ইহারা বেচারীরা স্বার্থোদ্ধত পন্থ চালিত ধৰ্ম্মার্থে শহীদ হইবেক, ইহারা সকলেই মদ্যপ এবং যে নানাবিধ নেশা বিজড়িত, এখন ইহাদের নেশা আড়ান কণ্ঠে ইহারা যাহাদের ছন্দানুবর্ত্তী সেই দুষ্টমতি নেতৃবর্গের নাম ঝটিকা দিতেছিল, যেমন যাহা কুৎসিত অশ্লীল পদ, নামগুলির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ যে কি তাহা পাণিনি জানেন! এই ধুরন্ধরেরা নেতৃবর্গ আদতে নীচযোনি ফিরিঙ্গীপ্রসাদ, ইংরাজ শালাদের দাস, এই সকলের নামে আকাশে বাতাসে তড়কা লাগিতেছিল ঐ বেচারীদের প্রমত্ত রোলে, ইহারা নিম্নজাতিরা ঐ ধূৰ্ত্তদের প্ররোচনায় ভয়াল, তথাপি সত্য বটে ইহাদের কাহারও কাহারও চোখে অশ্রুধারা ছিল।
যে এবং ক্রমেই ইহাদিগের অপ্রতিরোধ্য চাপে বিপ্রকর্ষণে সকল কিছুই বিধ্বস্ত এমত, সকাল কুক্সটিকা হইল; বহু আৰ্ত্ত বহু বৃদ্ধ হা হা রব করিল, যে শিবের সহিত বিবাহসূত্রে আবদ্ধ করিতে যে সুলক্ষণা উমারূপিণী ষড়ৈশৰ্যময়ী সৰ্বালঙ্কারভূষিতা কন্যারে শঙ্খ মঙ্গলাচারে লাজবর্ষণে ঘন ঘন উলুধ্বনি ও গীত ও নৃত্যবাদ্য সহকারে আনয়ন করা হইতেছিল তাহাও রাবণিক পাশবিক কদৰ্য্যতায়ে লণ্ডভণ্ড, হায় অলৌকিক বিবাহ! হা লজ্জা! উহারা অলৌকিক কন্যার মস্তকোপরি কিংখাবের চন্দ্রাতপ অপহরণ করিল, আপনাদের মধ্যে কাড়াকাড়িতে যাহা শতচ্ছিন্ন হইল, কন্যা কিছুক্ষণ ন যযৌ ন তস্থে, ঝটিতি উন্মত্তের ন্যায় দ্রুত দৌড়াইয়া অর্গলবদ্ধ মন্দিরস্থ সদর দ্বারে আঘাত করেন।
যে সকল শিশুদেরকে ত্রিনয়নের চরণ বিধৌত বারি সিঞ্চনের বিধায়ে আনা হইতেছিল তাহাদের অবস্থা সঙ্গীন, কুকুর তারস্বরে ডাকিয়া উঠে, ইদানীং এক ভীমকৰ্ম্মা নৈরাজ্যের মথন হইল; যে, সব মহামূল্যবান মণিময় খচিত স্বর্ণভুজঙ্গ কোথাও বা স্বর্ণ রৌপ্য থালি পতিত, কখনও বা খোদাই করা অত্যুৎকষ্ট মৰ্মথালি চুর্ণীকৃত হইয়া রাস্তায়ে, বিভিন্ন দেশের স্মৃতি তুচ্ছ হইয়াছে; এবং হীরক সমন্বিত ও বিবিধ রত্ন মণ্ডিত ত্রিশূল, আরও যে অপরূপ-দর্শন নীলা পান্না অলঙ্কৃত বৃষ, এতদ্ব্যতীত যাহা যথা আশ্চৰ্য রাজসিক স্বর্ণসূত্রে গ্রথিত রুদ্রাক্ষ ও স্ফটিক জপমালা যে এবং সর্বোপরি অলোকসামান্য মহাদ্যুতিময় চন্দ্রকলা যাহা মনন মাত্রই বহুপুণ্যে সৰ্বগুণযুক্ত জাতি শ্রেষ্ঠ হিন্দু জন্ম সার্থক হয়–যে। কোন-র নির্বিকল্প সমাধি হইতে পারে, এখন যতেক সম্ভার অর্ঘ্য ভূলুণ্ঠিত।
এখন সেই সেই লোকেরা কেহ কেহ ক্রন্দিত কেহ সভয়ে অগ্রসর হয়, আর কেহ কেহ ঐ অমূল্য নিদর্শনগুলি আত্মসাৎকরণে কিলকিলা রব করিল, এহেন বিবৃত্তপাকে অসংখ্য পায়ের ফাঁকে কশ্চিৎ কিম্ভুতদর্শন মুখোসধারীও লুণ্ঠনে ব্যগ্র, নেতৃবর্গের বিদেশী ঘড়ি শোভিত হাতও কর্মতৎপর, আর যাহাদের বাহুতে সুইবিদ্ধ ব্যথা তাহারা জিগীর আস্ফালন জেংগীল পাখীর ন্যায় আর্তনাদ করে।
