সে অনেক অনেক কান্দিল। সে অনেক অনেকবার ও আমার মনিব আমার মনিব, বলিয়া উথলিয়াছে। কিন্তু কান্দিলেও অন্তরে সে ঐ সাধকপ্রায় আস্ফালনে তৈয়ার; আপনার অঙ্গুলিশীর্ষ বারম্বার নজরে এক বিষমত্ব জানিয়া সে খ্যাপাটে, এতদিন তাহার যে সীমা গ্রাম্য ছিল, সম্প্রতি তাহা ভৌতিক হইয়াছে; এই শহর তাহাকে, নিজেকেই, তাহার স্বীয় গায়ের উপর ঢালিয়া দিয়াছে; এই শহরের উপর সে খঙ্গহস্ত, সে ব্রাহ্মণশ্রেণীর ন্যায় মোহিলিকে অভিশাপ দিয়াছে কারণ মোহিলি বলিয়াছে, ইহা মহিমান্বিত শহর, বহু জ্ঞানী এখানে, এখানে শিব বাস করেন, পঞ্চায়েত বিল্বপত্র হস্তে বিচার করে, এখানে বিস্কুটের কারখানা নাই।
ইহা মহিমান্বিত শহর! সুঘরাই বলিয়াছে, পাখীরাই তাহা জানুক; সে বলিয়াছে, মোহিলি ও যাহাদের ধারণা এ শহরে কুকুর হওয়াও পুণ্যের, তাহাদেরকে সে পদাঘাত করে এবং নিমেষেই এরূপ মনোভাবে সে ভীত; উচ্চবংশের বালকদের ন্যায় বলিতে এখনও পারে নাই যে, না বাবা বলিব না ভগবান শুনিতে পাইবেন।
সুঘরাই এই শহরকে খলযন্ত্ৰী সমঝে আপনার চোয়াল ঘর্ষণ করিতেছিল, এখানের কোথাও সে নিজেরে সম্প্রসারিত করিতে পারে না। অবিরত ঢাক বাদকের নৃত্যপদক্ষেপ তাহার পদচিহ্ন মর্পিত দেখিয়া, শান্ত তীর্থযাত্রীদের তাহার পদচিহ্নের উপর দিয়া যাইতে প্রত্যক্ষে সে মারাত্মক হইয়াছে! ইহা বড় বিষম দায়, কোন বিচারেরই সুযোগ নাই!
কখনও বালকস্বভাব বশত সুঘরাই রাস্তার এক পাশ বাছিয়াছে, এই নির্বাচনে একদা সে অহো বলিয়া ফুকারিয়াছে, সে খুসী, সে ইহাতে উচ্চবর্ণের স্পর্শ বাঁচাইয়াছে; ক্রমে তদীয় পদদ্বয় ধূলাতে বিশেষই গৈরিক যে তাহাও ঠিক কিন্তু সুরাহা হয় নাই! তাহার মনিবরা রাস্তার মধ্য দিয়ে যায় বা কখনও পথ ছাড়িতে পাশে, তবে! সে নিয়ত মনিবদের অন্বেষণও করিয়াছে, ইহারই ভিতরে যে সে অনেকবিধ কাঠামো, সুদারুণ পারিপার্শ্বিকতার সহিত আপনাকে সংযোজিত করিয়াছিল–সুতরাং এনতার অনভ্যস্ত সংস্থানের মধ্যে সে, সঙ্গে সে, এক হয়–এইরূপ বিশ্বাসে যে মনিবরা তাঁহাদের সত্ত্বগুণ বশত আকর্ষিত হইতে পারেন ঐ ঐ সংগঠনে।
এবং সুঘরাই ঐ ঐ পরিবেশ সকলের মধ্যে আপনাকে উপস্থাপিত করিয়া আবার অন্বেষণে থাকিয়া, খুবই তাজ্জব যে কখনও কখনও সে নিজেকে মনিবের চোখে নির্ধারণ করিতে মজবুত ছিল; ইহাতে, পর্য্যবেক্ষণ তাহার কি আশ্চৰ্য্য অমানুষী, বোধ কি অভাবনীয়! যে যেন বা সে কখনও জংলী নয়; ইদানীং এহেন ভিন্নতায় সে, মানে মনিবকে, দেখিল।
সে কল্পনায় দেখিল বিশৃঙ্খলতা, মসৃণতা, অনেক আবছায়া অনেক রক্তচন্দন ও তীর্থযাত্রীর দল ভেদ করত তিনি সুস্পষ্ট হইলেন; এবার তিনি মুখের পার্শ্বে হস্ত স্থাপনে ভীড়ের এখানে হঠাৎ, অন্যত্রে বারেক, সুঘরাই বলিয়া ডাকিলেন, যে ইহাতে মাতৃস্তন অরুণাভ, যে ইহাতে জনতা এই নিবিড় এই তরল হইল; এখন এবং সুঘাইএর প্রমাণের-কোনবালককে পশ্চাত হইতে দর্শনে–বালকের বস্ত্র ও গেঞ্জী ফর্সা যেহেতু ঐ সুঘরাই বিশ্বাসে অত্রাহি দৌড়াইলেন এবং চীৎকার করিলেন–এই হারামজাদা সুঘরাই!
