রাতেরবেলা একদম ঘুম হয় না আমার।
কেন?
প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল সুমি। চা খাবি?
না। চা খেয়ে বেরিয়েছি।
অনেকদিন পর এলি। অনেকদিন পর তোর সঙ্গে দেখা হলো।
মিলা মাথা নীচু করে বলল, হ্যাঁ।
তুই ভাল আছিস তো?
আছি।
সুমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, অন্যান্য খবর কী?
এই তো চলছে।
তোদের বাড়ির সবাই ভাল?
হ্যাঁ।
তারপর দুজনেই চুপচাপ হয়ে গেল। যেন কথা ফুরিয়ে গেছে তাদের। যেন কথা খুঁজে পাচ্ছে না কেউ।
এই রকম অস্বস্তিকর পরিবেশে বেশ খানিকটা সময় কাটল। তারপর মিলা এক সময় বলল, আমি তোর সঙ্গে কিছু কথা বলতে এসেছি, সুমি।
মিলার দিকে তাকাল না সুমি। বলল, কী কথা?
তোর আর আমার ব্যাপারে।
বল।
মাঝখানে অবশ্য আরেকজন লোক আছে।
এই ব্যাপারটায় আমি কোনও কথা বলতে চাই না।
তুই বলতে না চাইলেও আমাকে যে বলতেই হবে।
কেন?
কারণ তোদের দুজনার মাঝখানে আমি কাঁটার মতো ফুটে আছি।
এবার মুখ ঘুরিয়ে মিলার দিকে তাকাল সুমি। এতদিন পর আজ একথা তোর কেন মনে হলো?
এতদিন পর মানে?
ব্যাপারটা তো আড়াই তিনমাসের পুরনো।
তা হোক। আড়াই তিনমাস এমন কিছু সময় নয়।
এতদিন এসব বলতে তুই আসিসনি কেন?
তোর ওপর আমার খুব রাগ হয়েছিল।
উল্টো বলছিস।
কেমন?
রাগ তো তোর ওপর আমার হওয়ার কথা।
তা তো তুই হয়েইছিলি এবং খুবই অপমানকর কথাবার্তা বলেছিলি আমাকে। সেজন্য আমারও রাগ হয়েছে। আসলে তুই আমাকে অযথা ভুল বুঝেছিলি। আমার তো কোনও দোষ ছিল না। আমি তোর সঙ্গে তোর লাভারের ওখানে গেছি, তারপর সে যদি আমাকে প্রপোজ করে তাতে আমার কী করার থাকে বল তো?
তখন হয়তো ছিল না। কিন্তু তারপর তুই তাকে প্রশ্রয় দিয়েছিস।
ওটা আমি তোর ওপর রাগ করে করেছি।
প্রকৃত বন্ধু বন্ধুর ওপর রাগ করে কি বন্ধুর প্রেমিক কিংবা প্রেমিকাকে ভাগিয়ে নিতে পারে?
না তা পারে না। সেটা উচিত নয়।
তাহলে?
কিন্তু একটা কথা তুই ঠাণ্ডামাথায় ভাব তো, আমার মধ্যে যদি সত্যি কোনও শয়তানি থাকতো, যদি সত্যি জয়কে আমি চাইতাম তাহলে কি সে আমাকে প্রপোজ করার পর সেকথা তোকে আমি বলতাম?
সুমি কথা বলল না।
মিলা বলল, আমি তোকে বলেছিলাম তুই আমার প্রিয়বন্ধু বলেই। বলার উদ্দেশ্যটা ছিল জয়ের ব্যাপারে তোকে সাবধান করে দেয়া। অর্থাৎ বলতে চেয়েছি এই ধরনের পুরুষকে শক্ত হাতে ধরে রাখতে হয়। কিন্তু তুই উল্টো আমার ওপর রেগে গেলি।
আর এই রাগের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তুই তার সঙ্গে ঢলাঢলি করতে শুরু করলি?
