তাই তৎকালেই বেচারী অসাধনেই কান্দিয়া উঠে; তীর্থযাত্রীরা তাহার পানে এলেবেলে দৃষ্টিপাতে শিব জয়ধ্বনি করত জলদে পা ফেলিয়াছে, সুঘরাই কৰ্ত্তব্য নির্ণয়ে অপারগ, সে মনিবদের কোথায়। খুঁজিবে, অনেক বাঙালী তীর্থকামী বা পথচারীকে সে এহেন ঘোরে, উদ্বস্ত করিল; ক্রমে তাহার অত্যুগ্র আশা যাতনা, যাতনা প্রস্তর হইল; এ সময়ে ইতিমধ্যে পাঁচটি জন্তু যেন তাহার গাত্র হইতে উদ্ভূত হইয়া দিকে দিকে দৌড়াইল; এখন সাইকেলের ঘণ্টি শুনিতে থাকিয়া যে সে ঘুমাইতে এলাইয়াছে; বুঝে যে তাঁহাদের তন্নতন্ন সন্ধানের ফলে নিজেই অবশেষে সে হারাইয়াছে; ক্রমাগতই সে হারাইয়া যাইতেছে।
তৎপ্রযুক্ত তাহার নিকট ঝটিতিই চমকেই সমস্ত কিছুই যেন ভিঞ্জাতীয় আলুনি, যে এই বিষমত্বে একবার, এবং সে সুমহান ত্রিকূটপৰ্বত দেখিলেক, ডিগরিয়ার দিকে তাকাইল; এখন উভয়ের বর্ণান্তর পরিলক্ষিত হইয়াছে, সে প্রত্যক্ষও করিল: চেঞ্জাররা সার বাঁধিয়া ডিগরিয়া-র মুখোমুখি দাঁড়াইয়া প্রশস্তি জানাইল, কহিল, গ্র্যাণ্ড! কি সুন্দর! এই ঘোষণার নিমিত্ত কত অন্ধকার তাহারা পরিত্যাগ করিয়াছে– এমনও যে অতীতকে নবকলেবর দিয়াছে–নিশ্চয়ই এতাবৎ কলিকাতার ঘিঞ্জি হইতে ছাড়া পাইয়াছে, তাহারা আপন কুটস্থ প্রতিবিম্ব দেখিল।
তাহাদের–এই উক্তিকে এই পদবন্ধ যেন হারমোনাইজ করে–যে অলিগলিতে বড়রাস্তায় আমরা প্রেমকে অস্বীকার করিয়াছি! পৰ্বত দুইটিই যেন সম্পূর্ণ অচেনা, এবং সে যুগ কুঞ্চিত করিল, বুক তাহার মোচড়ায়-হায় মোহিলির গ্লানিতেই ইহা ঘটিয়াছে–হায় অধম মোহিলিই ঐ বেচারীদের ঐ পাহাড় দুইটির সৰ্ব্বনাশ সংসাধন করিয়াছে।
যে উপলক্ষে ঐ পাহাড় দুটির বিদ্যমানতা সেই যন্ত্রটিই মূর্খ স্বার্থান্ধ চামার পুত্রদ্বারা ধূলিসাৎ হইয়াছে, হা দুঃখ! চরাচর তিমিরাচ্ছন্ন যেন এখন গোশাবক ও গাভী সকলের কোন দিক নাই, চারণ ভুমি হইতে কেমনে ফিরিবে, কোন এক গাভীর ললাটে সিন্দুর তিলকও দেখা যায় না, খুরখাত অদৃশ্য, দিক। তিমিরাচ্ছন্ন। সুঘরাইএর অন্তরে উপস্থিত এই ছবি প্রতিভাসিত। এখনও ঐ প্রাকৃতিক শোভাদ্বয় নিছক অপরিজ্ঞাত, তথাপি সে উহাদের স্মরণ মননে আছিল যেন যে নিজেরে হারাইয়া না ফেলে।
ইহা খুবই সাধারণ এবং নির্ঘাত যে তদীয় মনিব মহাশয় তাহারে খুঁজিতে, তিনি তাহারই আশপাশ দিয়া কতবারই না চলিয়া গিয়াছেন; ইহা সে ভাবিল যে স্নেহ-প্রাণা পরম পূজনীয়া মনিবপত্নী ঠাকরুন সাংঘাতিক উতলা, অধীর, বিবর্ণ; পতিরে অনুনয় করত কৃতাঞ্জলি হইয়া নিবেদিলেন,বাবা বিশ্বনাথ, এ কি অঘটন! কি জ্বালা, কি পোড়ার, এমনতারা হবে জানলে ছোঁড়াকে…ওরে পুব জমে কি হেন পাপ করেছিলিস্ যে নিঘিন্নে জাতের পেটে এলি, ওরে অন্য হ’তে পালিনি, মাহাতো কিম্বা কাহার