কোন রকমে সুঘরাই শিবগঙ্গার কাছে আসিল; প্রথমেই ইহা সহজ হয় যে সে এতাবৎ শ্বাস যাতনায় অত্রাহি ছিল, যে যেমন তাহার অন্তর বাহির কুশ্রী গন্ধের ঘর, তাহার সমগ্র দেহ সীসক পরিপূর্ণ; উপরন্তু সে হঠাৎ মৃগী রোগাক্রান্ত রাত্র, যাহা বিস্মৃত সম্প্রতি, ভেদ করত এখানে সে সহজ; সে পূতঃসলিল ঐ মহিমান্বিত জলাশয়ের পানে অনিমেষনয়নে চাহিয়া বলিয়া উঠিলেক–আঃ কত কত পাহাড় পাহাড় জল, আঃ কত কত আমি। যে এবং ইদানীন্তন ‘আমি’ শব্দকে সে ডরিল না যাহা চমৎকার অনুরণন তাই।
এখানে ওতঃপ্রোত হইল কোন একজন ব্যক্তি এই পবিত্র জলে, অধোভাগ নিমজ্জিত যাহার, কৃতাঞ্জলিপুটে ঊর্ধ্বলোকের দিকে নিস্পলকদৃষ্টিতে ছিল, ইহা স্পষ্টই সে উদকক্রিয়ায় ব্যাপৃতা ঘাটেতে যাহার স্বজনরা, প্রায়ই স্ত্রীলোক শশাঙ্গীত গাহে।
এই ব্যাপারের নিকটে একজন সন্ন্যাসী সশিষ্য অবগাহন করিতে নামিয়াই ঐ অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষে এবম্প্রকার উদ্বেলিত যে হা রাম হা রাম নিনাদে অর্ধবাহ্যদশা প্রাপ্ত হইলেন, শিষ্যরা তাঁহাকে ধারণ করিয়াছে, এই সন্ন্যাসী তদ্ভাবাপন্ন আবৃত্তি করিতে থাকিলেন, হা রাম!…
বিশেষতঃ চতুর্দিকেই বিকশিত কানন, তাহাতে মন্দাকিনী মনোহারিণী মূর্তি ধারণ করিয়াছেন। সীতা সমভিব্যহারী পরম যশঃশালী রাজকুমারগণ সকলেই অতি কষ্টে তথায় গমন করিলেন অনন্তর তাঁহারা কর্দমশূন্য সুপ্রশস্ত ঘট্টে অবতরণ করিয়া ‘এতদভবতু’ বলিয়া পিতৃদেবের উদ্দেশে জলদানে প্রবৃত্ত হইলেন, রাম তৎকালে জলপূরিত অঞ্জলি গ্রহণ পূৰ্ব্বক, দক্ষিণাভিমুখে দণ্ডায়মান হইয়া রোদন করিতে করিতে কহিলেন–হে রাজশার্দুল পিতা! আপনি পিতৃলোকে গমন করিয়াছেন; অতএব এক্ষণে আপনার উদ্দেশে মদ্দত্ত সুনিৰ্ম্মল জল অক্ষয় হইয়া পিতৃলোকে উপস্থিত হউক!…
এখনই শিষ্যরা ‘ওঁ রাম’ ধ্বনি দিল।
অবশ্যই ইহারা রামায়েৎ। সুঘরাই এই রামকথার অনেকখানি ভাষাগত বাধা সত্ত্বেও অনুধাবন করে; সে এহেন প্রহেলিকার সূক্ষ্মতায় এতই বিক্ষিপ্ত যে ঊর্ধ্বে দেখিতে উহার ভরসা নাই, সামনের জলরাশি আর সে নহে; অদ্ভুত শেষ রাত্রি ঘনাইয়াছে, আবার ভয় উপজিল, সে অথবা বাষ্প হইয়া যাইতেছিল।
সে ঐ স্থান ত্যাগ করিয়া এই বাগে আসিল, যেখান হইতে এখন পুনৰ্বার অতিক্রান্ত মহল্লা নজরেই তদীয় মন পাঙাশ হয়; যে মন্দির আগত অনৈসর্গিক সুবাস তাহারে, অভ্রান্ত যে রমণীয় ভাবপ্রসারতা দিয়াছে, যে গভীর কুয়া হইতে উত্তোলিত জলে-রৌদ্র-দেখার-অবাক তাহাতে আছে, তৎপ্রভাবে, এখানকার আলো সে অনুভব করিয়াছিল আর যে সে অশ্বথের বীজের তুল্য অসংখ্য হাটবার পার হইয়া কোথাও উদগত হইয়াছে।
