আজও এভাবেই বলল। বলতে বলতে মন এলোমেলো করে দেয়া মানুষটার কথা ভুলতে পারল এবং এক সময় তন্দ্রামতো এলো সুমির।
এই অবস্থায় আবার সেই অনুভূতিটা ফিরে এলো। সেই সুরসুরির অনুভূতি।
কিন্তু এবার আর পায়ে নয়। তলপেটের সামান্য ওপরে, নাভির কাছাকাছি। সুমির মনে হলো তলপেটের সামান্য নিচে নেমে আছে তার সালোয়ার এবং নাভির সামান্য উপরে ওঠে গেছে কামিজ। ফলে যে জায়গাটুকু উন্মুক্ত হয়েছে। সেখানে মৃদু মোলায়েম হাতে সুরসুরি দিচ্ছে কেউ।
সুরসুরি দিচ্ছে নাকি হাত বুলাচ্ছে! সঙ্গে সঙ্গে গলার কাছে, গালের কাছেও একই অনুভূতি। কিন্তু এখানে ঠিক সুরসুরি নয়, যেন কেউ মুখ ঘষছে। খুবই নরম, আদুরে ভঙ্গিতে মুখ ঘষছে। তার শ্বাস প্রশ্বাসও যেন টের পেল সুমি। সঙ্গে বেশ পুরুষালি একটা পারফিউমের গন্ধ।
এবার আপাদমস্তক কেঁপে উঠল সুমি। ধরফর করে উঠে বসতে গিয়ে পারফিউমের গন্ধটা চিনতে পারল। খুবই পরিচিত, কমন পারফিউম, ওয়ান ম্যান শো।
কিন্তু এতরাতে বন্ধঘরে এই পারফিউম মেখে কে এসে নাভিমূলে সুরসুরি দিচ্ছে সুমির?
গলার কাছে, গালের কাছেই বা মুখ ঘষছে কে?
সুমি বেডসুইচ টিপল। কিন্তু আলো জ্বলল না।
এবার বুকটা ধ্বক করে উঠল সুমির। হাত পা কাঁপতে লাগল। ঢোক গিলতে গিয়ে টের পেল গলা একেবারেই শুকিয়ে গেছে। দমটাও কী রকম বন্ধ হয়ে আসছে। অর্থাৎ প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে সে।
ব্যাপারটা কী? কী হচ্ছে এসব? প্রথমে পায়ে সুরসুরি, তারপর নাভিমূল এবং গালে মুখে। সঙ্গে পারফিউমের গন্ধ, গালে গলায় কার মুখের স্পর্শ! এখন সুইচ টিপে দেখছে আলো জ্বলছে না।
কিন্তু ভূতের ভয়ে সুমির একদমই নেই। কোনওদিনও ছিল না। স্কুলে পড়ার সময় থেকে সে একা ঘরে শোয়। ভয় টয় কোনওদিনও তেমন পায়নি। এমন কি দুঃস্বপ্নও সে তেমন দেখে না। ঘুম আগে আর একটু গভীর ছিল। গত কয়েক মাসে হালকা হয়ে গেছে। আজেবাজে স্বপ্ন দেখে প্রায়ই। অর্থাৎ আগের সুমির সঙ্গে আজকের সুমির অনেক ব্যবধান। গত কয়েক মাসে সুমি অনেক বদলে গেছে।
কিন্তু ভূতের ভয় তার তৈরি হয়নি।
তবু সুমি এখন ভয় পাচ্ছে। প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে। কিন্তু বন্ধ ঘরে কে এসে ঢুকবে, কে এমন করবে সুমির সঙ্গে!
নাকি আসলে এসব ঘটেনি, সুমি দুঃস্বপ্ন দেখেছে অথবা অবচেতনে এই ধরনের অনুভূতি হচ্ছে।
কিন্তু আলো জ্বলছে না কেন? এটা তো ভৌতিক কাণ্ড!
ঠিক তখুনি গ্রীবার কাছে অতি মৃদু ভঙ্গিতে শ্বাস ফেলল কেউ, সঙ্গে সেই পারফিউমের গন্ধ।
সঙ্গে সঙ্গে সুমি একেবারে লাফিয়ে উঠল। কে? কে এখানে? কে? এ্যা, কে?