কত শত জাত ত ছিল; হায়রে কোথা রাম রাজা হবে, না, হায়রে! ছোঁড়া এখনও হয়ত উপসী, দাঁতে কিছুটি। কাটেনি গা, চন্নামেত্তর খাবে, বাবার পেসাদ পাবে বলে, আমারই মরণ দশা, তোমার কথা তখন হেলা না হলে করি, গোখুরি হয়েছে, এমন জানলে! আমার মাথা খাও, পায় পড়ি, জানি একে ছোঁড়া মূর্তিমান পাপ, তলাস করিতে তোমারও ভোগান্তির সীমা নেই, তবু দেখ, ইদিকে বেলা যায়।
তদ্বিধ খেদোক্তি মিনতি সুঘরাই সুস্পষ্ট অভিধানে শুনিতে যেমন পাইল। আর যে সেবকবৎসল মনিব মহাশয় সর্বক্লেশনাশিনী উদ্বিগ্ন পত্নীর ঈদৃশ উৎকণ্ঠা সমঝে ও রমণীর হিসটেরিয়া রোগনিমিত্তও বটে এখন দ্বিরুক্তি করেন না! অথচ স্বভাবতঃ তদীয় সত্তা আর একে পরিণত, সমস্ত অস্তিত্ব এখন আর্কিটেকটনিক ব্যঞ্জনা যাহা মন্দিরের ফুলচন্দন কর্পূরগন্ধ গম্ভীর অন্ধকার মিশ্রিত এবং কণ্ঠ এখন কাব্যবীজে স্ফীত হইয়াছিল এবং এহেন অবস্থা লইয়া নীচজন্মাকে তথা সেই পাপের পুনরপি অনুসন্ধান শুরু হইল।
সুঘারইএর মানসে সেই ঘোর শ্যাম গোচারণভূমি থাকে, এখন সেই ত্রস্ত গাভী একভাবে হম্বারবে আকাশকে অভয় দিতে আছে, যে তাহারা বিভ্রান্ত উত্তেজনায় পরমাদে একে অন্যরে সংঘর্ষে, বেচারীদের গললগ্ন ঘন্টি ক্ষিপ্তক্রমে বাজিতে অনবরত থাকিয়া উত্তপ্ত; ধ্বনিভেদ তাই, বহুদূর স্থিত সাঁওতাল পল্লীতেও শ্রুত, এরূপ অবাক ধ্বনিব্যঞ্জনায় উত্তেজিত হইয়া সাঁওতালরা মাদল বাজাইতেছে, হায় বেচারীদের গরু নাই! দাবদাহর সঙ্কেতেই খবরেই একে অন্যের হাত ধরে! ইদানীং অথৈ রিখিয়ার পথে পথে নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকার, চৌকিদার পথ লাঠি ঠুকিয়া হাতড়ার অন্ধ যেমন বা।
নিশ্চয়ই মনিব মহাশয় ঐ ছ্যাকড়া গাড়ীর সামনে যাইলেন, সেইটি স্থিতবান আছে, সেইটি কৌতূহলোদ্দীপক, যাহার আশেপাশে সার্কাসের খেলার তাকলাগান ছবি প্রলম্বিত, যে গাড়ীর ভিতর হইতে হ্যাঁণ্ডবিল বিলি হইতেছে, যাহার ছাদে কেলড্রাম, ক্লেরিওনেট, করনিট বাজিতেছে; গাড়ী মধ্যে দেখা যায়, তিনি যিনি বাঘের খেলা দেখান, যাঁহার বুকে বাঘনখ আঁটা রূপার ঘড়ির চেইন, ইঁহার মরদ গোঁফে দারুণ কেয়ারি; উনি ঘুমন্ত; মনিব মহাশয় উঁহার পানে চাহিলেন।
বাদ্য ঢক্কানিনাদ তীর্থযাত্রীরা মুহুর্মুহু জয় শম্ভু যোগেশ্বর, এইরূপ আপন ইষ্টর নাম তুলিতেছে, ইতিমধ্যে দ্বাদশ লিঙ্গের নাম গমক দিয়া উঠে, তন্মধ্যেও আপন অহঙ্কার ফেলিয়া তিনি, বাঘেরা খেলোয়াড়, ঘুমে কাদা; অথচ বক্ষের মৃত খবরে–কি জানি বাঘনখ বা কি, কি জানি ঘড়িই বা কি অদ্ভুত কামুক ভুবন্ধাই; নিশ্চয়ই সুঘরাই অনেক বালকের তর্জ্জনী নির্দ্দেশ নিয়ন্ত্রিত ইহারে অবলোকন করিতেছিল, অবশ্য সে চোখের জল মুছে নাই, সত্যই ইনি ভীতিপ্রদ ইনি আনন্দও!