মতি বড় হয়ে গেছে তারপরও নূরজাহানকে তেমন বয়স্ক লাগে না। বাড়ির কাজের বুয়া সে ঠিকই, ছেলে নিয়ে বিধবা হয়েছে পাঁচ সাত বছর আগে তারপরও ফিগার বেশ সুন্দর নূরজাহানের, চেহারায় কমনীয়তা আছে। চাইলে এখনও বিয়েশাদি আবার করতে পারে সে। কিন্তু সেই মনোভাব নূরজাহানের একদম নেই। সে আছে এই বাড়ির কাজ নিয়ে। কাজে ফাঁকিজুকি কাকে বলে একদম বোঝে না। চলাফেরা উচ্ছল কিশোরীর মতো।
চার পাঁচ মিনিটের মধ্যে নীচতলার কিচেন থেকে সুমির জন্য চা করে নিয়ে এল নূরজাহান। কিন্তু চায়ের কাপ সুমির হাতে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বেরুল না, দাঁড়িয়ে রইল।
চায়ে চুমুক দিয়ে সুমি বলল, কী হলো, দাঁড়িয়ে আছ যে?
আপনার সঙ্গে একটু কথা বলব।
কী কথা?
কাইল রাইতে কী হইছে?
তুমি শুনলে কার কাছে?
মতি বলল।
ও শুনলো কার কাছে?
তা আমি জানি না।
কী বলল সে?
কইলো রাইতে বলে আপনে ভয় পাইছেন?
চায়ে চুমুক দিয়ে উদাস হল সুমি। হ্যাঁ।
কিসের ভয়? ভূতের?
ব্যাপারটা ভৌতিক। কিন্তু ভূতে আমি বিশ্বাস করি না।
হইছিল কি সেইটা আমারে বলেন।
তোমাকে বলে কী হবে?
সমস্যাটা মনে হয় আমি বুঝুম।
ভুরু কুঁচকে নূরজাহানের দিকে তাকাল সুমি। আমার সমস্যা তুমি বুঝবে কী করে?
নূরজাহান হাসল। আমিও তো মাইয়া মানুষ!
মেয়েমানুষের সঙ্গে ভৌতিক ব্যাপারের কী সম্পর্ক?
সম্পর্ক আছে। আপনি আমারে বলেন।
তোমার এখন কোনও কাজ নেই?
না। সব কাজ শেষ। দুপুরের রান্না হইয়া গেছে। নিজের গোসলটা খালি বাকি আছে আমার। সেইটা পরে করুম।
নূরজাহানের কথা বলার ভঙ্গিটা সব সময়ই ভাল লাগে সুমির। এখনও লাগল।
চা শেষ করে কাপটা নূরজাহানের হাতে দিয়ে বলল, বস।
সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে বসল নূরজাহান।
পুরো ঘটনাটা নূরজাহানকে বলল সুমি।
শুনে তীক্ষ্মচোখে সুমির মুখের দিকে তাকাল নূরজাহান। এইটা তো বড় আজব কাণ্ড। এই বাড়ির আশেপাশে তো খারাপ জিনিস কিছু নাই।
সুমি অবাক হলো। খারাপ জিনিস মানে?
যুবতী মেয়েদের সঙ্গে এই ধরনের কাণ্ড করে বদজীনে।
বদজীন কথাটা শুনে সুমি একটু নড়েচড়ে বসল। বদজীন ব্যাপারটা কী?
খারাপ জীন। জীন হইল দুই রকম। ভাল জীন আর খারাপ জীন। খারাপ জীনগুলিরে বলে বদজীন। মানুষের মধ্যে যেমুন ভাল মানুষ আর খারাপ মানুষ আছে, জীনের মধ্যেও তেমন আছে। ভাল জীনরা মানুষের উপকার করে আর বদজীনগুলি অনিষ্ট করে।
একটা একটা করে বল। ভাল জীনরা কী ধরনের উপকার করে মানুষের?
