ইত্যাকার পর্যালোচনাপূৰ্ব্বক মনিব মহাশয় হ্যাঁণ্ডবিল বিলিকারী, যিনি তারের খেলা দেখান– তাঁহারে সম্ভ্রান্তস্বরে জিজ্ঞাসিলেন, মহাশয়, আপনি সুবিখ্যাত ব্যক্তি, আপনার মধ্যে সরল রেখার বৈচিত্র্য, বহু বালকের হাতে আপনি হ্যাঁণ্ডবিল দিতেছিলেন, যে বালক আপনাদের কসরতের ছবি দেখিয়া থমকাইয়াছিল, পরক্ষণেই বড় পশ্চাতে চাহে আবার বাঘেরা খেলোয়াড়কে দেখে, রোমাঞ্চিত হওয়ত শিহরায় যে যেন এখনই খেলোয়াড় জাগিয়া হালুম করিয়া উঠিতে পারে, হঠাৎ সে স্থান ত্যাগ করিল, আপনার আহ্বান সত্ত্বেও সে কাছে আসে নাই।
অবশ্য পুনরায় ফিরিয়া আইসে, যখন কৌচম্যানের পার্শ্বে বসিয়া ক্লাউন নানান রঙ্গতামাসা দেখায়, বাহবা রুমালের খরগোস ও বাখানি ইন্দুর লইয়া খেলা এখানকার দুএকটি সবস্ত্র বালক, সুঘরাই না, ও কতিপয় পথচারী বুঝিত না; অবশ্য ক্লাউন যখন কপট শ্লেষ্ম ঝাড়িয়া এই অল্পবয়সী ভিড়ে নিক্ষেপ করে, যখন কপট তাড়নায় পাদানিতে পা দ্বারা আঘাতিয়াছে, চাবুক আস্ফালনে মজা করিয়া থাকে, সর্বোপরি কপট মূত্রত্যাগজনিত অঙ্গভঙ্গীতে ও তৎশব্দের অনুকরণ, যখন অন্যান্য বালকরা হাসে, যখন পালায়, সেই বালক সরিয়াছে পালাইয়াছে কিন্তু হাসে নাই।
যে এবং চিত্রিত কসরৎ সকল দূর হইতেই, ক্ষণেক আপন অঙ্গুলি যেন ঐগুলির উপর, সে বুলাইয়া বুঝিয়া লইতে চাহিয়াছে–সে চাতুৰ্য চাহিয়াছে, বিচক্ষণতা চাহিয়াছে; কিন্তু কসরৎ বুঝিতে তদীয় গেঞ্জী আট বোধ হয়; ও যে, হঠাৎ বাঘেরা খেলোয়াড়কে অদ্ভুত বুনো আলস্য ত্যাগ করিতে প্রত্যক্ষে যাহার গাত্রে পুলকমিশ্র তরাসে সিঞ্চিড়া উদগম হইল, তখনই সে যেন ধর্ম্মভীরু, একারণ যে তাহার মনে দংশিল যে আমি ডোমপুত্র সুঘরাই আমি ত ইহাকে, ইহা সব–সার্কাসের লোকদের খুঁজিতেছি না, আমি যে মনিব মহাশয়দের…এবং তাহাকে কি আপনি যেহেতু সে আপনার হস্তচ্যুত দেশলাই তুলিয়া দেয়, আপনি এখন…।
সুঘরাইএর দেহ হইতে যাহারা যে জন্তুরা একযোগে বাহির হইয়া নিমেষেই অদৃশ্য হয়, ইদানীং সেই পাঁচটিকে দেখিল, সে সাক্ষাৎ চিনিল; ইহাদের জিহ্বা লোল, ইহারা হাঁফায়, বেচারী কুকুরগুলি; যখন তাহার গাত্র হইতে সবে মাত্র জাত তখন মনোহর শ্বেতকায়া ছিল, এখন অত্যধিক হয়রানিতে উপস্থিত যারপরনাই মলিন ধূসর; ইহারা কুণ্ঠায় জড়সড়, তাহারই দূরে দূরে অবনত মস্তকে ঘুরে, ইতিমধ্যে অসহায়ভাবে তাকায় এবং কোন কৈফিয়তে ল্যাজ তাহাদের আন্দোলিত ছিল; সুঘরাই উহাদের প্রতি খিন্ন অলস চোখে তাকাইল; সে নিজে আজ্ঞাবাহক, অথচ আশ্চর্য এই ক্ষেত্রে তাহার চাহনি মাত্রই তখনই, উহারা কুকুর সকল উহারা মাটি আঘ্রাণ করত ছুটিল, ধূলা উড়িতেছে। এখন আবার পূর্বকথিত অন্ধকার; তীর্থযাত্রিদের ম্রিয়মাণ শ্রান্তস্বর শোনা গেল–তাহাদের টুকরো কথা আসিলভবভীতি, পাপ, কর্মক্ষয় হইতেছে! এখনও পূৰ্ব্বকথিত অন্ধকার, দিকসকল অন্তঃসত্ত্বা বিড়ালের ন্যায় মন্থর।
