পাখি দুটোর দিকে তাকিয়ে বেশ বড় একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল সুমির।
নূরজাহান বলল, খালেক দরবেশের ঘটনাটা শেষ করুম?
নূরজাহানের দিকে তাকাল না সুমি। বলল, হ্যাঁ।
দরবেশ সাব সারাজীবন নীল রংয়ের একখান কাপড় পরতেন। মাইয়া লোকের শাড়ির মতন কাপড়। ওই এক কাপড়ে পুরা শইল ঢাইকা রাখতেন। নীল কাপড় ছাড়া পরতেন না। খালি সিগ্রেট খাইতেন। তেমুন কথাবার্তা মানুষের লগে বলতেন না। রাস্তা দিয়া হাঁটতে হাঁটতে বিড় বিড় কইরা কথা কইতেন, হাসতেন। তাগ বাড়ি থিকা পদ্ম আছিল কাছে। জোসনা রাইতে পদ্মার তীরে গিয়া বইসা থাকতেন, একলা একলা কথা কইতেন। আসলে তো একলা কথা কইতেন না! কইতেন তো জীনগ লগে!
শীতকালেও কি ওই একই কাপড় পরে থাকতেন?
হ। শীত গরম আছিল না তার।
বিয়ে শাদি করেননি?
একথা শুনে উফুল্ল হলো নূরজাহান। এই ঘটনাটাই আপনেরে কইতে চাইতাছি।
বলো।
বয়েসকালে বিয়া ঠিক হইল দরবেশ সাবের। বিয়ার আগের দিন বউরে সাপে কাটল।
মানে? মারা গেলেন মহিলা?
হ। তারপর সারাজীবন দরবেশ সাব আর বিয়া করেন নাই। মানুষে কয় তার লগের জীনেই বলে সাপের রূপ ধইরা তার বউরে কাটছে।
কেন?
দরবেশ সাবে বিয়া করুক, সংসার ধর্ম করুক এইটা জীনেরা চায় নাই।
কারণটা কী?
আল্লায়ই জানে। মনে হয় তারা এই দুনিয়াতে দরবেশ সাবরে বেশিদিন রাখতে চায় নাই। দরবেশ সাবে যদি বিয়াশাদি কইরা সংসার ধর্ম করে, যদি তার বউ পোলাপান থাকে তয় দুনিয়ার মায়া বাইড়া যাইব, বোধহয় এইসব চিন্তা করছে জীনে।
তাহলে তিনি কি কম বয়সে মারা যান?
খুব কম বয়সে না। তয় এসব কামেল দরবেশরা তো মরেন না। তারা শরিল বদলান।
শরীর বদলানো মানে?
এক শরিল ছাইড়া আরেক শরিল নেন। সেই শরিল নিয়া পরিস্থানে চইলা যান। দরবেশ সাবের জীনরাও তারে পরিস্থানে নিয়া গেছে।
ঘটনাগুলো শুনতে ভালই লাগল সুমির। কালরাত থেকে অন্যরকম হয়ে থাকা মন কেমন যেন বদলালো। হালকা হয়ে গেল।
নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে সুমি বলল, এবার বদজীনের কথা বল। যুবতী মেয়েদের সঙ্গে বদজীনের কী সম্পর্ক, বল।
নূরজাহান একটু নড়েচড়ে বসল। বদজীনগুলি যুবতী মাইয়াগ খুব জ্বালায়। দেশ গেরামে শোনেন না, অমুকের বউরে ভূতে ধরছে, তমুকের যুবতী মাইয়ারে ভূতে ধরছে, অল্প বয়সে বিধবা হইয়া আছে কেউ, তারে ধরছে।
ভূত আর বদজীন কী এক নাকি?
একই। কেউ বলে ভূত, কেউ বলে বদজীন। আসলে সব খারাপ জিনিসই ভূত। শোনেন না, খারাপ মানুষরে অনেকে বলে ভূত। খারাপ মেয়েরে বলে পেত্নি।
সুমি হাসল। বুঝেছি।
সুমিকে হাসতে দেখে নূরজাহানও হাসল। এইবার আপনেরে একটা বদজীনের ঘটনা কই। আমগ গেরামে শিরিন নামে একটা মাইয়া আছিল। পাড়া বেড়াইনা মাইয়া। নিজেগ বাড়িতে থাকেই না। এই বাড়িত যায়, ওই বাড়িত যায়। দিন দোফর মানে না, রাইত বিরাইত মানে না। যখন যেখানে মন চায় চইলা যায়। বয়স হইয়া গেছে কিন্তু গরিব মা বাপে বিয়া দিতে পারে না। শিরিনের শরিল স্বাস্থ্য খুব ভাল। এই ধরনের মাইয়াগ পুরুষ পোলারা খুব পছন্দ করে। কিন্তু শিরিনের স্বভাব চরিত্র খারাপ না। নষ্ট মাইয়া না সে। শিরিনের সই আছিল কাজল নামে আর একটা মাইয়া। কাজলের বিয়া হইয়া গেছে। শ্বশুরবাড়ি থাকে সে। যখন নিজেগ গেরামে আসতো, কাজলরে শিরিন নিজের দুঃখের কথা কইতো।
কী দুঃখ?
