এই পর্য্যন্ততে সুঘরাইএর রৌদ্রনিবাস আয়ত চক্ষুর্ধয় সর্ব সময়ে বড় হয়, যাহা প্রত্যক্ষে মনিবপত্নী আবার কহিলেন, হ্যাঁরে,…তিনি বড় দুখীর ঠাকুর…মা ঠাকরুণ (সারদাদেবী) বলেছেন, যে ছোট ছেলের ডাক তিনি ফেলতে পারেন না, তুই নির্ভয়ে ডাকবি, বলবি ঠাকুর আমি বড় অধম বড় দীন, তুমি ছাড়া আমার গতি কৈ…তখুনি, দেখবি বাবা বোদ্দিনাথ তোর পুবো জন্মের সব পাপ ধুয়ে মুছে দেবেন…আবাঃ ছোঁড়া গালে হাত দেয়…কতবার বলেছি না এ সব কথা কহনও গালে হাত দিয়ে শুনতে নেই…এসব ঠাকুরদের কথা!
ইহাতে সুঘরাই আপনকার গাল হইতে হাত নামাইতেই যারপরনাই অসহায় নির্জীব হইল; এমনই যে, ইদানীং সকল নির্ভরতা তাহার ঝটিতেই খোয়া গিয়াছে, যে সে সব গরু খেদাইতেও অপারগ; এবং তাই উপস্থিত এ দেহ কোথাও হেলান চাহিতেছিল–যাহা নির্ঘাত কৃতাঞ্জলিপুটে শুনিবার, পত্ৰউদগম ও কুম্ভকারের চাকের নিগুণ গূঢ় পদ্যতে; যাহা গ্রামাঞ্চলে অনাবৃষ্টির ছড়া বোধে ব্যবহৃত হয়, নবমবর্ষীয়া বালিকারা নগ্ন দেহে, শূন্য ঘট মস্তকে ধারণে ঈষৎ নৃত্যভঙ্গিমায় উহা গাহিতে থাকিয়া প্রথমে ক্ষেত প্রদক্ষিণ করে।
এখন সুঘরাই যখন এহেন হেলান দিতে ইচ্ছুক, ঠিক সেই সময়তেই শুনিতে পাইল যে নিজ অভ্যন্তরে পাঠান দাপটে কিলকিলা রব ঘনাইয়াছে; তদীয় পেশীসকল তাহার স্বকীয় পূর্বজন্মটিকে বিনানুনে এক গ্রাসে খাইতে হাঁ হাঁ করিতেছিল, যাহাতে সে বিপদ গণিল; ইহাতে শঙ্কায় সে কিয়ৎ পিছু হটিল, সুতরাং সে নিরীহ, যে নির্বিবাদে সুতীক্ষ শীত সহিয়াছে নিজ বক্ষঃদেশে হস্ত রাখিয়া, যে নিজ হাতে কপালের ঘাম ও চোখের জল মুছিয়াছে, যে কোন লাটুঠার দড়ি (কুয়া দড়ি) স্পর্শ করে না, সে অন্য নহে। ফলে অতএব মোটেই আভাসিত তাহার মধ্যে হইল না, যে কোন একদিন কয়েকটি পালক উড়িয়া-হায়! কখনও বা মুক্তার বৈভব আতিশয্যকে প্রনষ্ট করিয়াছিল, এইহেতু যে সে আপনার ভালবাসা লইয়া ক্কচিৎ খেলা করে–তাহারে বিকট করিয়াছিল! এবং সে ন্যাংটো হইয়াও ছাড় পায় নাই।
যে স্থলে পালক উড়িয়াছে, পালক পড়িয়াছে, ধ্রুব যে ভগবান রামচন্দ্র যাবৎ না সেখানেতে পদার্পণ করেন, ততদিন সেখানে কিছুতেই দীপ জ্বালিবে না, যে ঐখানে পদক্ষেপমাত্রই সকলেই পথ ভুলিবে; এ কারণে যে, ঐ স্থলে সুঘরাইএর তর্জ্জনী কাটিয়া বেশ খানিক রক্তপাত ঘটে, এবং যে সে দেখিল ঐ রক্ত তাহার পাখীটিকে মহা সোহাগভরে পান করিতে; এখন আজব যে, ঐ দৃশ্যে সে দারুণ খুসী হওয়ার মুহূর্তেই দুর্দান্ত ক্রোধে ভৌতিক, তৎপ্রবর্ত্তীত সে তৎক্ষণাৎই পদাঘাত করিল মূদুল পক্ষীটিকে; কিছু পালক খসিল, ইহা উড়িতে থাকিয়া তাহার সম্মুখের–রিখিয়ার পশ্চিমে অবস্থিত সুরম্য ডিগরিয়া পাহাড়কে ঢাকিয়াছিল। ২৬০
দেবস্থান যাত্রার মধ্যে এবং মন্দিরে আসিবার রাস্তাকে পূজার্থী ও ব্রাহ্মণ স্পর্শ বাঁচাইবার ইতঃমধ্যে মনিবপত্নী বর্ণিত প্রার্থনা, ইহা শ্রুতি বা দেশাচারে নহে, তিলেক সে বিস্মৃত হয় নাই, বরং উহাই তাহার সম্বল ছিল; তবে ইহা ঠিক, যে, ঐ সময়েতেই, নিষ্ঠাবান মনিব মহাশয় তাহার বিষয়ে যে অভিমত ঘোষণা করিয়াছিলেন, তাহাতেই সে, তাহার এক ছত্রে সে, কেবল দোমনা হইতেছিল; তিনি প্রকাশিয়াছিলেন,…যে সে নিষ্পাপ (মনিবপত্নীর উক্তিতে) সাতজন্মের পাপ!
