সাদি বলল, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
মূসা সাহেব বললেন, বাড়িতে চোর টোর ঢোকেনি তো?
রুনু আইনজ্ঞ। জজকোর্টে প্রাকটিস করেন অনেকদিন ধরে। বাড়ির নীচতলায় তাঁর চেম্বার। নারী এবং শিশু বিষয়ক কেস বেশি ডিল করেন। পেশার ক্ষেত্রে মোটামুটি নামডাক আছে তার। রোজগার ভালই।
কিন্তু আইনজ্ঞ হওয়ার ফলে যে কোনও বিষয়ে জেরা করার একটা স্বভাব নিজের অজান্তেই তৈরি হয়ে গেছে তাঁর। যুক্তিবাদি মানুষ তিনি। অযৌক্তিক কথাবার্তা একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। স্বামীর কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাঁর দিকে তাকালেন। এরকম বাড়িতে চোর ঢোকে কী করে? নীচের মেইনগেট বন্ধ করলে বাড়িটা দূর্গ। মেইনগেটের পর গাড়ি বারান্দা। তারপর ভেতরে ঢোকার আরেকটা কোলাপসিবল গেট। ইয়া বড় একটা তালা সেই গেটে লাগিয়ে দেয় মতি। দোতলায় ওঠার পরও ফ্ল্যাটে ঢোকার মুখে কাঠের দরজা। আজ সেই দরজাটা আমি নিজ হাতে লক করেছি। এরকম তিনটে দরজা টপকে চোর ঢোকে কী করে? তার ওপর সুমির নিজের রুমও ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।
অকাট্য যুক্তি।
তবু আমতা আমতা করে মূসা সাহেব বললেন, হয়তো দিনের বেলায় কোনও ফাঁকে চোর ঢুকে ঘাপটি মেরেছিল।
রুনু বললেন, তাও সম্ভব নয়। কারণ সুমির রুমে তেমন কোনও ফার্নিচার নেই। বাথরুম ছাড়া ঘাপটি মেরে থাকার জায়গা নেই। তবে আমি সিওর বাথরুমে ওভাবে ঘাপটি মেরে কেউ ছিল না। কারণ ঘুমোবার আগে সুমি নিশ্চয় বাথরুমে ঢুকেছিল। কেউ থাকলে তখুনি দেখে ফেলত।
সাদি অস্থির গলায় বলল, বুঝলাম কিন্তু ব্যাপারটা তাহলে দাঁড়াল কী?
রুনু বললেন, সুমিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জিজ্ঞেস করা উচিত। নয়তো বোঝা যাবে না কী ঘটেছে।
তারপর সুমির দিকে তাকালেন তিনি। তুই যে বললি তোর রুমে কেউ ঢুকেছিল, বুঝলি কী করে? মানে তুই দেখেছিস কী না?
মা বাবা এবং ভাইয়ার কথা শুনতে শুনতে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে সুমি। বাবা তখনও তাকে জড়িয়ে রেখেছে। বাবার দুহাত সরিয়ে দিয়ে নিজেকে মুক্ত করল সে। না আমি কাউকে দেখতে পাইনি।
তাহলে বুঝলি কী করে যে কেউ ঢুকেছে?
আমার পায়ে সুরসুরি দিয়েছে।
রুনু কথা বলবার আগেই মূসা সাহেব বললেন, মানে?
আমার পায়ে কে যেন সুরসুরি দিচ্ছিল।
সাদি হেসে ফেলল। পায়ে সুরসুরি দিচ্ছিল?
রুনুও হাসলেন। এমন কথা বাপের জন্মেও শুনিনি। চোর ঘরে ঢুকে চুরি না করে কারও পায়ে সুরসুরি দিচ্ছে, শুনলে লোকে খানিক বুঝতেই পারবে না তার হাসা উচিত না কাঁদা।
সুমি বলল, আমি কি তোমাকে বলেছি যে ঘরে চোর ঢুকেছিল?
মূসা সাহেব বললেন, না না আমি বলেছি। তোদের যুক্তিতর্কে বুঝলাম চোর ঢোকেনি। ব্যাপারটা অন্য কিছু।
সাদি বলল, অন্যকিছু মানে?
