মোহিত তাঁহার সরু ভ্রূ যুগল তুলিয়ে আপনকার হস্তদ্বয় ছেলেমানুষের মত ইতস্তত বিক্ষিপ্ত করিয়া কহিলেন।—“আও গাড্ অয়লমাইটি তোমার দিদি কি গল্পই করতে পারে” বলিয়াই প্রথমে বাঁ হাতে আপনার পিছু পকেটে পরে চঞ্চলতা সহকারে আপনার ডান হাতে ডানদিকের পকেট হইতে লিমুজকৃত রৌপ্য নির্ম্মিত ফ্লাস্ক বাহির করিয়া ছিপিটি খুলিয়ে এক ঢোক গলায় ঢালিয়া দিলেন।—এই ছোট সুরা আধারেও তাঁহার নামের আদ্য অক্ষর ছিল—ঝটিতি সুন্দর মুখমণ্ডলে তড়িৎ প্রবাহ খেলিয়া গেল। বিলাস দেখিল মোহিতের চক্ষুর্দ্বয় অসম্ভব মঙ্গলীয়; সে স্থির ভাবে মোহিতের প্রতি চাহিয়াছিল। মোহিত রৌপ্য আধারটি তাহার দিকে ধরিয়াই অতিভদ্র ‘সর্ রে’ বলিয়া যথাস্থানে আধার রাখিয়া, সৌখীন সিগারেট কেস বাহির করিল, এখানেও লেখা ‘M’…।
বিলাস কেমন করিয়া ডাক্তারের সহিত এতদিন ধরিয়া কথা বলিয়াছে, তেমনি ওষ্ঠদ্বয় কাঁপাইয়া ধীরে ধীরে কহিল “এম এম এম, এত মোনগ্রাম তোমার ভাল লাগে?”
মোহিত কি যেন বলিতে গিয়া খুব সাধারণ করিয়া উত্তর করিল “হ্যাঁ…আমার কাছে আমি অন্যন্ত ফেমাস ম্যান” বলিয়া হাসি দিয়া আপনার উচ্ছল রসিকতাকে বাধাঁন দিল না, বরং সিগারেটে একটি টান দিয়া কহিল “আমার এক মুহূর্ত্তও এখানে ভাল লাগছে না, পাগল হয়ে যাচ্ছি…কি অদ্ভুত dull জায়গা, নিঃশ্বাসের কি বিশ্রী শব্দ…”
বিলাসের রুগ্ন বরফচাপা রঙটা মোহিতের এহেন কথায় রক্তিম হইয়াছিল, শিশুসুলভ মুখখানি তুলিয়া সে সভয়ে সজল নেত্রে তাঁহার প্রতি চাহিয়া, পরে, ধীরে, আপনার চতুষ্পার্শ্ব উপলব্দি করিল; এই করিডোরের সাদা একটানা দেওয়াল—মধ্যরাতে রমণীয় চোখের পলকের মত—মধ্যে মধ্যে। সোনার জড়োয়া ফ্রেমে প্রসিদ্ধ ডাক্তারদের ছবি; নিকটেই কোক! সমস্ত দেওয়াল আলোর তারতম্যে। কখন বা অতীব দীন, এখানে চাপাগলার শব্দ, কোথাও অভিমান, এমন কি করাঘাত কভু বা দীর্ঘশ্বাস! এ দীর্ঘশ্বাস সম্ভবত তাহার নিজের, বিলাসের। বোধ হয় বিলাস এই বাড়ী, তথা স্থান—অথবা তাহার ইহকালের কিছুটা—সমস্ত অতীত ভালবাসিয়াছে।
এরূপ আত্মস্থ মুহূর্ত্তে সহসা বিলাস আপনার পকেটে হস্ত প্রদানের সঙ্গেই বপথুমান, যে কি সে অনুভব করে? অস্ফূট নিবিড় ঘোর এক খস্খস্ কাগজের শব্দ; এ রৌদ্রকর্ম্মা শব্দ তাহাকে চকিত রোমাঞ্চিত করিয়াছিল। কাংড়া কলমের ‘অভিসারিকা’ চিত্র দর্শনে মানুষের যেরূপ একা বোধ হয়, ধৈবতের গাম্ভীর্য্যের রাজ্যে যেরূপ একাকী বোধ করে, সেইরূপ এইক্ষেত্রে বিলাসকে পকেটস্থ এই খস্খস্ শব্দ—যাহা অন্ধকারকে নাম ধরিয়া ডাকে—বড় একা করিয়াছিল।
অন্যপক্ষে মোহিত দেখে নাই, যে সেইক্ষণে বিলাস আপনার উদ্বেগ চাপিবার জন্য, আপনার ওষ্ঠের একপাশ দাঁত দিয়া চাপিয়া ধরিয়াছিল, হঠাৎ সে সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করত, পকেটের কাগজের টুকরো দুটিকে মুঠা করিয়া ধরিয়া ঝটিতি বাহিরে নিক্ষেপ করিতেই একই ত্রস্ত উড়ন্ত পাখীর ছায়া পলকেই সবেমাত্র-পতিত কাগজের পিণ্ডের উপর দিয়া রেশ টানিয়া চলিয়া গেল। ইহাতে মনে হয়, কাগজের পিণ্ড বিলাসের সমক্ষ হইতে বহু বহু কাল দূরে সরিয়া চলিয়া গিয়াছে, নিশ্চয়ই সেখানে গাঢ় অন্ধকার। ভগবানকে ধন্যবাদ অন্ধকারের রেখা নাই।
এ কারণে মোহিত অনভিজ্ঞ চোখটি বাঁকাইয়া, নীল কাগজের পিণ্ড যাহা ইদানীং গাড়ীর ড্রাইভারের ঘুমন্ত মাথার নিম্নে বুদ্বুদ-নির্ম্মাণকারী বালকের এবং এইখানকার সিঁড়ির মধ্যবর্ত্তী যে জমি—এখানে ফুলের কেয়ারী বর্ত্তমান—সেখানে খেলিয়া বেড়ায় তাহার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া কহিল—“বিলে দু?”