এখন ঐ তাণ্ডব সঙঘটনে বেচারী সুঘরাই মহা বৈচিত্তে, যে সে কোনদিকে যাইবেক ভাবনায়ে বিশৃঙ্খলতা; নির্ঘাত ইহা, ঐ দেবস্থানের পবিত্র সৌরভ ত্যাগ করি যাইতে সে অভিলাষী না, কিন্তু বেচারী মন্দভাগ্য। কাছের এই পৈশাচিকতায়ে সে অসুখী, সে বিভীষিত অথচ অবলীলাক্রমে সুঘরাই বুঝিল যে সে উহাদের একজন, সেও নিশ্চয়ই উহাদের একজন! অতএব আপনারে বাঁচাইতে সুঘরাই নিয়তই। সরিতে পদক্ষেপ করে, অথচ তমুহূর্তেই সে যেন ভূতগ্রস্ত উহাদের মতই জিগীরও দেয়, এই সে কিলকিলা রব করিল, এই সে আর্তনাদে বিকট; নিজেই নিজের বাদ সাধিল, ঘোষিতে চাহিল যে আমি উহাদের একজন। খানিক বাদে দেখা গেল ক্রমাগত পাণ্ডাঠাকুর মহাশয়রা নিজ নিজ ভৃত্যগণসহ দ্রুত। পদসঞ্চালনে এখানেতে আইসেন; সম্প্রতি যমের অরুচি বৈপ্লবিক নেতৃবর্গরা পিট্টান দিল, কেন না। অভিনব ধর্মার্থীদের উপর বেধড়ক দুরমুশ আরম্ভ হইয়াছে।
যে অবশ্য সে এই বৈগুণ্য, ঐরূপে নিজেকে কবুল করার বৃত্তি, একদা যে কাটাইয়া উঠিয়াছে ইহা সম্যক তাহার উপলব্ধি তখনই হইল, যখন সে বেশ ব্যবধানে; এবার পলায়নের কথা; এবং অজস্র জটিল গলি সে ঘুরিয়াছে, এক একটিকে সে উপর্যুপরি বেড় দিয়া থাকে, এ কি বিড়ম্বন। তাহার স্বভাবগত সরলতায় সে পতঙ্গের প্রায়; এই সঙ্কীর্ণ পথে কেহ কোথাও নাই; শুধু দেওয়াল পরম্পরা। পূর্বাহ্বের হিরণ্যকশিপুর দুঃস্বপ্ন তাহার হাসি কান্না শোষণ যেমন করিয়াছে; কেবল দুজ্ঞেয় অশ্লীল ভীতি তাহাতে অথচ, উপস্থিত এই ধন্ধ হইতে নিষ্কৃতি লাভ মানসে সে ছুটিয়াছিল।
হঠাৎ এক সময় সাহসভরে সুউচ্চ বাড়ীগুলির শীর্ষে নেত্রপাত করিল, সে সূৰ্য্যালোক দেখিলেক, নিম্নে গলিময় যে ধূসর কুয়াশাচ্ছন্ন যেমন তাহারও প্রত্যক্ষ হইল, বুঝে ইহা পাণ্ডা পাড়াই; আর খানিক অতিক্রমে যে সে স্তব পাঠের আওয়াজ পাইল, ইহাতে এবং সে যেন বহু দূরের শাল গাছের পিছনে; যে সে পায়রার কলরব বুঝিল, যাহাতে যেন কাহারও নাম; যে সে সদ্যঃস্নাতা স্তোত্রে কোন বিস্ফুরিতাধারা রমণীকে কলস কাঁকে আসিতে দেখিল, যুগপৎ অন্তরে বিঘোষিত হইল, আঃ জল! জল! এই বশম্বদ আপনাকে চিনিল যে এবং তদীয় সটান-বুনটে-থাকা প্রত্যঙ্গসকল শ্লথ হয়; আর তাহাতে সুপ্রতিষ্ঠিত ইহা ধ্রুবই যে সে আর অধম নয়–যেহেতু সে বাঁচিয়াছে।
কিন্তু তা সে অতিষ্ঠ এ কারণ যে, কুহকময় বাড়ীর ঘোর, গলির তির্যক গতি, হাই উঁচুতে গবাক্ষে লাখবন কাঞ্চন-জিনি যুবতীর আনন ক্কচিৎ দৃশ্যমান এবং বিশেষত পথিপার্শ্বের বীভৎস নর্দ্দমা ও পাইখানার নাড়ী-মোচড় গন্ধ–যেখানে ইতঃমধ্যেই তাহার বিগত সংজ্ঞা-বিঘাতক-অভিজ্ঞতা পচিয়া বিকট–ইহা সমুদয় মিশ্রিত হইয়া তাহার কায়িক অশান্তি ঘটায়; ও ইহাতে তাহার দৃষ্টি ঝাঁপসা, যদিও সে নবীভূত এক ঘটনা নিজেই, অধিকন্তু যে সে পথের ঠিকও পাইয়াছে যদিও। সহসা এক সময়ে যে সে আপনকার করতল নিরীক্ষণ করিল যাহা শূন্যই, যেমন কিছু ছিল, যেন কিছু খোয়া গিয়াছে এই বিবেচনায়, অনুভবে, পশ্চাতে অসহায়ভাবে তাকাইয়াছে; আর সে স্থানীয় ভৌতিক গন্ধকে অব্যাহতি লাভে মরিয়া যে কিন্তু সফলকাম নহে।