গাড়ীতে জিনিসপত্তর তোলাই ছিল । মোহিত সত্বর গাড়ীতে উঠিয়া বসিল । বিলাস একবার বলিবার চেষ্টা করিল ডাক্তারের কাছ হইতে বিদায় লওয়া উচিত । মোহিত সাধারণভাবেই কহিল “পরে হবে…” পরক্ষণেই নিজের কথা সংশোধন করিয়া কহিল…“মানে কতবার নেবে…চল…চল ট্রেন ফেল হবে ।”
এখন বিলাস সিঁড়ির কাছেই, তাহার চোখ সম্মুখের জমিতে কি যেন বা খুঁজিতেছিল ; যাহা খুঁজিতেছিল তাহা তাহার নজরে পড়িল, সেই নীল কাগজের পিণ্ড, এখন ঘুমন্ত পক্ষীশাবকের মত চুপ! বিলাস এক পা অগ্রসর হইতে গিয়া থামিল, এতকাল সে শুধু আশাই করিয়াছে, মানুষ যে মনস্থ করিতে পারে এ ক্ষমতা তাহার জানা ছিল না । মনস্থ করিতে গিয়া হঠাৎ সে এক দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিল ; এ-শ্বাস যে কি হেতু তাহা ভাবিবার মত সময় ছিল না ; এবং সে আর সময়ক্ষেপ না করিয়া কাগজের পিণ্ডটি তুলিয়া পকেটে রাখিল । এইসূত্রে রঙিন কাচের ছায়ায় চেট্টির মুখখানি তাহার দৃষ্টিপথে ভাসিয়া উঠে !
এ ব্যাপার মোহিত অথবা ওমির দৃষ্টি এড়ায় নাই, মোহিত সোল্লাসে বলিয়া উঠিল “বলিনি
প্রেমপত্তর”
বিলাস স্বভাবত লাজুক, তিৰ্য্যক দৃষ্টিতে মোহিত এবং দিদির দিকে চাহিল, মনে মনে নিশ্চয়ই সে বলিয়াছিল “সত্যিই প্রেমপত্র, আত্মারামের লেখা
নয় বা অন্যান্ত ছেলেদের লেখা নয়”
গাড়ীতে উঠার সময় মোহিত প্রশ্ন করিল “বিলা কখন প্রেমপত্তর লিখেছ…”
বিলাস কি যেন বলিতে যাইতেছিল, সম্ভবত “না” । সহসা ওমি বাধা দিয়া কহিল “না আবার সুধীরকে…লোকনাথকে…”
“মেয়েদের নয় ?” মোহিত কহিল ।
“আমার মেয়ে ভাল লাগে না” “
কিন্তু ছেলে দিয়ে কি হবে…গোঁফ দাড়িতে গাল বড় কড়া হয়”
ওমি ক্ষুদ্র একটি ধমক দিয়া কহিল “ও না থাম” বিলাস বাল্যের এবং কৈশোরের কোন বন্ধুকে একদৃষ্টে এবং আড়ে তাকাইয়াও বিশেষ স্পষ্ট করিয়া স্মরণ করিতে পারিল না…। কেবল একবার যেমত বা দেখিল, লোকেন সবুজ মাঠে বলের উপর একটি পা দিয়া দাঁড়াইয়া, চুল হাওয়ায় দোলে, পিছনে কালোমেঘ, ওমির ধমকে মোহিত স্ত্রীর মুখপানে চাহিয়া স্মিতহাস্য সহকারে আপনকার বেতের টুপিতে ঈষৎ ঠিক দিয়া কহিল “সানাটোরিয়ামটা অদ্ভুত টেরিব্ল না” বলিয়া আধো রক্তিম চক্ষু দুইটি মেলিয়া অতীব দূরের দিকে ভয়ে ভয়ে নিরীক্ষণ করত ক্রমে ক্রমে আপনাকে ব্যক্ত করিল “adoring garlic with humble face. সেই দলই আমার ভাল…”
ওমি আপনার স্বামীর দিকে তাকাইয়া ছেলেমানুষের মত হাসিয়া মন্তব্য করিল “ও ডিয়ার…সানাটোরিয়াম জিনিষটা তোমার কাছে হাইলি ইণ্টালেকচুয়াল বলে বোধ হল…”
“সত্যি” প্রতিউত্তর করিয়া মোহিত বিলাসের মুখের দিকে লক্ষ্য করিল, ওমির মুখের মত গাড়ীর কম্পনের সহিত থর থর করিয়া তাহা কাঁপিতেছে না, উহা সহজ এক সুন্দর । বিলাস খুব সোজা করিয়া একটি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিবার জন্য আপনার দেহটি হেলাইয়া দিয়াছিল । মোহিত ঝটিতি “আঃ” স্বরে চীৎকার করিয়া কহিল “ড্রাইভার রোকও…” মুখে হাত দিয়া “সস” শব্দে কথা কহিতে মান করিয়া বলিল “আঃ কি সুন্দর হরিণটা—বন্দুকটা ওমি”
