সুমি ফ্যাল ফ্যাল করে মিলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
মিলা বলল,গ্যাপ না হলেও বোধহয় তোকে আমি একথা বলতাম না। পৃথিবীর কাউকে বলতাম না।
তার মানে এটা কেউ জানে না?
যে করেছে সে জানে।
সে তো জানবেই।
এছাড়া আর কেউ জানে না।
আজ তাহলে আমাকে বললি কেন?
না বললে আমাকে তুই বুঝতে পারবি না।
আমি যে বললাম তোর পেটে কোনও কথা থাকে না, কথা যে থাকে সেটা প্রমাণ করার জন্য বললি?
কিছুটা সেজন্য কিন্তু বেশির ভাগটাই অন্য কারণে।
কী কারণ?
জয়কে কেন আমি অতটা প্রশ্রয় দিয়েছিলাম এই ব্যাপারটির সঙ্গে কিছুটা হলেও তা জড়িত। আসলে ব্যাপারটি তাৎক্ষণিকভাবে আমাকে কিছুটা, কিছুটা নয় অনেকখানি বদলে দিয়েছিল। অন্যরকম করে দিয়েছিল। নিজেকে যেন আমি আর চিনতে পারছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা ভোলার জন্য আমি যা নই তাই হয়ে যাব, নীতিগতভাবে যে সমস্ত কাজ মানুষের করা উচিত নয়, আমি তাই করব। অর্থাৎ উল্টোপাল্টা সবকিছু।
এজন্যই জয়ের প্রপোজাল একসেপ্ট করেছিলি?
মনে হয়।
তাহলে সে কথা আবার আমাকে বললি কেন?
সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু বলিনি।
তাহলে?
বেশ কয়েকদিন পরে বলেছি।
কেন?
মনে হলো সবচে’ প্রিয় বন্ধুটিকে জানাই। এমন একটা জায়গায় আঘাত দিই তার, সে দিনরাত জ্বলুক।
বলিস কী? তুই তো সাইকিক পেসেন্ট হয়ে গিয়েছিলি!
সত্যি আমি তাই হয়ে গিয়েছিলাম। তবে জয় খুব ভালছেলে।
কেমন?
সে যদি তখন কোনও রকমের বাড়াবাড়ি করতো, অর্থাৎ ফিজিক্যালি আমাকে চাইতো আমি বোধহয় রাজি হয়ে যেতাম।
বলিস কী?
সত্যি। কিন্তু জয়ের সবকিছু ওই মুখে মুখে। কাছাকাছি গেলে সে অতি দ্র। হাতটাত ধরা তো দূরের কথা, আমার দিকে ভাল করে তাকিয়েও দেখেনি। শুধু মজার মজার কথা আর কথা। জয়ের কথা শুনতে শুনতেই আসলে নিজের মধ্যে ফিরে আসতে পেরেছি আমি। তোর কাছে আজ ফিরে আসতে পেরেছি।
একথা শুনে সুমি আবার উদাস হলো। জয়কে ঘিরে মনের ভেতর জমে থাকা কিছু কথা মনে পড়তে চাইল। জোর করে তা দমিয়ে রাখল সুমি। মিলার দিকে তাকিয়ে বলল, ঘটনাটা কীভাবে ঘটল আমাকে বল। কে ঘটাল?
মিলা বলল, না বলব না।
কেন?
