্চিত করিতে হইল, যেহেতু ঐ মেয়েটি তাঁহারই বোনঝিরে বলিয়াছে যে তাহার নাম লাভলি।
অথচ উহার নাম দুর্গা, আশ্চর্য্য উহার, মেয়েটির মাতা প্রথম ঐ লাভলি নাম অস্বীকার করে, পরে বলিয়াছিলেন, উহার মামা রাখিয়াছিলেন।
যবাবুর ভগিনী অবাক হইয়াছিলেন, এখন তিনি থ, নিশ্চিত ভাবিলেন রিখিয়াতে আসিয়া এক একজন এক এক রূপ ধারণ করে…অনেকের কথা মনে আসিল–যে যাহা ভাবিলে গাত্রে সিঞ্চিড়া উপস্থিত হয়; মেয়েটি বিলির সহিত অহরহ কানে কানে কথা কয়!
অথচ দুর্গার মা বলিয়াছে, যে আমার কন্যা দুর্গা সেরূপ নহে, সে এখনও জানে, চুম্বনে পুত্র গর্ভে আসে, দুর্গা ‘মেস’-বাসী অসভ্যদের জুতা ঝাঁটা দেখাইয়া থাকে। য-বাবুর ভগিনীর একটি প্রবচন এই সূত্রে মনে স্বভাবতই আসিল।
পুড়বে মেয়ে উড়বে ছাই।
তবে মেয়ের গুণ গাই ॥
এবং চকিতে ইনি, খানিক বিলির প্রতি চাইলেন, তাঁহার দেহ মোচড় দিল, এই বিলিই দূর সম্পর্কে তাঁহার ভাইঝি, হাতে টাটু (তোমার পাত্র) লইয়া যখন ফুল তুলিতেছিল এবং তখনও পাঁজি লিখিত তিল সম্পর্কে ব্যাখ্যা করিতেছিল; যে এবং ইহাও তিনি সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে বিলির মাতাই ইহার জন্য। দায়ী, বেহায়া মেয়েরে কখন শাসন করে না এবং ইহাও যে, নিজে, বিলির মাতা, এত সোমত্ত মেয়ে থাকিতে রঙীন কাপড় পরেন, তাহার আর কাণ্ডজ্ঞান কি হইবে!
এই মাতা, ইহা প্রচলিত যে, বিলির পিতা বিলির কিছু বেচাল দর্শনে কিছু বলিলে তর্ক করিয়া থাকেন। যে: এই যুগ নূতন! তুমি বৃদ্ধ!…বিলাতে কি হয়! লোকে বলে, লোকের মুখে ছাই, তাহারা কি খাইতে অথবা পরিতে দিবে। আমরা জীবনে কোন সাধ আহ্লাদ করিতে পারি নাই, মেয়ের সম্পর্কে তোমারে ভাবিতে হইবে না! (আশ্চৰ্য্য বিলির পিতা উচ্চপদস্থ কর্মচারী)।
যে এবং এই সকল কথা বিচারিয়া যবাবুর ভগিনী উপলব্ধি করিলেন, দুই দিনের জন্য আসিয়াছি, আমার কি প্রয়োজন। তাহার সাক্ষাতে নব-যৌবনারা কেমন যেমন নগ্ন, তাহাদের গাত্রবর্ণ মেঘতুল্য ধূসর, যে এবং ইনি সংযতভাবে মুনশেফের স্ত্রীর সহিত ইহা যোগ দিলেন, না মিশিলেই পার, আমি অন্য কিছু বলি না, তবে যে ঐ ব্লাউজ পরা বগলকাটা কেন, ঘটি হাতাই ত ভদ্র…আবার হাতাবিহীন…বিলি শুনিতে পাই কাঁচা রসুন খাইয়া থাকে…গোবিন্দই জানেন!
অনুপমা এহেন তিক্ততার মধ্যে থাকিয়াও বিদ্যুতে বিলির নজর লইল, কেমন যেন ভীরু, কেমন যেন জেল্লারহিত, কিছুক্ষণ পূর্বে কি কুহকিনী যে সে! উহার হস্তীদন্তের (আসলে সাধারণ হাড়ের) ঝুমকো, উহার মীন অথচ টানা নয়ন, গৌর গাত্রবর্ণ, উহার কাজল, সিন্দুর টিপ–এ সকলেতে যেন পৃথিবী নড়িতেছিল, সর্বৈব ফোয়ারা।
এখন বিলি উপস্থিত ঐ শিশুকেন্দ্রিক আবহাওয়ায় নিজে যেন অনেকটা বিলি-র স্বীয় উক্তির ন্যায় নির্ঘাত ক্যাড, চিবি, চিশী; যাহা এই যে ঐ সরস্বতী পূজার দিন তাহার কোন বন্ধুর ভাই তাহার এক ফটো তুলিয়াছিল, ফটো আসিল, কিন্তু কোথায় সে বাসন্তী রঙ, কোথায় সেই অপূৰ্ব্ব কেশরাশি! যথার্থ বিপরীত তাহারে দেখিতে যেন রাক্ষসী…চিবি চিশ্রী ক্যাড।
এবং এই বিবরণের পরই বিলি অপোবদনে থাকে, খানিক বাদেই হঠাৎ বলিয়া ফেলিল, আমার ফটো কেন যেন ভাল উঠে না, বোধ হয় তুক আছে।…এবং এই স্বীকারে সে উৎসব-মাতৃক বিলি ফ্যাকাশে, হায় বিলির স্তব্ধতা আছে। কোন এক গ্রহের দ্বারা অজানিতেই তাহার পরমার্থ অপহৃত হইয়াছে।
কিন্তু ঝটিতি তিলেক মধ্যেই বিলি নিজের কথাকে উড়াইয়া দিল…ধেৎ মা বলিয়াছে উহাদের হাত খারাপ, ক্যামেরা বাজে। তথাপি তাহার এই যুক্তির পরও তাহার সেই বিষণ্ণতা গুণগ্রাহী সকলে দেখিয়াছে; দেখিয়াছিল, বিলি যখন একাকিনী!
এখন শিশুর সান্নিধ্যে বিলিরে অনুপমার যথার্থই তেমন তেমন উপলব্ধি হইল; যে সুতরাং সে বেচারী এতেক স্তম্ভিত, যে যাহাতে সে আপনার অতি ধ্যানে কৃত কেশবৈচিত্র্যে হাত দিয়াছে অসাবধানতায়, বিলি যেমন ময়লা যে বিলি ধূপের ধূম্র রেখার তুল্য ম্লান, সেই স্পর্কিত দ্বীপ তাহার কোথায়, চন্দ্রালোক যে দারুচিনি অরণ্য মর্মরিত করিয়া বিচ্ছুরিত হইত তদীয় ভ্রমণের হেতুতে; যে তরঙ্গ সকল তাহার লাগিয়া অলঙ্কার নিমিত্ত, বিবিধ প্রকারের ঝিনুক আনিত, তাহা শুধুই যেমত বা কবিপ্রসিদ্ধ!