ওমি শুধুমাত্র আপত্তি জানাইল “আঃ মোহিত” যেমন সে আপত্তি জানাইয়াছিল তেমন অন্তপক্ষে সে হরিণশাবকের দিকে শুদ্ধ দৃষ্টিতে চাহিয়াছিল। আশ্চর্য্য এখানকার হরিণরা চলন্ত গাড়ীকে নিশ্চয়ই ভয় পায় না বিলাস, আপনার সম্মুখে ওমির স্তব্ধ দৃষ্টি তথা নয়নযুগল এবং ক্ষণিক পরেই হরিণটিকে দর্শন কালে শুনিল যে মোহিতের কথাটি তাহার কানের কাছে ভাসিয়া বেড়াইতেছে। বিলাসের কেন বার বার “কি সুন্দর–বন্দুকটা” এ-হেন বাক্য পরম্পরা গুঞ্জন করিয়া ফিরিতেছিল, নিঃসন্দেহে কথা দুইটি দৈনন্দিন সহজ গোলমালের মধ্যে মিশিবে না ; এ কারণে যে, এ-প্রকাশের অনেকটা মনোভাব একদা আকাশে উড়িয়া খেই হারাইয়াছে, কিছুটা স্থাপত্যের অহঙ্কারে কিছুটা সঙ্গীতের নিখাদ পর্য্যন্ত আবিষ্কারে ক্ষয় হয়, যেটুকু আছে এটুকু আছে। এ-কথায় মনুষোচিত ভাবধারা অদ্য বৰ্ত্তমান । এখন সে, বিলাস ঘুরন্ত হরিণ এবং পশ্চাতে সুঠাম বনরাজি ও পর্বতমালা হইতে চক্ষুদ্বয় ফিরাইয়া মোহিতকে দেখিল, দেখিল মোহিত কালহত নহে । এতদর্শনে মন্দিরের অভ্যস্তরস্থ, আশ্চৰ্য্য, তাহাকে ছাইয়াছিল। শ্রদ্ধায় তাহার মধ্যে যেমন রৌদ্র দেখা দিল, সূক্ষ্মতা গণিতের মানকে ক্ষুব্ধ করিতে চাহিল, মধ্যরাতের নৈসর্গিক স্তব্ধতার আশ্রয়ে উপলব্ধ নম্র উষ্ণতা সারাদেহে প্লাবিত হইল। এ সময় বিলাসের দৃষ্টি যে শূন্ততায় নিবদ্ধ ছিল, সে শূন্ততা গোলাপের রক্তিমতা বহন করে । ফলে বিলাস অতিমাত্রায় উৎফুল্ল হইয়া আপনাকে জ্ঞাপন করে “আমায় বন্দুকটা দাও…”
“ও না পাগল, ড্রাইভার…গাড়ী চালাও… রিকয়েল করবে না…” ওমি বলিয়াছিল ।
“তাহলে গান নিয়ে বার হওয়া কোন মানেই হয় না” মোহিত উত্তর করিল… !
“না বার হবে না, যে স্বদেশীর যুগ…বন্দুকটা চুরি যাক” ওমি কহিল ।
বিলাস কি একটা কথা বলিতে যাইতেছিল কিন্তু হঠাৎ তাহার চোখে লিনটেলের ফুলকাটা লাল নীল ভাসিয়া উঠিল, আশ্চৰ্য্য এই যে এই আলোর মধ্যে সে হারমানা মুখখানি নাই… । বিলাসের মনে হইল, ছেলেবেলার জর উপশমে প্রথম মাগুর মাছের তেজপাতা জীরে মরিচ বাটা ঝোলের মধ্যে যেরূপ মুখচোরা লাজুক পৃথিবীর নিমন্ত্রণটি থাকিত, এখানেও মোহিতের উক্তির মধ্যে সেই বাহু বিস্তার করা স্বাগতম স্বাগতম ধ্বনিটি ছিল ।
বিলাস আপনার সহিত একটি সমান্তরাল রেখা টানিয়া আপনাকে স্বতন্ত্র করত, শ্ৰাম মোহিনী মায়ার সচেতন রূপ এই সুবিস্তৃত পৃথিবীকে মহ আবেশভরে দেখিয়া লইল । তবু কি হেতু জানা নাই, যে—চাতুর্য্য অথবা সরলতা—সে বলিল, “ওমি আমার কাশী থাকাই ভাল” এবং এক নিমেষে ওমি প্রশ্নমান দৃষ্টি লক্ষ্য করিয়া কহিল, “কাশীতে গঙ্গা আছেন…”
এ-হেন উক্তিতে স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই ছোট করিয়া হাসিল ।
ঐ হাস্যের উত্তর না করিয়া অন্তপক্ষে বিলাস পুনরায় এই যশস্বিনী সৃষ্টিকে দর্শন করিয়াছিল, এ পৃথিবীতে অদ্যও নিশ্চিন্ত নিদ্রা আছে এবং আরবার জাগিবে বলিয়াই, জানিয়াই যেখানে মানুষে ঘুমায়।
গোলাপ সুন্দরী – ০৩
গোলাপ সুন্দরী – ০৩
ভালো লাগল।