- বইয়ের নামঃ অন্তরে
- লেখকের নামঃ ইমদাদুল হক মিলন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. ব্যাপারটা শুরু হলো পা থেকে
অন্তরে – (উপন্যাস) ইমদাদুল হক মিলন
প্রথম প্রকাশ – একুশের বইমেলা ২০০১
উৎসর্গ
প্রিয়দর্শন গায়ক শুভ্রদেবকে
গভীর ভালবাসায়
ব্যাপারটা শুরু হলো পা থেকে।
রাত দুপুরে সুমির মনে হলো তার ডানপায়ে কে যেন সুরসুরি দিচ্ছে। মৃদু মোলায়েম সুরসুরি। পায়ের পাতার ওপর দিয়ে আলতো ভঙ্গিতে তেলাপোকা হেঁটে গেলে যে অনুভূতি হয় ব্যাপারটা তেমন।
সুমির ঘুম পাতলা। ফলে মুহূর্তেই ভেঙে গেল। কিন্তু ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে সুরসুরিটা উধাও। সুমি ঠিক বুঝতে পারল না আসলেই কি অনুভূতিটা হচ্ছিল নাকি ঘুমঘোরে এমন মনে হয়েছে। নাকি সে আসলে স্বপ্ন দেখছিল। অনুভূতিটা হচ্ছিল স্বপ্নে। নাকি সত্যি সত্যি তেলাপোকা হেঁটে গেছে পায়ের ওপর দিয়ে।
কিন্তু সুমির বিছানায় মশারি টাঙানো। এ বাড়িতে মশার উপদ্রব তেমন নেই। মা বাবা এবং ভাইয়া মশারি না টাঙিয়েই ঘুমোয়। শুধু সুমি, মশারি না টাঙিয়ে কিছুতেই বিছানায় যাবে না সে। মশা নয়, তেলাপোকার কারণে এই ব্যবস্থা। |||||||||| সুমির তেলাপোকা ভীতি ভয়াবহ। গায়ে তেলাপোকা উঠলে অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে সে। তেলাপোকার কারণে মশারি তো সে টাঙাবেই, টাঙিয়ে অতি যত্নে, অতি নিখুঁত ভঙ্গিতে বিছানার চারপাশে এমন করে গুজবে মশারি, তেলাপোকার বাবারও সাধ্য নেই এই দুর্ভেদ্য প্রাচীর গলে ভেতরে প্রবেশ করার। তার ওপর প্রতি পনের দিনে একবার নকরোচ এনে নিজ হাতে ছড়িয়ে রাখবে আনাচে কানাচে, যে সমস্ত জায়গায় তেলাপোকাঁদের থাকার সম্ভাবনা সে সমস্ত জায়গায়। হাতের কাছে সব সময় আছে এরোসল। ধারী তেলাপোকা তো দূরের কথা, নকরোচের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া ছানাপোনাও যদি দুএকটা চেখে পড়ে, তক্ষুণি তাদের ওপর ফুস করে স্প্রে করবে এরোসল। অর্থাৎ তেলাপোকার বংশ ধ্বংস।
সুমির এই অত্যাচারের ফলে বাড়িটা একেবারেই তেলাপোকা শূন্য। তাহলে সুমির পায়ে এই অনুভূতিটা হলো কী করে? কে সুরসুরি দিল পায়ে।
দরজা বন্ধ করে ঘুমোনোর অভ্যেস সুমির। সুতরাং কেউ যে তার রুমে ঢুকে পায়ে সুরসুরি দেবে সে উপায় নেই। তাছাড়া মধ্যরাতে তাকে না ডেকে কে ঢুকবে তার রুমে?