এবং তবু ঐকথা যাহা উচ্চারণের সঙ্গেই বাস্তবতা কাদামাখা পদে মার্বেল অভিমুখে ছুটিতে আছিল, এইজন্য যে ঐ উক্তিতে মনিবপত্নী, যিনি এ যাবৎ মৌনী, এ যাবৎ নিছাড় মালাজপকারিণী, তথাপি তিনি সমধিক বাৎসল্যভরে সুঘরাইএর প্রতি চাহিয়া স্মিতহাস্য করেন।
কিন্তু যখন সে বেদময়ী অজস্র ধ্বনির মধ্যে, যখন আহ্লাদ তাহাতে থিতাইয়াছে, তখনই সুঘরাইএর আপনকার এতাবৎ মনস্থ কামনার পদবন্ধ মনিব-ব্যক্ত পদগুলিতে ঠেক্ খাইতেছিল; এখন সে যেহেতু প্রার্থনা জানে না ফলে ক্রমাগতই সে অন্ধকার দিয়া ডাকিতেছিল।
অবশেষে পুনরায় মনিবের বিনীত কণ্ঠস্বর শুনিল, একটি শব্দ দেখিতে পাইল, ইহাতে সত্যই সে যেমন চানোয়ার বালিতে খোঁড়া গর্তের নিথর জলের চাকচিক্য সাক্ষাৎ করিয়াছিল, আশ্চর্য্য যে ঐ নিঃসঙ্গতায় থাকিবার সময়েই সুঘরাই বুঝিল তদীয় নিষ্পলক চাহনির সামনে–এই হাট দিনমানে মন্দিরের রাস্তায় এক অযুত দ্যুতিময়ী শোভাযাত্রা আসিতেছে।
সে প্রত্যক্ষ করিল এ শোভাযাত্রাতে সমস্ত পথ চারুবর্ণ ধারণ করিয়াছে, সে প্রত্যক্ষ করিল এক বহুমূল্যবান উৎকৃষ্ট কিংখাবের ছাঁদনা, যাহার চারিটি রৌপদণ্ড চারিজন বালক ব্রহ্মচারী কর্তৃক ধৃত, ইহাদের মস্তক মুণ্ডন করা, পরণে ইহাদের গৈরিক–আর ঐ ছাঁদনার নীচেতে কোন সৰ্বালঙ্কারভূষিতা, হস্তে যাঁহার ধান্যমঞ্জরী, ইনি গৌরী, ইনি সেই যিনি নৌকার অভিমানকে মান্য করিয়াছেন, ইনি সেই যিনি মরকতের গোপনতা!
ঐ শোভাযাত্রা দর্শনে পথিপার্শ্বের সকলেই ‘অহহ ভগবতীতনু! জয় জয় অপূৰ্ব্ব মিথুন! অহো। মহেশ্বরী’ বলিয়া গম্ভীর হইয়া উঠিয়াছিল; ঐ সুমহৎ আওয়াজে দিকে দিকে পবিত্র অগ্নি স্থাপিত হইতেছিল। এই জোয়ারের ইতিমধ্যেই অদৃষ্টপূৰ্ব্ব মনোরমত্ব দেখার প্রাণভরিয়া দেখার সৌভাগ্য হইতে বেচারী মন্দ কপাল সুঘাই বঞ্চিত হয়।
সে সর্বৈব বিচ্ছিন্ন হইল।