বিয়া না হওনের দুঃখ।
বলেই মুখ টিপে হাসল নূরজাহান।
তার হাসি খেয়াল করল সুমি। বলল, হাসছ কেন?
ওই যে বিয়া না হওনের দুঃখ কথাটা কইলাম, কইয়া নিজেরই হাসি পাইল। আপনে তো যুবতী মাইয়া, বিয়া না হওনের দুঃখ আপনে বোঝবেন।
কথাটা আসলে বুঝল না সুমি। অবাক চোখে নূরজাহানের মুখের দিকে তাকাল। আমি কিন্তু বুঝিনি।
না বুঝলে ঘটনাটা শোনেন, পরে বুঝবেন।
ঠিক আছে। বল।
সইর লগে বিয়া না হওনের দুঃখের কথা কয় শিরিন, শুইনা সইয়ে কয়, হ লো সই, বিয়া হওনের পর, স্বামীর লগে থাকনের পর আমি চিন্তাই করতে পারি না স্বামী ছাড়া যুবতি মাইয়ারা থাকে কেমনে! সইয়ের এই কথাটা তারপর থিকা খালি মাথায় ঘোরতো শিরিনের। রাইতে ঘুমাইতে পারতো না। এই সময় একদিন বদজীনে ধরল শিরিনরে।
কোথায় ধরল, কীভাবে?
আগে শোনেন না ঘটনা। একদিন সন্ধ্যা বইসা যাওয়ার পর বাড়িত আইসা পাগলামী শুরু করল শিরিন। উল্টাপাল্টা কথা কয়, কাপড় চোপড় খুইলা ফালায়। বাড়ির মুরব্বিরা কইলো, শিরিনরে ভূতে ধরছে। ভূত ছাড়ান লাগবো। ভূত না। ছাড়াইলে এই মাইয়া ভাল হইব না। আমগ পাশের গেরামে বদর নামে একজন ফকির আছে। তার কাম হইল ভূত ছাড়ান। পাঁচ টেকা নিয়া, দুইতিন দিন চেষ্টা কইরা সে ভূত ছাড়ায়। বদররে খবর দেওয়া হইল। পরদিন সন্ধ্যায় বদর আইলো শিরিনের ভূত ছাড়াইতে। বদর ফকিরমানুষ হইলে কী হইব, দেখতে তাগড়া জুয়ান। বদররে দেইখাই পাগলামি শুরু করল শিরিন। কাপড় চোপড় খুইলা ফালাইতে চাইল। শিরিনের চোখের দিকে চাইয়া বদর কইল, তরে আমি চিনা ফালাইছি। পুব পাড়ার বাঁশঝাড়ে থাকছ তুই। তর মতন বদজীন আমি অনেক ছাড়াইছি। খাড়া আইজই তর খবর লইতাছি। তারপর শিরিনের মারে বদর কইল, ঘর আন্ধার করেন। তারবাদে আপনেরা বেবাকতে বাইরে যান। শিরিনের। বদজীন আমি ছাড়াইতাছি। যেই কথা সেই কাজ। সবাই ঘর থিকা বাইর হইয়া গেল। ভিতর থিকা দরজার খিল লাগাইয়া দিল বদর ফকির। বাড়ির উঠানে লোকজন সব খাড়াইয়া রইছে আর বন্ধ ঘরে শিরিনের বদজীন ছাড়াইতাছে ফকিরে। মাঝে মাঝে শুনা যায় বদজীনরে গালিগালাজ করতাছে ফকিরে আর শিরিন গোঙাইতাছে। এইভাবে ঘণ্টাখানেক। তারপর দেখা গেল শিরিন বেহুশের মতো ঘুমাইতাছে। সেই রাইতে পাগলামি আর করল না। ফকির বইলা গেল এইভাবে তিন সন্ধ্যা ছাড়াইতে হইব নাইলে শিরিনরে পুরাপুরি ছাইড়া যাইব না বদজীনে। তারপর দিন সারাদিন ভাল রইল শিরিন, বিকালের দিকে একটু একটু পাগলামি শুরু করল। বদর ফকির আসলো সন্ধ্যাবেলা। আবার আন্ধার ঘরে ভূত ছাড়াইল। তিনদিন পর পুরাপুরি ভাল শিরিন।