সুমিদের বাড়িতে তারা চারজন মানুষ। মা বাবা ভাইয়া আর সুমি। দুজন। কাজের লোক আছে। নূরজাহান বুয়া আর তার তেরো চোদ্দ বছরের ছেলে মতি। মা বাবা কিংবা ভাইয়া রাত দুপুরে সুমির ঘরে ঢুকে নিশ্চয় তার পায়ে সুরসুরি দেবে না। নূরজাহান বুয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। দিনভর কাজ করে। রাতভর মরার মতো ঘুমোয়। সম্ভব শুধু মতির পক্ষে। কারণ ছোঁকড়াটা দুষ্ট প্রকৃতির। কিন্তু সুমিকে সে যমের মতো ভয় পায়। এমন সাহস মতির কখনই হবে না, সুমি ঘুমিয়ে আছে আর তার রুমে ঢুকে তার পায়ে সুরসুরি দিচ্ছে! সবচে’ বড় কথা হলো রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। লোক ঢুকবে কী করে!
তারপরই সুমির মনে হলো ঘুমোবার আগে দরজাটা কি আজ সে বন্ধ করেছিল!
হয়তো বন্ধ করেনি। দরজা খোলা দেখে বাবা হয়তো তার রুমে ঢুকে সুমির সঙ্গে একটু দুষ্টুমি করছে। এই ধরনের দুষ্টুমির স্বভাব বাবার আছে। বিশেষ করে সুমির সঙ্গে। আচমকা এমন করতেও পারেন তিনি।
বাবার কথা ভেবে ভাল লাগল সুমির। সত্যি সত্যি বাবা যদি এসে থাকেন, সত্যি সত্যি যদি সুমির পায়ে সুরসুরি দিয়ে থাকেন তাহলে বেশ মজা হবে।
বাবার কথা ভেবে প্রথমে মাথার কাছের আলোটা জ্বালল সুমি। তারপর বিছানায় উঠে বসল।
রুমে কেউ নেই। ওই তো ভেতর থেকে ছিটকিনি বন্ধ দরজা। তাহলে পায়ে সুরসুরিটা সুমির দিল কে? সুমি একটু চিন্তিত হলো। তাহলে কি তেলাপোকা ঢুকেছে মশারির ভেতর!
সুমি তারপর পাগলের মতো তেলাপোকা খুঁজতে লাগল। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও তেলাপোকা পেল না। আর যেভাবে মশারি গোঁজা, তেলাপোকা ঢোকা সম্ভবই না।
মশারি গোঁজার আগেই যদি ঢুকে বসে থাকত তাহলেও যেভাবে সুমি খুঁজেছে, না পাওয়ার কোনও কারণ নেই। তোলাপোকা কেন পিঁপড়ে হলেও চোখে পড়ত।
তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াল কী? সুমির পায়ে আসলে কেউ সুরসুরি দেয়নি। তেলাপোকা, না মানুষ। সে হয়তো স্বপ্ন দেখেছে। সুরসুরির অনুভূতিটা হয়েছে স্বপ্নে।
লাইট অফ করে শুয়ে পড়ল সুমি।
সুমির ঘুম পাতলা তার ওপর একবার ভাঙলে সহজে আর আসতে চায় না। ঘুম ভাঙার পর আবার ঘুম না আসা পর্যন্ত সময়টা খুবই যন্ত্রণার। কী যে অসহায় লাগে! সবচে’ বড় কথা কত কথা যে মনে পড়ে!
এখনও পড়ল।
কিন্তু যে মানুষটার কথা মনে পড়ল তার কথা সুমি ভাবতে চায় না। একেবারেই ভাবতে চায় না। সেই মানুষটার কারণে জীবন অন্যরকম হয়ে গেছে তার। এলোমেলো হয়ে গেছে। মনের ভেতর দেখা দিয়েছে নানারকমের জটিলতা। হাজার চেষ্টায়ও জটিলতাগুলো কাটাতে পারছে না সে।
কিন্তু এই যে রাত দুপুরে ঘুম ভেঙে মানুষটার কথা সুমির মনে পড়ছে, মন থেকে এখন সে তাকে মোছে কী করে?
ভাবনাটা সে তাড়ায় কী করে?
এইসব মুহূর্তে আজকাল খুব আল্লাহকে ডাকে সুমি। আল্লাহকে বলে, ইয়া হে আল্লাহ, তোমার রহমতের দরজা আমার জন্য খুলে দাও। আমার মন থেকে ওর চিন্তা মুছে দাও। আমার মনে শান্তি দাও।