হায় সে এক স্কুলগামী বালক!
নিরাশ হওয়ত বিষণ্ণ হৃদয়ে তিনি পূতসলিলা শিবগঙ্গার সুদৃশ চাতালে আসিলেন; এখানে কেহ কেহ যাহারা ঘুমায় তাহাদিগকে স্বীয় দেহ বাঁকাইয়া এমত নিবিষ্টতায় তিনি সমীক্ষণ করিলেন যে, যেমত বা ঘুমন্ত সকলের স্বপ্নের সুষুপ্তির অন্তরীক্ষে সুঘরাইএর খেই লুক্কায়িত আছে; যে মধুস্বরে তিনি সুঘরাই বলিয়া ডাকিলেন; ইহা নির্ঘাত অপ্রকৃতিস্থতার হইলেও আর যে, এই দেবস্থানের ধ্বনিত গভীর জয় জয় শিবশম্ভ বচনে ও স্নানের নির্মল শব্দে ঐ প্রিয় নাম ধূলিসাৎ, তীর্থকামীদের অগ্রবর্ত্তী মঙ্গল ঢাক বাদ্যে তাহা নয় ছয়!
সেখানে খুঁজিতে থাকিয়া মেঘমন্দ্রে অগণন কণ্ঠের মন্ত্রের প্রতি কখনও, সুললিত স্তবস্তোত্র আবৃত্তিসহ শিবগঙ্গাতে শুভ অবগাহনরতদের প্রতি কখনও তিনি সনাতন প্রবীণ ভঙ্গীতে চাহিয়া রহেন, কারণ যে বিবিধ ওষ্ঠের ফুটমান শব্দরাজিতে ও অবগাহনের মনোজ্ঞ রণনে ধ্রুবই যে তন্মাত্রা সমস্ত নিৰ্ব্বিকার, কোথাও অন্ধকার নাই; মাত্র যে শিখা ঊর্ধ্বগামিনী এই তত্ত্বে সবই জরিয়া আছে–তাহারাও কি সুঘরাইকে ডাকে!
আবার তিনি শ্বাস লইলেন, তিনি সহজ হইলেন, তিনি ঠিক করিলেন, এই ভাবিয়া যে সুঘরাই নিশ্চয়ই ক্লান্ত বোধ করিলেও মুষড়ায় নাই এবং আরও নিশ্চয়ই আমার খোঁজার সুবিধার্থে এখানেও সে ছিল; তাই যাহারা শিবগঙ্গায় অর্ধজলমগ্ন, করজোড়ে যাহাদের পৃথিবীর পার্থক্য, তাহাদেরই কাহারও পাঠ থামিলে এই সংবাদ লইবেন যে, যে বালক এতক্ষণ শুদ্ধাতিশুদ্ধ অবগাহন দেখিতেছিল এবং তাহাতে সে অপরোক্ষেই, যেন সে, ঐবালক, একাই সুদীর্ঘ সময়, যাহা বীজ বপন করিতে ব্যয়িত হইয়াছে এবং ঐভাবে অনেক দুরতিক্রম্য পথ বহি এখানেতে আসিয়া চমকৃত!
এবং আপনাদের স্নানের আওয়াজে সেই বালক একদা রিখিয়ার সন্ধ্যায় নীত হইল; ছোট ছোট পরিবার বেড়াইতেছে–ইহারা চেঞ্জার; ইহাদের সকলের মুখমণ্ডল, দৃষ্টি, আকাশ ও মাটির ইতিমধ্যে রক্ষিত–ইহাদের পিছনে পাহাড়, শাল ও মহুয়ার পুনরাবৃত্তিতে ন্যাংটো দিকসকল; ইহারা সমস্ত কিছুকেই গ্রাণ্ড বলিয়া প্রশংসা করে, তাহারা পেট্ররোমাক্স হাতে সুঘরাইকে দেখিয়া বলিয়াছে–ছেলেটি গ্র্যাণ্ড গ্র্যাণ্ড! বেশ কালচার আছে!