যদ্যপি যে তদীয় শুদ্ধাস্পদ মাননীয় মনিবরা সেখানেই মন্দিরেই অপিচ গলির জটের মধ্যে, প্রবেশ করিতে জী চাহে নাই, তবু মনে হয় তাহার ইতস্তত হাল্লাঝুরির কালীবাড়ীর গেটে যেন সে আছে, সেখান হইতে সোজা এই শিবমন্দিরের এক চোরা পথ আছে, ইহাতে তাহার আশ্চর্য্য কম্পন দেখা দিল যে তাহার মধ্যে মনিবদের কম্পনও সঞ্চারিত, বুঝিল যাঁহারা একদা হাল্লাঝুরির কালী মন্দিরের গেটে থমকাইয়াছিলেন, কেন না বাগানের অপ্রশস্ত তিনটি পথের মুখে ফলকে লেখা ইড়া, পিঙ্গলা সুষুম্না এবং অবশেষে শ্রীশ্রীতারা ব্রহ্মময়ী বিগ্রহ-তদৃষ্টে যদিও তখন ভোরবেলা তবু দম্পতিদ্বয় মর্মরিত অবশ্য সুঘরাইএর আন্দাজ তাঁহারা একে অন্যের হস্ত ধারণ করেন।
উপস্থিত গলি সকল তাহারে অসম্ভব বিশুষ্ক করে, যে তাহাতে ঈদৃশ উদ্বেগ যে ঐখানকার অশরীরী হিমবাহ গন্ধতে নিঃশব্দে ঘটির মত ডুবাইতে পারে; অথচ না-যাইতে-পারার ক্ষোভে সে অধৈৰ্য্য; এবং সে ক্রন্দন নিমিত্ত স্বরবিকারের আয়াস পাইল–অবশ্য ধৰ্ম্মত ইহার কারণ এই হয় যে তাহাকে যাইতেই হইবে, এখনও সে পদচালনারহিত তবুও, এখানকার জনসঙেঘর ব্যস্ততার কেন্দ্রে সরল নিঃশ্বাস লওয়ার অস্বাচ্ছন্দ্য নাই যাহা তাহার ভাল লাগে, মানে পরোক্ষে মন্দিরের নিকটের হট্টকারিতা, যাহা স্মরণে আপাতত নাই, অথচ তাহাতে ক্রিয়াশীল অজ্ঞাতেই।
তৎসত্ত্বেও কোনরকমে সুঘরাই খানিক পথ অগ্রসর হইতেই কেমন এক উদ্দীপন তাহার অন্তরে পুনরায় সংগঠিত হইল; সে যেমন কোন শোভাযাত্রা দেখনের নিবন্ধন প্রমত্ত, নিম-হরিৎ ধান্যমঞ্জরী থরথরিত রতনচূড় শোভিত হস্তে নববধূ যেন স্মিত হাস্যে আসে; জনতা উথলিত-হর্ষোৎফুল্ল আঃ মিথুন আঃ মহেশ্বরী আঃ গিরিনন্দিনী! ত্বমেব সা ত্বং সাবিত্রী ত্বং দেবী জননী পরা, বচনে বিস্ফুরিত, কেহ বলিল, রে চক্ষু ইহার পর তোর জ্যোতিঃ ক্ষয়প্রাপ্ত হউক। এখন সুঘরাই ধাইয়াছে ঐ কাঁঠাল পত্রে তেল ও মেটে সিন্দুর অভিজ্ঞার লোভে; একদাও ভাবে নাই সেই গলির গন্ধের বিষয়ে; যেন শোভাযাত্রা এখনও, এই সংস্কার হয়, যে আছে, সে আবার দেখিতে পাইবে আর সে নির্ভীক চলিতেছে।
অচিরাৎ পাণ্ডাঠাকুর মহাশয়ের সহিত ভাগ্যশ সাক্ষাৎকার ঘটিল, যে এবং তিনি স্নেহপ্রযুক্ত কণ্ঠে আজ্ঞা করিলেন, দৌড়াও দৌড়াও তোমার বাবু ও মাতাঠাকরুন তোমার সন্ধানে গিয়াছেন, কেন তুমি ভয়ে স্থান ত্যাগ করিলে, শিব থাকিতে ভয়, নির্বোধ বড় তুমি হে ছিঃ ছিঃ।
তদনুবর্ত্তী সুঘরাই অসহ্য উৎকণ্ঠায় দৌড়াইল, যেন তাহার স্বকৃত জিগীর তাহার পশ্চাদ্ধাবন। করিয়াছে। নিরন্তর বিশ্রী গন্ধে সে ক্রমান্বয় কালো। সে, সুঘরাই গলিভেদে যেক্ষণে খোলামেলায় তখনই। তাহার মানসিক যন্ত্রণা সমুদ্ভূত হয়; কোন দিকে সে যে চাহিবে তাহার তাহাতে মতি ছিল না। মঙ্গল বাদ্যকারী ঢাকীদের নৃত্য, বিভিন্ন দেশীয় তীর্থযাত্রী প্রবাহ, যে পাছে-হারাইয়া যায় তাই একের সহিত অন্যের রমণীগণের আঁচল বাঁধা, এ সকলি তাহার চোখে; একদা সে অত্যন্ত অসহায় বোধে নিষ্পেষিত, দেখিল সামনের শিবগঙ্গার জলের কোন কিনারা নাই, শুধু জল আর জল, সূৰ্য্যকে ইস্তক খাইয়া সারিয়াছে!