মোহিতের এ প্রশ্ন বিলাসের নিকট রূঢ় বিদ্রুপ হইয়া দেখা দিল, সে কঠিন ভাবে চাহিতে জানে না শুধুমাত্র আপনার সৃজিত পৃথিবীতে চিত্রার্পিতের মত দাঁড়াইয়া রহিল। সে নিশ্চয়ই বলিতে চাহিয়াছিল “ও নো…” উহা বিলে দু নহে তথা পুনরায় জাগিয়া, পুনরায় বিশ্বাস ফিরিয়া পাইয়া প্রথম ভোরের দিকে চাহিয়া শ্বাশত হইবার মানসে কোন যুবতীজন কর্ত্তৃক লিখিত উহা কোন ডাগর বিদ্রোহের জয়ধ্বনি নয়। কিন্তু বিলাস মরিয়াছিল ফলে কোন কথাই সে বলে নাই, এ কারণে যে এখনও স্বতন্ত্র নিঃসঙ্গতার দুর্জ্জয় বীরত্ব তাহার নাই!
বিলাসকে আর উত্তর করিতে হইল না, এ-হেন সময়ে অদূরে ডাক্তার রঙ্গস্বামীর কক্ষের দোলান-দরজাটা একটু ফাঁক করিয়া ওমি বিলাসকে ইসারা করিল। বিলাসকে যাইতে দেখিয়া মোহিত অসম্ভব চঞ্চল হইয়া উঠিল।
রঙ্গস্বামীর ঘর।
রঙ্গস্বামীকে দেখিবা মাত্রই বিলাসের মনে হইল সে যেমত বা শুইয়াই আছে, পরক্ষণেই সহজ হইয়া অল্প একটু হাসিল। আশ্চর্য্য, এই ঘরে ঔষধের কোন গন্ধ নাই, পরিচ্ছন্ন এবং পবিত্র, এ-ঘর বিল্বদলের মত শুদ্ধ। একমাত্র রঙ্গস্বামীর আঙুলের নখগুলি প্রতীয়মান হয় যে, অদ্ভুত শক্ত, কেন যে শক্ত তাহা কাহারও এতাবৎ মনে হয় নাই; এখন বিলাস যেমন বা এ নখগুলির সম্মুখেই দাঁড়াইয়া ছিল, নিমেষেই সে অনুভব করে, যে না তাহা নয়, সে ঐ নখগুলির পিছনেই আছে, নিশ্চিন্তে, সুখে নিদ্রায়, এ নখে বন অন্ধকার নাই!
রঙ্গস্বামী মুখ তুলিয়া হাসিলেন “হ্যালাও ডিয়ার” ইহার পরে কণ্ঠস্বরকে সঠিক কর্ত্তব্যপরায়ণ করিয়া কহিলেন, “মাই চাইণ্ড, সব কথার তোমার ভগনীকে আমি বলেছি, তেমনভাবে চলবে, আমাকে চিঠি লিখবে, অবশ্য যার উত্তর আশা করা বৃথা…নিশ্চয়ই আমি তোমার চিঠি পড়ব…কোন রকম ভারী কাজ” বলিয়াই হাসিয়া উঠিয়া কহিলেন, “তোমার কর্ম্ম উঠে গেছে” এখানে গলার স্বরটা কেমন যেন বা অস্পষ্ট হইয়া চকিতেই পুরুষালি সদা রসিক আওয়াজ শোনা গেল “হ্যাঁ কর্ম্ম নয় কোনরূপ নয়…” এসময় একটি ভ্রূ অত্যাধিক উঁচু হইয়া উঠে “কর্ম্ম নেই—মুক্ত…সম্পূর্ণ অনাসক্ত…খ বৎ”
ভালো লাগল।