আমি ভুলে যেতে চাই। আমি সব ভুলে যেতে চাই। ও রকম ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছিল, আমি ভুলে যেতে চাই। আমি গত তিন সাড়ে তিনমাস
সময়কেই আমার জীবন থেকে মুছে ফেলতে চাই। তোর সঙ্গে আমার আচরণ, জয়ের সঙ্গে নীতিহীন মেলামেশা, আমি সব ভুলে যেতে চাই। আমি এখন থেকে আবার তোর সেই বন্ধু। আমি আর কেউ না।
বলে হু হু করে কাঁদতে লাগল মিলা।
মিলার কান্না দেখে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল সুমি। তারপর উঠে মিলার পাশে এসে দাঁড়াল। দুহাতে মিলার মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলল, কাঁদিস না, কাঁদিস না। মানুষের জীবনে কত কী ঘটে! খারাপ স্মৃতি ভুলে যাওয়াই ভাল। আমিও ভুলে যাব সব। আমি এই খারাপ সময়টার কথা মনে রাখব না।
বিকেলবেলার আকাশ তখন একটু যেন বেশি উজ্জ্বল হয়েছে।
৬. সেই একটা রাতই রুনুর রুমে
সেই একটা রাতই রুনুর রুমে কাটিয়ে ছিল সুমি।
তার পরদিন থেকে রাতেরবেলা নূরজাহান থাকে তার রুমে। সুমি তার বিছানায়, নূরজাহান নীচে। মেঝেতে।
আগে বেশ টিভি দেখার শখ ছিল সুমির।
নিজের রুমে টেলিভিশন একটা আছে। চৌদ্দইঞ্চি সনি টেলিভিশন। গত দুআড়াই মাস ধরে সেভাবে টেলিভিশন আর দেখা হয় না তার। দেখতে ভাল লাগে না।
টেলিভিশনের কারণে আগে ঘুমাতে ঘুমাতে বারোটা সাড়ে বারোটা বেজে যেত। আজকাল দশটা সাড়ে দশটার মধ্যেই শুয়ে পড়ে।
সুমির আরেকটা অভ্যেস হচ্ছে, আলোতে সে একদমই ঘুমোতে পারে না। সেই আলো যতই মৃদু হোক, যতই মোলায়েম হোক। এজন্য ডিমলাইট থাকার পরও কখনও ডিমলাইট জ্বালানো হয় না তার। অন্ধকারে নিজের বিছানায় শুয়ে মগ্ন হয়ে যে কোনও কিছু ভাবতেই ভাল লাগে সুমির। কিন্তু ভাবতে সে আজকাল চায় না। এজন্য শুয়ে পড়ার পর যতক্ষণ ঘুম না আসে নূরজাহানের সঙ্গে টুকটাক কথা বলে।
সেদিনের পর থেকে নূরজাহানের সঙ্গে যেন আলাদা একটা ভাব হয়ে গেছে তার।
আজও শুয়ে পড়ার পর অনেকক্ষণ কথা বলেছিল।
মিলার ব্যাপারটা জানার পর থেকে অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে তার। মিলার ওপর থেকে যাবতীয় রাগ অভিমান চলে গেছে। আশ্চর্য এক মায়া হচ্ছে মিলার জন্য। ও রকম ঘটনা কোনও মেয়ের জীবনে ঘটলে সেই মেয়ের সব কিছুই উলট পালট হয়ে যাওয়ার কথা। মিলারও তাই হয়েছিল। তার ওপর পুরো ব্যাপারটাই সে চেপে গিয়েছিল। কারও সঙ্গে শেয়ার করেনি বলে মনের ওপর চাপটা তার বেশি পড়েছিল। এজন্যই সুমি এবং জয়ের সঙ্গে এলোমেলো আচরণগুলো সে করেছে।
সবচে’ আনন্দের কথা মাস তিনেকের মধ্যে নিজেকে সে সামাল দিয়ে ফেলেছে। ভেতরে ভেতরে আশ্চর্য এক শক্তি সঞ্চয় করেছে। জয়ের কাছ থেকে নিজেকে ফিরিয়েছে। প্রিয়তম বন্ধুর কাছে ফিরে এসেছে।
কিন্তু কে এই সর্বনাশটা করল মিলার?
এইসব ব্যাপার কি তাহলে গোপন প্রেমের মতোই এমন এক গোপন ক্ষত, জীবন দিয়ে হলেও মেয়েরা তা চেপে রাখে!
তারপরই একটা কথা ভেবে দম বন্ধ হয়ে এল সুমির।
গল্প উপন্যাস এবং সিনেমা নাটকে যে দেখা যায় এই ধরনের ঘটনা ঘটলেই মেয়েটি প্রগন্যান্ট হয়ে যায়। মিলার সেই ধরনের কোনও সমস্যা হয়নি তো?
সর্বনাশ!
একথা তো মিলাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি!