–সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
গোলাপ সুন্দরী – ০১
বিলাস অন্যত্রে, কেননা সম্মুখেই, নিম্নের আকাশে, তরুণসূর্য্যবর্ণ কখনও অচিরাৎ নীল, বুদ্বুদসকল, যদৃচ্ছাবশতঃ ভাসিয়া বেড়াইতেছে। একটি আর একটি এইরূপে অনেক অনেক–আসন্ন সন্ধ্যায়, ক্রমে নক্ষত্র পরম্পরা যেমন দেখা যায়–দূর কোন হরিত ক্ষেত্রের হেমন্তের অপরাহ্ন মন্থনকারী রাখালের বাঁশরীর শুদ্ধনিখাদে দেহ ধারণ করত সুডৌল দ্যুতিসম্পন্ন বুদ্বুদগুলি ইদানীং উঠানামা করে, এগুলি সুন্দর, উজ্জ্বল, বাবু, অভিমানী আশ্চর্য্য! এ কারণেই বিলাস, চমৎকার যাহার রূপ, যে বেশ সুস্থ, এখন অন্যদিকে আপনার দৃষ্টি ফিরাইয়াছিল কেননা এসকল বুদ্বুদ সম্মুখে থাকিয়াও পশ্চাদ্ধাবন করে কিন্তু এ-দৃষ্টিতে তাহার কোনরূপ অভিজ্ঞতা ছিল না, এ কথা সত্য যে, তাই মনেতে নিশ্চয় সে কুণ্ঠিত কেননা ইতঃপুর্ব্বে অজস্র দিনের আত্মসচেতনতার কুজঝটিকার মধ্যে সে একা বসিয়া কবিতা লিখিবার মনস্থ করে – কবি হইবার নয়, যেহেতু, সম্ভবত, রূপকে রূপান্তরিত না করিয়া ভালবাসার শুদ্ধতার দিব্য উষ্ণতা ক্রমে অস্পষ্ট অহঙ্কার পর্য্যন্ত, তাহার ছিল না যদিও – তাহার নিঃসঙ্গতা নাই শুধুমাত্র স্বতন্ত্রতা ছিল।
ক্রমাগতই সকালের আলোকদীপ্ত বুদ্বুদসকল ইতস্তত ভ্রাম্যমাণ।
বালকটি, কালো সুঠাম ন্যাংটো, মোটর গাড়ীর ফুটবোর্ডে বসিয়া একটির পর একটি বুদ্বুদ নির্ম্মাণ করিয়া চলিয়াছে; ক্বচিৎ ঊর্দ্ধে অদ্ভুত ভাবে, যে ভাবে পলাতক কাঠবিড়ালীকে দেখে, অর্থাৎ মাটির দিকে চাহনি লইয়া, বালক আপনার আয়ত চক্ষুদ্বয় তুলিয়া কি যেন বা দর্শনে হাসিয়াছে সম্ভবত প্রথম রৌদ্র অথবা গতিমান দিগ্ভ্রান্ত বুদ্বুদনিচয়। তাহার, বালকের, পিছনেই দরজায় এবং মাড্গার্ডের অবিশ্বাস্য ধূলার স্তরে অসংখ্য রেখাচিত্র, না শিশুওষ্ঠের অজস্র এলেবেলে স্পন্দন। এগুলি প্রতীকমাত্র কারণ ইহার ছাপা আতপ নাই, এগুলি প্রতীকমাত্র কারণ, ইহা গণিতের সংখ্যা আত্মিক নহে; ইহাতে দৃষ্টির অভিজ্ঞতার স্বকীয়তা নাই, শুধুমাত্র খুশীর ব্যক্তিগত অনুভব আছে। কখনও বা দুঃসহ ঝটিতি আরবীটান যখন মানসিক অধৈর্য্য, নিঃসন্দেহে, অনুভূত হয়। হায়! বালকের মধ্যেও ক্ষুব্ধ বিরক্তি আকাশ হইয়া আছে। এই গাড়ীতেই বিলাস যাইবে।
গাড়ীখানি দাঁড়াইয়াছিল, মরুপথিপ্রজ্ঞ উট যে উট বৃদ্ধ যে উট ক্লান্ত, যাহার সমক্ষে দৃশ্যমান জগতই পথ বৈ অন্য নহে; উহার ড্রাইভার, দেহা যায়, আরামে ঘুমায়, তাহার রুক্ষ গৈরিক চুলগুলি, যাহা রঙিন রুমালে বাঁধা, এখনকার হাওয়ায় ত্রস্ত, স্বস্তিহীন প্রমত্ত। এই গাড়ীর ফুটবোর্ডে, চিত্রসমূহের সম্মুখে বসিয়া বালকটি, সে শুধু বা সকালের—এখন রাত্রি শেষে দিনের সুরু হয় এ-খেলা খেলিতেছিল। তাহার হস্তধৃত এনামেলের বাটির সাবানজল-সম্ভব্ব ফেনিল উচ্ছ্বাসের নিকটে তাহারই দীঘল নয়ন যুগল যাহা অযথা ক্রুর; এবং পদদ্বয় দ্রুত ব্যগ্রভাবে নাচিয়া উঠে কখন সখন, এ-হেন বালখিল্য আধিক্য বিলাসকে যারপরনাই ব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিল; ফলে ক্ষণেকের জন্য তাহার, বিলাসের, মনে হয় সে খাটে শুইয়া আছে, এবং মাথার কাছে শুভ্র চার্ট করা কাগজ হাওয়ায় হাড়ের শব্দ করিতেছে ফলে ইদানীং আপনার সুমার্জ্জিত রুচিসম্পন্ন পোষাক কেমন গুরুভার—এতকাল ধরিয়া যাহা পরিধেয় ছি;, তাহা হাল্কা যাহাতে সে অভ্যস্ত—তাহার জন্যই বিলাসের মনে এরূপ বিকার উপস্থিত এবং এই একই মুহূর্ত্তেই রেশমী রুমালের সিভেটের দন্তযুক্ত সৌরভকে বিদীর্ণ করিয়া আবছায়া একটি প্রায়-হারমানা-পৃথিবীর হিমবাহ তৎসহ উৎকট রাসায়নিক গন্ধ পরিব্যপ্ত হয়। সে, বিলাস, আপন অস্বাচ্ছন্দ্যের কারণে, দ্রুত একটি কোটের বোতাম খুলিতে উদ্যত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ‘প্যাচ’ পকেটের দিকে লক্ষ্য করিয়াছিল, এবং এ সময়ে তাহার বাম ভ্রূ বিস্ময়কর ভাবে উপরে উঠে, সে অত্যন্তই উদ্গ্রীব কাহার একটি মন্তব্য পুনরায় শুনিবার জন্য আপনাকে একাগ্র করে। বিলাস স্থির করিয়াছিল। কিছুক্ষণ পূর্ব্বে ডাক্তার রঙ্গস্বামীর ঘরে প্রবেশ করিবার সময়, এই করিডোরেই দাঁড়াইয়া মোহিতদা বলিয়াছিলেন “প্যাচ পকেট তোমার কেমন লাগে ডিয়ার? অফুলি (হাসিয়া) স্পোর্ট নয়? দারুন স্পোর্ট!” আরও কিছু কথা হয়ত মোহিতের বলার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু ওমি অর্থাৎ বিলাসের দিদি তাঁহাকে এক প্রকার টানিয়া লইয়া অদৃশ্য হয়।
‘স্পোর্ট’ কথাটা বিলাসকে বড় খুসী করে, বড় সুন্দর করে, উহা যেন বাক্য নয়, তাহা যেন সত্যই নয়ন-অভিরাম সহজ, একটি ব্রাহ্মণী হংস, যে হাঁস তুষার অভিমানী, যৌবনশালিনী এবং যে হাঁস শূন্যতা লইয়া খেলা করে। ‘স্পোর্ট্স’ কথাটার উচ্চারণের সঙ্গেই—ইচ্ছাকৃত কষ্টসাপেক্ষ স্বরভঙ্গের সময়ই—মোহিতের পুরুষালি মুখখানি সুপ্রসন্ন সুপ্রভ নাটকীয় হইয়া উঠিয়াছিল। বিলাস দেখিল কালোসাদা ব্রোগ, সিয়াসেকার কাপড়ের, সোজা ইস্ত্রির, পাতলুন এবং কোট, পোলকা ডট সার্ট, সুঠাম বো, পকেটে ব্লু রুমালে স্থাপত্যের পরিচ্ছন্নতা, বাটনহোলে সোনার চাকতিতে M লেখা এবং সেখান হইতে ঘড়ির চেন নামিয়া আসিয়াছে। বঙ্গের গোলাপ বলিতে যে আহ্লাদ উদাত্ত হইয়া উঠে আহা নিশ্চয়ই মোহিতকে ধারণ করিয়াছিল। এইটুকু ভাবিবার পরক্ষণেই, বিলাস অস্থির হইল, এমত সময়ে কাহার জুতার শব্দ পাইয়া দৃষ্টি ফিরাইতেই দেখিল মোহিত।
ভালো লাগল।