বহুত রকমের উপকার করে। তারা থাকেন পরহেজগার মানুষের লগে। কামেল দরবেশ পীর ফকিরের লগে। ভাল জীন দিয়া মানুষের অসুখ বিসুখ সারায়া দেন পীর ফকিররা। ধন সম্পত্তি টেকা পয়সাও জোগাড় কইরা দেয় ভাল জীনে। পথের ফকিররে রাজা বাদশা বানাইয়া দেয়। বহুত ঘটনা আছে এই রকম। ভাল জীন যদি কোনও মানুষের উপরে আছড় করে, তারে তারা আর দেশ গেরামে রাখে না। নিজেগ দেশে লইয়া যায়।
জীনদের দেশ কোথায়?
পরিস্থানে।
পরিস্থান তো শুনেছি পরিদের দেশ।
নূরজাহান হাসল। জ্বীন আর পরি তো একই। পুরুষরা হইল জীন, মেয়েরা হইল পরি। ভূত আর পেত্নির মতন। পুরুষ ভূতগুলি ভূত, মেয়েগুলি পেত্নি।
এসব আমি জানি।
জানোনের তো কথাই। এইসব কথা কে না জানে! ভাল জীনরা যে তাগ পছন্দের মানুষরে দেশ গেরামে রাখে না এমুন একটা ঘটনা আমগ গেরামে ঘটছিল।
সুমি অবাক হলো। তাই নাকি?
হ। বলুম ঘটনাটা?
বলো।
আমাগ গেরামে একজন দরবেশ আছিল। খালেক দরবেশ। দরবেশ সাবে যখন ছোট, একদিন দুপুরবেলা ঘরে ঘুমাইয়া রইছে, পাকের ঘরে তার মায় রানতে বইছে, হঠাৎ কইরা মার মনডা কেমুন কইরা উঠল। পোলার মুখটা দেখনের লেইগা পাগল হইয়া গেল। পোলা যেই ঘরে শুইয়া রইছে দৌড়াইয়া সেই ঘরে চইলা আসলো। আইসা দেখে ঘুমন্ত অবস্থায় পোলা তার শূন্যে ভাইসা রইছে। ভাইসা ভাইসা আস্তে আস্তে দরজার দিকে যাইতাছে। এই অবস্থা দেইখা মায় তো একেবারে পাগল হইয়া গেছে। দুইহাতে পোলারে জড়াইয়া ধরছে। বাজান, কই যাস তুই? এই অবস্থায় তুই কই যাস? তখন গায়েবি আওয়াজ হইল, দুনিয়া বড় বদ জায়গা। খালেকরে এখানে রাখুম না। এই আওয়াজ শুইনা মায় দুইহাতে বুকে জড়াইয়া ধরল শূন্যে ভাইসা থাকা পোলা। কইলো, না না,
আমার বুকের ধন আপনেরা নিতে পারবেন না। তারপর খালেক দরবেশরে তারা। রাইখা যায়। তয় যেই জীনে তারে নিতে চাইছিল সেই জীনটা সারাজীবনই দরবেশ সাবের লগে আছিল।
ঘটনাটা যে খুব আলোড়িত করল সুমিকে তেমন নয়। তবু সে বলল, তার মানে এরা হচ্ছে ভাল জীন?
হ।
এবার তাহলে একটা বদজীনের ঘটনাও বল।
তার আগে খালেক দরবেশের ঘটনাটা শেষ করি।
করো।
তারপর হঠাৎ করেই যেন বাড়ির পরিস্থিতিটা বুঝতে চাইল সুমি। তুমি যে এখানে, নীচতলায় কে?
মতি আছে।
মার চেম্বার লক করা তো?
হ। নীচের ঘরদুয়ার বেবাকই বন্ধ।
বাবা বেরিয়েছে কখন?
আম্মার লগেই গেছে। আম্মারে কোটে নামাইয়া দিয়া সিটি করপোরেশান না কই বলে যাইব।
বুঝেছি, বাড়ির ট্যাক্সের ব্যাপারে কী ঝামেলা হয়েছে। ভাইয়া কি আগে বেরিয়েছে?
না। সে বাইর হইছে পরে।
নীচে মতি আছে তো? চোর টোর ঢুকে যাবে না তো?
না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন।
সুমি জানালার দিকে তাকাল। পাশের বাড়ি পেয়ারা গাছে দুটো শালিক বসে আছে। এত চুপচাপ শালিক সাধারণত থাকে না। কিন্তু এই শালিক দুটো আছে।