যে সে কতবারই না, মদীয় পত্নীর উৎকৃষ্ট আবলুস কাঠ নির্ম্মিত আয়না দেরাজের উপরে, জেডের সুলক্ষণা অতুলনীয় রূপের এক চৈনিক দেবীমূর্তি ও ইহারই আশেপাশে, মাইরি কি অভিরাম বোগদাদের গোলাপ পাশ, ব্যহেমীয় শিশি বাহার ও ইদানীংকার ফরাসী এসেন্সের আধার, একই কেয়ারিতে–আনারকলি-বাগিচা ছাঁদে সাজান, সুঘরাই যাহা দেখিতে মোহাচ্ছন্ন আজ্ঞাবহ দাস হইলেও সাড়হীন; যদিও হায় সে পদ্ম পাতায় খায়, সে প্রায়-জংলী, তারাময়ী অন্ধকার এখনও তাহার নিকট সুন্দর হয় নাই, পরীর গল্প সে শুনে নাই! শুধু স্মরিয়াছে ঐখানে সৌখীনতার মধ্যে কোথাও যেন ভোর হয়, আবার পাখীরা ফিরিয়া আইসে দারুণ পড়িমরি দৌড়ান যায়–তখনও সে লুপ্ত হইয়া যায় না!
তৎপ্রবর্ত্তীত, রাস্তার উপর এই বেলোয়ারী সম্ভারে গতিরহিত সুঘরাই সুনিশ্চিত হাতের কব্জিদ্বারা বিগলিত অশ্রুধারা মুছিয়াছে এখানে, জয় শিব শম্ভ ধ্বনি কানে আসে না। এখন এতদ্ভাবাপন্ন তিনি মনিব মহাশয় চুনটকৃত দোপাল্লী টুপী-পরা বিলাসী আতরওয়ালাকে প্রশ্ন করিতে যাইয়া অচিরাৎ মহা দ্বিধায়, কিসের তত্ত্ব করিবেন তাহা জ্ঞাত নহেন মুখ্যত; যেন তিনি আতরের খবর লইতে আসিয়াছেন, কেয়া গুলাব শামামা এবম্বিধ নাম তাহার স্মরণে আছে এবং যেমন ইহাদের মধ্যে একটি নাই তথা খোয়া। গিয়াছে; এখন তাহা সত্যই আতর না অন্য; না, অন্য কিছু নয় তাহা আতরই, তাহাই সুঘরাই অর্থাৎ।
অনেক শিশি দেখিতে তাহার স্থিরতা আসিল, কহিলেন,–যে বালক রক্তিম নয়নে মহাশয়ের পসরা বিদগ্ধভাবে পর্য্যবেক্ষণ করে, ফলে তাহার এই অপ্রত্যাশিত ভৌতিক সংগ্রাম হইতে নর্দ্দমা হইতে খানিক অব্যাহতি লাভ হইয়াছে ক্ৰমে বমি উদ্রেককারী গন্ধ তাহা হইতে সরিয়াছে যে এবং, সে যে অকথিত সান্ত্বনা পায়, যে, সে হারাইয়া যাইবার নহে; এবং সে এই বিশ্বাসেই, যে যদি ভগবান শিবের জয়ধ্বনির-নিকটে থাকিতে পারে তাহা হইলে কোনরূপেই সে হারাইতে পারে না–তাই সে ছুটিল, কিন্তু কোন ঢাকীর পশ্চাতে তাহা কি জানেন, সে কি ঐ সিন্ধু প্রদেশ আগত যাত্রীদের…পশ্চাতে!
অতঃপর মনিব মহাশয় আপনার পদক্ষেপ সংযত করিলেন, কেন না আশ্চর্য্য কথায় তিনি কেমন যেন, যে যাহা এই, তীর্থযাত্রিদের একজন বলিতেছিল,–যে তিনি আর ট্রেন হইতে নামেন নাই, বাবা বৈদ্যনাথকে গাড়ীতে বসিয়া প্রণাম করিয়া বলিলেন,-বাবা তুমি জান আমার মৃত্যু আসন্ন কল্য সন্ধ্যায় আমার ‘—’ ঘটিকায় কাল হইবে, আমি কাশীধামে যাই, আমি গঙ্গাতীরে শেষ নাম জপ করিব, আমি মুক্তি চাই, তুমি দেবাদিদেব তুমি লইয়া চল…তারক ব্রহ্ম নাম তুমি দিও!
সুঘরাই অদ্ভুত চোখ করি এহেন কথা শুনিতে জিহাদ্বারা অধর সিক্ত করে; সে আন্দাজে কিছু অনুধাবনে, ইহা ভাবে, যে উহা ঐ বক্তব্য এক দারুণ ষড়যন্ত্রের খবর, অন্যপক্ষে এরূপ স্বস্তিও তাহাতে জন্মায় যে ইহা ভাল, যে বৈদ্যনাথে নামিলে অব্যর্থই হারাইয়া যাইত; ঢাকীরা তাহাকে, সেই বৃদ্ধকে, পয়সার জন্য ত্যক্ত করিত, বুঝিতেই চাহিত না যে তীর্থে কাঞ্চন স্পর্শ করিবে না বলিয়া সেই বৃদ্ধের যথাসর্বস্ব তাহার সঙ্গীদের নিকট; ভাল যে কাশী গিয়াছে আর হারাইবার সম্ভাবনা নাই।
যুগপৎ ব্রত বিগ্রহ গরুটি, যাহার ললাটে চমৎকার সিন্দুর, বিশেষত সেইটির জন্য সুঘরাই ক্ষুগ্নমনা এখন দেখিল, সকল উদ্বিগ্ন কণ্টকিত গাভীর চক্ষুদ্ৰায় জাজ্বল্যমান, ইহারা ব্যথিত স্বরে হরব করে, যাহা সস্নেহ লেহনের শব্দের ব্যঞ্জনা অনুসারী, যে স্বর পদ্ম হইতে, দেবীর চরণ ন্যায় শুদ্ধ; ইহা চতুর্বিধ আকাশ, পরিক্রমণ, ভেদ করত, মহাব্যোমে পৌঁছায়, সেখানে সুস্পষ্ট অভিধানে ঐ ব্রত বিগ্রহ গাভী এই অভয় দেয়, যে, হে জ্যোতির্ময় তুমি বিকিরণ কর, অন্ধকার বিনষ্ট কর, শুন, মানুষে আর কোন অজ্ঞান নাই, বৈচিত্ত নাই, যে তাহারা ফুলে,কুঁড়ি উদগত হইতে দেখিয়াছে, প্রস্ফুটনে তাহারা উথলিত, বেশ কাল অন্তে উহার ঝরা প্রত্যক্ষে তাহার বাস্তব হইয়াছে এবং সুদীর্ঘতা ও বিপুল এই দুইকে আপেক্ষিক জানে! অগ্নিকে শপথাৰ্হ মান্য করিয়াছে, মদীয় হরবকে প্রস্তরে পর্যন্ত আরোপিত করিয়াছে। সুঘরাই গাভীসকলের কারণে চিন্তিত বিমর্ষ কেন না চৌকিদাররা ক্রমাগত রিখিয়ার পথের অন্ধকারে হাঁক পাড়িতেছে, সকল গ্রামবাসিরাও দিভ্রান্ত যে সে অনুমান করিল।
অতঃপর সে ভাবিয়াছে মনিব মহাশয় নির্ঘাত এখন সেই বদ্ধ উন্মাদের সম্মুখীন, যাহারে তিনি সমাহিতচিত্তে সংস্কারবশত পরিগণন করিলেন, যথা ইহা নির্দিষ্ট যে আত্মদর্শীরা উন্মাদবৎ রহেন, তাঁহারা জড়বৎ পিশাচবৎ বালকবৎ হয়েন, এবং যেহেতু কয়েকজন বৈষ্ণব সন্ন্যাসী মালা জপিতে থাকিয়া সেই ব্যক্তিতে আকৃষ্ট রহে–এ কারণে তিনিও বিবেচনা করিলেন, ইঁহাকে দেখি বদ্ধ উন্মাদ, নিশ্চিত মহাপুরুষ, অবশ্যই পরহিতব্রতীও হয়ত; আর যদি ইনি তাহা না হইয়া থাকেন, যদি ইনি সাধারণ পাগল হন, সেই ক্ষেত্রে ইহা বিদিত যে, পাগলরা সত্যের সন্ধান, ব্যবহারিক সত্যের সন্ধান দিয়া থাকে; এখন যে কোন পক্ষে, আমি ইহাকে শুধাইতে ব্যাকুল, বিশেষত এই নিমিত্ত যে,বেশ ভালরূপেই জানি সুঘরাইএর পাগল খ্যাপাদের প্রতি প্রগাঢ় দরদ উৎসুক্য আছে, কতদিন সে তাহাদের ভাত দিবার জন্য পদ্মপাতা আনিয়াছে, নিজ অন্নদানে উৎসাহিত হইয়াছে, আবার ইহাও ধ্রুব যে, অন্যধারে যাহাদের মতিচ্ছন্নতা তাহারে প্রমোদিত করিয়া থাকে এবং যাহাদের জ্বালাতন করণে কি অবধি হৃষ্টতা তাহার, যে পরক্ষণেই উন্মাদদের প্রতি আক্রমণে পলায়ন তুল্য আহ্লাদন তাহার আর কৈ!