মিলা মুখ কালো করে বলল, ছিঃ সুমি! তোর মুখে এই ধরনের শব্দ মানায় না।
সুমি একটু লজ্জা পেল। কথা বলল না।
মিলা বলল, তারপরও আমি কিছু মনে করলাম না। কারণ আমি আজ এসেছি ভুল বোঝাবুঝিটা মিটিয়ে ফেলতে।
সুমি মন খারাপ করা গলায় বলল, এখন আর মিটিয়ে ফেলবার কিছু নেই। সব শেষ হয়ে গেছে।
না কিছুই শেষ হয়নি। সব ঠিক আছে। তোর জয় তোরই আছে।
চোখ তুলে মিলার দিকে তাকাল সুমি। এই কথাটি তুই আর কক্ষনো আমার সামনে উচ্চারণ করবি না।
মিলা হাসল। কিন্তু করতে আমাকে হবেই।
কেন?
তোদের দুজনার ভালোর জন্য।
ওকে নিয়ে ভালমন্দ কোনও কিছুরই দরকার নেই আমার। তুই তো একটা মেয়ে, তুই কি আসলে বুঝতে পেরেছিস কতো বড় অপমান সে আমাকে করেছে? যে বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আমি আমার ভালবাসার মানুষের সঙ্গে দেখা করতে গেছি, মানুষটি আমাকে পাত্তা না দিয়ে, আমার কথা না ভেবে আমার। বন্ধুকে প্রস্তাব দিল! একবারও আমার কথা ভাবল না, একবারও বুঝল না ব্যাপারটা আমার জন্য কত অপমানকর! আমি যদি বিশ্বসুন্দরী সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াই, আমি যত কুৎসিতই হই, আমার প্রেমিক কি আমাকে রেখে ওই বিশ্ব সুন্দরী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে? এটা হয় নাকি?
না এটা আসলে অন্যায়। ঘোরতর অন্যায়।
তাহলে?
কিন্তু ব্যাপারটা তো ছিল ফান।
সুমি যেন বেশ বড় রকমের একটা ধাক্কা খেল। কী?
হ্যাঁ। জয় আমাকে বলেছে, ওটা ছিল ঠাট্টা। মজা করার জন্য সে এমন করেছে। এটা তার স্বভাব।
এসব হাস্যকর কথা বলে কোনও লাভ নেই। এই ধরনের ফান কখনও কেউ করে না।
তুই বিশ্বাস কর, সত্যি এটা ফান।
মিলার চোখের দিকে তাকিয়ে সুমি বলল, বুঝলাম জয়ের দিক থেকে এটা ফান ছিল। আর তোর দিক থেকে?
মিলা চুপ করে রইল।
চুপ করে আছিস কেন? কথা বল।
আমি আজ তোর সঙ্গে মিথ্যে বলব না। তোর ওপর রাগ করে আমি জয়কে প্রায়ই ফোন করেছি, জয়ের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছি, চারবার। আমাদের দেখা হয়েছে, আমি বেশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলাম ওর ওপর, জয়ও বোধহয় আমাকে একটু প্রশ্রয় দিচ্ছিল। সবকিছু পরিষ্কার বোঝার জন্য কয়েকদিন আগে আমি ওদের উত্তরার বাড়িতে গিয়েছিলাম…।
মিলার কথা শেষ হওয়ার আগেই সুমি বলল, ব্যাস, আমি আর শুনতে চাই না।
কিন্তু শুনতে তোকে আজ হবেই।
সুমি অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।
মিলা বলল, ওই যাওয়াটায় যে কী উপকার হয়েছে আমার, আমি ছাড়া কেউ তা বুঝতে পারবে না। পুরো ভুল বোঝাবুঝিটা শেষ হয়েছে। জয়ের ব্যাপারে আমার মধ্যে তৈরি হওয়া দুর্বলতাটুকু কেটে গেছে এবং আমি তোর কাছে ফিরে আসার সাহস পেয়েছি।
সুমি কথা বলল না।
হাত বাড়িয়ে সুমির একটা হাত ধরল মিলা। সুমি, জয় তোকে খুব ভালবাসে। খুব। তুই হয়তো জানিসই না কী রকম ভাল সে তোকে বাসে। জীবনের সবকিছু সে তোর জন্য রেখে দিয়েছে।