মনিব মহাশয়ের চিত্তে প্রসন্নতা নাই, বহুকালের পুঞ্জিত শুদ্ধতা বিশেষত শিব অর্চনার সুকৃতি লইয়া এক জংলীকে খুঁজিতে কাহিল। অনন্তর তিনি কয়েকজন মিস্ত্রীর সকাশে যাইলেন। ইহারা রাস্তার ধারেই এক মোটর গাড়ী সারাইতে ছিল, যে এবং ক্ষণে ক্ষণে তাহারা সারান ব্যাপার লইয়া যুক্তিতর্ক করে, যাহা অনর্গল ইতর মুখ খারাপ মিশ্রিত; সুতরাং কিছু তীর্থযাত্রী তাহাদের কাছের একটি গাছ তলায় বসিতে যাইতে থামিয়া বেশ দূরে চলিয়া গেল। মিস্ত্রীগণ কুলি কামারীরা যে নিদারুণ খলমতি ছোটনোক প্রকৃতির স্বভাবতই ইহা তিনি জ্ঞাত। ইহাও সম্যক বিদিত যে, ইহারা মৰ্য্যাদার কিছু বা কোন কাহাকেও, দেখিলে চোয়াল ঘর্ষণ করে, তাই তিনি ইতিমধ্যে একবার দ্বিধায় পড়িলেন, এ কারণ যে উহারা এক তীর্থ আগতদের মধ্যে কশ্চিৎ উড়িষ্যাবাসী প্রিয়দর্শনা ডাগর যুবতী রমণীকে লক্ষ্য কেমন যেন করিতেছিল–এই সূত্রে, বিদ্যুতে, হিজড়ারা আভাসিত হয়, এখন পুনৰ্বার হাতুড়ি ও অন্যবিধ শব্দ হইল।
মনিব মহাশয় প্রস্তুত, বিনীত, ইহা নিবেদিলেন,–ভায়া, এক দেশওয়ালী ছেলে, তাহার চোখে জল ছিল, অবশ্য আদতে সে অনুমান করে যে আমরা হয়ত গাড়ীভাড়া উদ্দেশ্যে তোমাদের কাছে আসিতেও পারি খোঁজ খবর করিবারে, তাই, এখানে আইসে; এঞ্জিনের কিয়দংশ নিরীক্ষণে মহাভয়ে সে বিচলিত, তত্রাচ উহার এঞ্জিনের কটু চেহারা তাহারে যথাক্রমে আকর্ষণও করে, ও যে তোমাদের কর্মকুশলতায় সে বিস্ময়াবিষ্ট, ও তদীয় জিহ্বা অনেক কিছু প্রশ্ন জন্য সরস হইতে আছিল বটে, যে বিরাট টায়ার উত্তোলনে সাহায্য করিতে চাহে এবং যাহারে তোমরা অশ্লীল বচনে খেদাইলে–ঠিক যখনই সে কলকজার বৈজ্ঞানিক সূক্ষ্মতায় বিমোহিত, যখন উহা তাহার চমৎকার স্মৃতি হইতেছিল! এখন বলিতে পার সে কোথায় গেল।
এবং যে স্থলে অনেক মনোহারী পসরা-মেলান দোকান; সুঘরাই একদা চামেলীর মাতোয়ারা সৌরভে সচকিত, যে সে তির্যক নয়নে রকমওয়ারি শিশি সকল নজর করিল, ঐগুলি চাকচিক্য সমন্বিত, এতেক মধুর মনোজ্ঞ গড়নের যে যেন উহারা হেঁয়ালী গীত জানে! এহেন আতরের দোকান সাক্ষাতে সুঘরাই যেন রিখিয়াতেই, কোন ক্ষোভ নাই। অতএব মনিব মহাশয় বিচার করিলেন এমন যে, এখানে কিছু সময় হয়ত বা অতিবাহিত সুঘরাই দ্বারা হইয়াছে।