নিজের অজান্তে অন্ধের ভঙ্গিতে এদিক ওদিক শূন্যে হাতাতে লাগল সে। কে? কে এখানে? কে?
কিন্তু কাউকে ছুঁতে পারল না সুমি। কারও স্পর্শ কিংবা অস্তিত্ব টের পেল না। শুধু নিরেট বিছানা, নেটের মশারি, বেডসুইচ, পড়ার টেবিল চেয়ারে হাত লাগছে, বইপত্রে হাত লাগছে।
লাফিয়ে বিছানা থেকে নামলো সুমি। নিরেট অন্ধকারে হাতাতে হাতাতে দরজার কাছে এল। ছিটকিনি খুলে পাগলের মতো ছুটে এল মা বাবার বেডরুমের দরজায়। দুহাতে দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে মাকে ডাকতে লাগল, বাবাকে ডাকতে লাগল। ওমা, মা। বাবা, বাবা দরজা খোল, তাড়াতাড়ি দরজা খোল। তাড়াতাড়ি।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে আলো জ্বলল। মূসা সাহেব দরজা খুললেন। তাঁর পেছনে রুনু। রুনুই আগে কথা বললেন, কী রে, কী হয়েছে?
সুমির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। চোখে আতঙ্ক। প্রথমে কথাই বলতে পারল না সে।
মূসা সাহেব দেখতে পেলেন মেয়েটি তাঁর থরথর করে কাঁপছে। দুহাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। কী হয়েছে মা? কী হয়েছে? এমন করছিস কেন?
তখনও কথা বলতে পারছে না সুমি। বাবার বুকে থরথর করে কাঁপছে। কোন ফাঁকে রুনু ধরেছিলেন মেয়ের হাত। তিনিও ততোক্ষণে দিশেহারা। অস্থির গলায় বললেন, কী রে, কথা বলছিস না কেন? কী হয়েছে? ভয় পেয়েছিস? দুঃস্বপ্ন দেখেছিস?
সুমি কথা বলবার আগেই নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এল সাদি। হৈ চৈ শুনে ঘুম ভেঙে গেছে তার। মা বাবা এবং সুমিকে দেখে সে এসে দাঁড়াল তিনজন মানুষের সামনে। ঘুম ঘুম গলায় বলল, কী হয়েছে?
রুনু বললেন, কিছুই তো বুঝতে পারছি না। পাগলের মতো দরজা ধাক্কাচ্ছিল। এখন কোনও কথা বলছে না।
মূসা সাহেব এসব কথা গ্রাহ্য করলেন না। সুমিকে বুকে জড়িয়ে তার মাথায় পিঠে হাত বুলাচ্ছেন। কী হয়েছে মা? বল আমাকে। ভয় পেয়েছিস? বল। না বললে বুঝব কী করে?
সাদিও বলল কথাটা। বল কী হয়েছে? না বললে সমস্যাটা আমরা বুঝব কী করে?
তততক্ষণে নিজেকে কিছুটা সামলেছে সুমি। কোনও রকমে বলল, আমার রুমে যেন কে ঢুকেছিল।
এ কথা শুনে তিনজন মানুষ একসঙ্গে চমকাল।
মূসা সাহেব বললেন, কী?
সুমি মাথা নাড়ল। হ্যাঁ বাবা। কে যেন ঢুকেছিল আমার রুমে।
রুনু বললেন, কে? কে ঢুকেছিল?
তা বলতে পারি না!
সাদি বলল, তোর রুমের দরজা বন্ধ ছিল না?
ছিল।
সঙ্গে সঙ্গে তিনজন মানুষ মুখ চাওয়া চাওয়ি করল।
মূসা সাহেব বললেন, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকলে সেই রুমে কেউ ঢোকে কেমন করে?
রুনু বললেন, কী আশ্চর্য কথা! তাছাড়া ওর রুমে মাঝরাতে কে ঢুকতে যাবে? এই বাড়িতে আছে কে? বুয়া আর মতি থাকে নীচতলায়। তাছাড়া এরকম রাত দুপুরে…।