রুনু বললেন, তেলাপোকা টোকা পায়ে উঠেছিল।
সুমি বলল, না, তেলাপোকা না। বেশ কয়েকবার সুরসুরি দেয়ার পর আমার ঘুম ভেঙে গেছে। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে সুরসুরিটা বন্ধ হয়ে যায়। তবু আমি উঠে লাইট জ্বেলেছি। দেখি, না কোথাও কেউ নেই। মশারির ভেতর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তেলাপোকা কিংবা ওরকম কিছু আমার চোখে পড়েনি।
মূসা সাহেব বললেন, তাহলে সুরসুরি তোর পায়ের কেউ দেয়নি। তুই হয়তো স্বপ্নে দেখেছিস তোর পায়ে কেউ সুরসুরি দিচ্ছে।
প্রথমবার আমিও তাই ভেবেছি। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছি। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার…।
কথাটা শেষ করল না সুমি।
রুনু বললেন, আবার কী হল? আবার সেই পায়ে সুরসুরি?
না।
তাহলে?
নাভিমূলের ব্যাপারটা বাবা এবং ভাইয়ার সামনে বলতে লজ্জা করছিল সুমির। ওইটুকু চেপে বাকিটুকু বলল সে, তবে বলল একটু ঘুরিয়ে। পরের বার গলার কাছটায় সুরসুরি দিচ্ছিল। ঘুম ভাঙার পর সুরসুরিটা বন্ধ হলো ঠিকই কিন্তু একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম।
রুনু ভ্রু কোঁচকালেন। গন্ধ মানে? কিসের গন্ধ?
পারফিউমের।
পারফিউমের? পুরুষালি পারফিউম না মেয়েলি?
পুরুষালি শব্দটাই শুধু নয় পারফিউমের নামটাও প্রায় মুখে এসে যাচ্ছিল সুমির, কিন্তু কী যেন কী কারণে বলতে লজ্জা করল তার। মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি মিথ্যে কথা বলল, তা খেয়াল করিনি।
মূসা সাহেব অবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছু একটা বলতে চাইলেন তিনি তার আগেই রুনু বলল, তারপর কী করলি তুই? ভয় পেয়ে গেলি? ছুটে এসে আমাদের দরজা ধাক্কাতে লাগলি?
না। বেডসুইচ টিপেছি, দেখি জ্বলছে না। তখুনি পিঠের কাছে কে যেন শ্বাস ফেলল। আবার সেই পারফিউমের গন্ধটা পেলাম। কে কে করে চিৎকার করলাম। তারপর অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে দরজা খুলে…।
মূসা সাহেব রুনুর দিকে তাকালেন। এসবের মানে কী?
রুনু বেশ চিন্তিত। কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
সাদি বলল, বুঝতে না পারার কিছু নেই। সুরসুরি বা শ্বাস ফেলার ব্যাপারটি ঘটেছে স্বপ্নে। আর পারফিউমের গন্ধটা ওর নিজের পারফিউমেরই গন্ধ। হয়তো ঘরের কোথাও পারফিউমের শিশি আগেই ছিটকে পড়ে ভেঙে টেঙে ছিল, ওই থেকে গন্ধ আসছিল।
সুমি বলল, তাহলে প্রথমবার গন্ধটা পাইনি কেন?
হয়তো গন্ধটা তখনও ছিল। তুই খেয়াল করিসনি।
কিন্তু সুইচ টেপার পর আলোটা পরেরবার জ্বলল না কেন?
কী করে জ্বলবে? তখন তো ইলেকট্রিসিটি ছিল না।
মূসা সাহেব বললেন, তুই বুঝলি কী করে যে ইলেকট্রিসিটি ছিল না?
তোমাদের কথাবার্তা শুনে বেরিয়ে আসবার কিছুক্ষণ আগে টয়লেটে গিয়েছিলাম আমি। তখন আমার বাথরুমের আলো জ্বলেনি। ব্যাপারটা হয়েছে এই রকম, সুমি এসে তোমাদের দরজায় ধাক্কা দিয়েছে ঠিক তখুনি আলো এসেছে। এইজন্য তোমরা সুইচ টেপার সঙ্গে সঙ্গে আলো জ্বলেছে।